মাসকাওয়াথ আহসানঃ সালমান এফ রহমান আমার পছন্দের মানুষদের একজন। কারণ এমেরিকার মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিগুলো যেমন মেধাবী ছাত্রদের ক্যাম্পাস থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চাকরি দেয়; বেক্সিমকো একইভাবে আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেক্সিমকোতে কাজ দিয়েছিলো। বেক্সিমকো শিক্ষানবীশ কর্মীদের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো হার্ভার্ডের অধ্যাপক প্রশিক্ষক এনে। ধানমন্ডি পাঁচ-এর এইচ-আর অফিসের সেই প্রশিক্ষণ কক্ষে প্রতিদিন লাঞ্চ বক্স এসেছে ঢাকার সবচেয়ে এক্সপেনসিভ রেষ্টুরেন্ট থেকে। আব্বা-আম্মার চেয়ে ভালো আচরণ করেছেন সালমান ও সোহেল এফ রহমান। ফলে প্রথম চাকরিদাতা হিসেবে আর ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য বের হওয়া ডিসিপ্লিন না মানা তরুণকে স্নেহ করায় বেক্সিমকো আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান। এমন কী সিভিল সার্ভিসে চান্স পেলে বেল টাওয়ারের হেড অফিসে ডেকে একঘন্টা বুঝিয়েছেন দুজন অত্যন্ত স্নেহময় ডিরেক্টর। এমেরিকার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠানো ও দ্রুত প্রমোশন দিয়ে সিনিয়র ম্যানেজমেন্টে নিয়ে আসার ক্লিয়ার প্রসপেক্ট তুলে ধরেছিলেন তারা। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের পাওয়ার করিডোরের অন্দর মহল দেখার আগ্রহের কারণে বিনীতভাবে দুঃখ প্রকাশ করে, প্রথম ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ছেড়ে দিই। ফলে আজকে যে প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি; এ অনেকটা নিজের কাছের মানুষকে জবাবদিহিতে বাধ্য করার মতো মন খারাপের বিষয়।
বিবিসির এক রিপোর্টে দেখলাম, সরকার স্বীকার করেছে, ফাঁস হওয়া টেলিফোন কলটি সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রীর মাঝে। কিন্তু শুধু ঐটুকুই; সরকার কোন ব্যাখ্যা দেয়নি; কলটিতে যে আলোচনা হয়েছে; সেখানে, “জয়ের প্রজেক্ট” নিয়ে কথাগুলোর। গণতান্ত্রিক দেশে জনগণের ট্রাস্ট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঐ টেলিফোন কলে সেই বিশ্বাস ভঙ্গের আভাস ফুটে ওঠে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কোন প্রকল্পের নাম “জয়ের প্রকল্প” হতে পারে না। বাংলাদেশ আফ্রিকার কোন উগান্ডা বা দূর প্রাচ্যের উত্তর কোরিয়া নয়; তবু ঠিক কী কারণে মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে “জয়ের নামে” ডাকটিকেট উন্মুক্ত করেছিলেন তা-ও স্পষ্ট নয়।সজীব ওয়াজেদ জয় (সওজ) ভারতে ও এমেরিকায় শিক্ষিত আমাদের সমসাময়িক মানুষ। ভারতে কোন প্রধানমন্ত্রীর ছেলের নামে ডাক টিকেট উন্মুক্ত হবার ইতিহাস আছে কীনা জানি না। ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করলেও তাকে নিয়ে কোন ডাকটিকেট উন্মুক্ত হবার কথা শুনিনি। এমেরিকায় ট্রাম্পও তার মেয়ের নামে কোন ডাকটিকেট উন্মুক্ত করেননি। জব ক্রিয়েশনে ট্রাম্পের মেয়ে সফলভাবে কাজ করেছেন যদিও। তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশের কাজ করায় জয়ের নামের ডাকটিকেট উন্মুক্ত করা কোন ধরণের এনটাইটেলমেন্ট। একবিংশের আধুনিক পৃথিবীতে এরকম প্রাধিকার চর্চা উত্তর কোরিয়া আর কাজাখস্তান ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। মি সওজ অত্যন্ত স্মার্ট বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ; লেটস টক অনুষ্ঠানে কথা-বার্তায় আধুনিক গণতন্ত্রের দেশে আর পাঁচটা নাগরিকের মতো কথা বলেছেন। সহমত ভাইয়েরা তেলাঞ্জলি দিতে চাইলেও এড়িয়ে গেছেন সুন্দর রম্য করে। সেই সওজ কী করে তার নামে ডাকটিকেট উন্মুক্ত করার মধ্যযুগীয় জব্বারীয় প্রস্তাবে রাজি হলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোয় স্নাত হয়েও কী করে ‘জমিদারী ব্যবস্থার’ অয়োময় হতে চাইলেন তিনি!
