মাসকাওয়াথ আহসানঃ
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জুলাই বিপ্লবের কাল থেকে আজ অবধি বেশ ঝুঁকি নিয়ে পতিত ফ্যাসিস্টের সমালোচনা করে চলেছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নিয়েছেন; ফলে এই অভ্যুত্থানের স্পিরিট তিনি ধারণ করেন। তাই ৫ অগাস্টের পর এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কহীন যারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন; তাদের সঙ্গে প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনের পার্থক্য আছে। তিনি ছাত্রগণ অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেটের প্রেস সচিব। তাই তিনি দেশের অভ্যন্তরে পতিত ফ্যাসিস্টের কালচারাল সফট পাওয়ার ও ভারতের মিডিয়ার বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারের জবাব দিয়ে চলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।
এতে স্বাভাবিকভাবেই তিনি পতিত ফ্যাসিস্টের কোলাবরেটরদের টার্গেটে পরিণত হয়ে পড়েছেন।
সাড়ে পনেরো বছর ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ অনলাইনে সিপি গ্যাং-এর মাধ্যমে ভিন্নমত পোষণকারীদের ‘চ’ বর্গীয় গালাগাল, “রাজাকার” তকমা দিয়ে ও ভিন্নমত পোষণকারীর কন্যা-মা ও স্ত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে; কন্যা ও স্ত্রীর ছবি ফটোশপ করে অশালীন সাইবার প্রচারণা চালিয়েছে। এটাই আওয়ামী অপারেটিং মডেল; এনালগ আমলে এরা সুইপারকে টাকা দিয়ে ভিন্নমত পোষণকারীদের গৃহের দরোজার সামনে মল ঢেলে দিয়ে আসতে বলতো। যুবলীগের ছেলেদের দিয়ে ভিন্নমত পোষণকারীর কন্যা ও স্ত্রীকে উত্যক্ত করাতো।
ডিজিটাল জগতে সিপি গ্যাং-এর নোংরামি দেখে প্রথমদিকে আমরা ভেবেছিলাম, এরা বোধ হয় অতিউতসাহী। এদের সঙ্গে হাসিনা সরকারের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু একসময় ধরা পড়লো পলকের অধীনে থাকা তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে সিপি গ্যাং-কে হ্যাপি ওয়ার্কস নামে অনুদান দেয়া হতো। আবার সি আর আই-এর সঙ্গে জড়িত এক লোক ফেসবুকে এসে প্রকাশ্যে কমেন্ট সৈনিক জোগাড় করতো। সে লিখতো, কমেন্ট প্রতি দু’শো টাকা। এসব তথ্য মূলধারার মিডিয়াতেই এসে পড়েছিলো।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা নিজে খালেদা জিয়া সম্পর্কে অশ্রাব্য কথা বলে, জিয়া, তারেককে নিয়ে অশালীন কথা বলে, ড ইউনুসকে গালাগাল করে রীতিমত জাতীয় পর্যায়ে সিপি গ্যাং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করলেন। আমরা বুঝতে পারলাম শেখ হাসিনা নিজেই “গান্ধা কইরা দেয়া” মডেলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রচার করছেন। আর আওয়ামী লীগের কালচারাল সফট পাওয়ার ফতুয়া পরে মুখ টিপে হেসে, জামদানি পরে চোখে টিপ দিয়ে কুল কুল করে হেসে উঠছেন। সংবাদ সম্মেলনগুলোতে হাসিনার অশ্লীল গালাগালের প্রতিক্রিয়ায় গালে সুপোরি পুরে ঠোঁট টিপে হাসি; খুক খুক করে ওঠা; এসবই রেকর্ডেড রয়েছে।
৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গেলে এতিম হয়ে পড়া সিপি গ্যাং এটিম নামে আবার শুরু করে গান্ধা কইরা দেয়া প্রচারণা। ড ইউনুস ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের নিয়ে দিনরাত আপত্তিজনক কথাবার্তা বলেছে তারা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণীদের নিয়ে অশালীন ফটোশপ ও ‘চ’ বর্গীয় গালির ঝড় বইয়ে দিয়েছে লীগের এই চিলড্রেন অফ কলতলা। সবশেষে প্রেস সচিবের কন্যাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাইবার অপরাধীদের কার্যক্রম চোখে পড়লো। এই পিডোফেলিক কাজ সিপি গ্যাং তারেক রহমানের কন্যাকে নিয়েও করেছিলো। আশ্চর্যজনক হলেও লক্ষ্যণীয় এইসব পোস্টে আওয়ামী লীগ সমর্থক নারীরা এসেও হেসে লুটিয়ে পড়ে, কেউ কেউ ‘চ’ বর্গীয় গালি দেয়।
বাংলাদেশে ব্লগ ও ফেসবুক শুরুর সময় থেকেই যেহেতু এর দিকে লক্ষ্য রাখি; ফলে এটা খুব পরিষ্কার যে আওয়ামী লীগের খিস্তি কালচারটাই অনলাইনে খিস্তি কালচারের জন্ম দিয়েছে। এনালগ যুগে সিপি গ্যাং সদস্যরা পাবলিক টয়লেটের দেয়ালে অশ্লীল কথাবার্তা লিখে রাখতো। তারা যখন ব্লগ ও ফেসবুকের দেয়ালকে পাবলিক টয়লেটের দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে; তখন নতুন প্রজন্মের মাঝে চ বর্গীয় গালাগালি দেয়াটা ডালভাত হয়ে যায়। সামষ্টিক সমাজে স্ল্যাং বা খিস্তি জনপ্রিয়করণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জাতির যে উপকার করেছে; জাতি নিশ্চয়ই তা মনে রাখবে।
যে কোন বিষয়ের সমালোচনা স্বাভাবিকভাবেই করা যায়। চট করে নিম্নাংগের গালি দেয়ার পেছনে রয়েছে ব্যক্তির কর্কশ শৈশব, যৌন অবদমন, হতাশা, পর্ণাসক্তি, মাদকাসক্তিসহ বহুবিধ কারণ। এ আসলে মানসিক রোগ। আমাদের সমাজে মানসিক চিকিতসাকে অস্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। ফলে কর্কশ শৈশবে বেড়ে ওঠা লোকেরা ক্রমে বাই পোলার ডিজ অর্ডারের রোগী হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যেহেতু পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ অর্ডারকে হ্যাডম হিসেবে দেখে; ফলে এর কর্মী সংগ্রহে বাই পোলার ডিজ অর্ডারকে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়।
সিপি গ্যাং থেকে এটিম; ভিন্নমতের মানুষকে গালি দেয়া; তাদের স্ত্রী-কন্যাকে সাইবার বুলির পুরস্কার হিসেবে খিস্তির নেতৃত্বদানকারীদের ভিডিও কলে শেখ হাসিনা নিজে সাবাসি দেন। অনেকসময় বামদলের অত্যন্ত রুচিশীল নেতা জন্মদিনের শুভেচ্ছা দেন খিস্তিবীরকে। এই মোটামুটি নান্দনিক সংস্কৃতি ও অনান্দনিক খিস্তির অন্তঃরসায়ন।
আওয়ামী লীগের বাইরে যারা অনলাইনে গালাগাল করে, তাদেরকে দ্রুততার সঙ্গে মানসিক চিকিতসকের কাছে কাউন্সেলিং নিতে হবে। কারো মা তুলে গালি দেয়া মানে ঐ খিস্তিকারী ব্যক্তির মধ্যে ইডিপাস কমপ্লেক্স আছে; কারো কন্যা তুলে গালি দেয়া মানে ঐ খিস্তিকারী ব্যক্তির মাঝে ইলেকট্রা কমপ্লেক্স আছে। ফটোশপ করে নারীর ছবিকে অশালীন করে তোলার ইচ্ছা হলে বুঝতে হবে; যৌন অবদমনজনিত বিকৃতি তৈরি হয়েছে। এরকম লোক চিকিতসা ছাড়া স্বাভাবিক জীবন যাপন অসম্ভব। যখন রস করতে গেলেই নিম্নাঙ্গের উপাঙ্গের নাম মনে আসবে , বুঝতে হবে ঐ ব্যক্তি এন্টি-সোশ্যাল ও নিঃসঙ্গ। সমাজে মেলামেশার ক্ষমতা সে হারিয়েছে। কথায় কথায় আদিরসে চলে যাওয়া মানে জীবনে যৌনতার অভাবে লোকটি ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠেছে। এসব লক্ষণ দেখা দিলে মানসিক ডাক্তারের কাছে পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কাউন্সেলিং ছাড়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এদের জন্য অসম্ভব।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।