এ প্রশ্নটা প্রধানমন্ত্রীকেও করা যেতো। কিন্তু আমার মা প্রায় উনার বয়েসী। আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় ইয়েস আম্মা ইয়েস আম্মা বললে উনি সুস্থ থাকেন। নইলে মন খারাপ করে বিষণ্ণ হয়ে যান। তাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও ইয়েস পিএম, ইয়েস পিএম করি। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সুশাসন রচনার সহযোগী হিসেবে।
হাওয়া ভবন বাংলাদেশে মধ্যযুগের অন্ধকার সামন্ত প্রথা চালু করায়; বীতশ্রদ্ধ হয়ে ক্যারিয়ারের পিক মোমেন্টাম ফেলে জার্মানি চলে যাই। তারেক রহমানের কাছে প্রশ্ন তোলার সাহস পাইনি। উনি একটি জনসভায় হাতের ইশারা করে ‘গলা নামিয়ে দেবার’ হুমকি দিচ্ছিলেন। ঐ বরুণ গান্ধী টাইপ জিঘাংসা দেখে কেটে পড়েছি। অহিংস কলম কী বোর্ড দিয়ে তো অস্ত্রের সামনে দাঁড়নো যায় না; জীবন তো একটাই। ১৯৭৯-৮০ সালে বঙ্গভবনে জিয়াউর রহমানের হাত থেকে পরপর দুবার জাতীয় শিশু পুরস্কার নেবার সময়, উনি বলেছিলেন, প্রত্যেক বছর এসে দেখি বক্তৃতা-বিতর্কের পুরস্কার নিয়ে যাও! আশীর্বাদ করেছিলেন, সুশিক্ষিত সুনাগরিক হও বলে। তার ছেলে তারেক রহমান যখন একটি টিভি ইন্টারভিউয়ে বললেন, যে একটা কারখানা চালাতে পারে; সে দেশ চালাতে পারে। সুতরাং আমি চাই, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সংসদে আসুক। এরকম রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর সঙ্গে আর কথা বলে কী লাভ!
কিন্তু মি সওজের সঙ্গে এরিয়া অফ কমননেস বেশি থাকায়; বিশ্বায়নের অভিঘাতে আমরা দুজনেই বিশ্বনাগরিক হওয়ায়; তার সঙ্গে রিলেট করা যায়। কয়েক বছর আগে “সিপি গ্যাং সাইবার বুলি করে নারী অবমাননা করছে যত্রতত্র”; এই অভিযোগ করে মি জয়কে একটা ইমেইল পাঠানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে উনি ব্যবস্থা নেন। ফলে তাকে পছন্দ করার পেছনে এই একটি কারণই যথেষ্ট। ই-গভর্ন্যান্স ব্যাপারটা চর্চার আগ্রহ ধরা পড়ে ইমেইল পেয়ে সমস্যার সমাধানের দৃষ্টান্ত দেখে।
সেই ভালো অভিজ্ঞতার কারণেই উনার সঙ্গে ‘বন্ধুত্বের’ কথা বলে সেই ক্ষমতার জোরে যারা অত্যন্ত সুচিন্তার সঙ্গে সাধারণ নাগরিকদের সমালোচনায় তেতে যত্রতত্র মানুষকে “রাজাকার-বিএনপি-পাকিস্তানে চইলা যাও” টাইপের আপত্তিজনক কথা বলে; সেইসব উন্নয়নের ধারাপাত আর চুলে জেল দেয়া ক্ষমতার খোকন সোনাদের পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা বার্তা ওভার লুক করেছি। ভেবেছি, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের কারণে মি সওজ দেশের বাইরে বড় হওয়ায়; এমেরিকায় কফি খেতে খেতে যারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে; তারাই যে দেশের মিডিয়াতে এসে হাম্বিতাম্বি করছে; আর এরা যে থাগস অফ বেঙ্গল, তা জয়ের বোঝার কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণেই চুলের সিঁথি আর হা করা দেখলেই আমরা যেমন থাগস চিনতে পারি; এটা মি জয়ের পক্ষে সম্ভব নয়।
মি জয় সিনিয়র সাংবাদিক মুন্নী সাহার কাছে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, আমরা দুই ভাই বোন পড়ালেখা শিখেছি। আমরা নিজেরাই উপার্জন করে সৎ ভাবে চলতে পারি।সেইখানে সাম্প্রতিক ফাঁস হওয়া টেলিকথনে “জয়ের প্রজেক্ট” নিয়ে আলোচনা নিঃসন্দেহে মি জয়ের এতোদিন ধরে গড়ে তোলা সততার ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এর আগে জয় একবার ক্ল্যারিফাই করেছিলেন, তিনি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। এই ক্ল্যারিফিকেশান তার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়িয়েছিলো।
সুতরাং বানিজ্য উপদেষ্টা ফোনে আইনমন্ত্রীকে “যে জয়ের প্রজেক্টের” কথা বললেন; সেখানে “প্রচলিত আইন না মেনে”, “জয়ের প্রজেক্ট” বলে প্রাধিকার বা এনটাইটেলমেন্ট দাবী করার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। সঠিক তথ্য প্রবাহ না থাকলে গুজব জন্ম নেয় সেই তথ্যহীনতার অন্ধকার থেকে। তাই এই টেলিফোন কথোপকথনের একটি ক্ল্যারিফিকেশান জনগণের প্রাধিকার ও তথ্য জানার অধিকার সংশ্লিষ্ট। কাজেই এই ফাঁস হওয়া টেলিকথনের ব্যাপারে একটি সরকারি ব্যাখ্যা প্রত্যাশা করছি। সবচেয়ে ভালো হয় সজীব ওয়াজেদ জয় বিষয়টি স্পষ্ট করে একটি ফেসবুক পোস্ট দিলে।