মাসকাওয়াথ আহসানঃ
পুরুষ সংস্কার কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। পুরুষের যেসব সংস্কার তার শৈশবেই হবার কথা ছিলো; তা না হওয়াতে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সংস্কারের এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
১ নানাবয়সের পুরুষের মধ্যে যত্রতত্র “চ” বর্গীয় গালাগাল দেবার একটি প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে সে গালাগালের সঙ্গে মা-বোন যুক্ত করে অবাধ ইনসেস্টের প্রবণতা প্রকাশ করে অনেকেই। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কবি ও সাইবার সৈনিক সিপি গ্যাং থেকে ইসলামি চেতনার আলেম ও সাইবার সৈনিক বাঁশের কেল্লা গ্যাং নারী সমাজের প্রতি ক্রোধ প্রকাশে “বেশ্যা” অপশব্দটি ব্যবহার করে। এইসব অপরাধের প্রেক্ষিতে অপরাধী পুরুষদের সংশোধনের জন্য কারাগারে একটি বিশেষ সংশোধনমূলক সেল গঠনের পরামর্শ রাখা হয়েছে। এই অপরাধে তিন থেকে ছয় মাসের কারাসংযুক্তি, এক বছরের জন্য চাকরি প্রাপ্তির অনুপযুক্ততা ও বিবাহের ক্ষেত্রে দুই বছরের অনুপযুক্ততার শাস্তি প্রদানের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এসব অপরাধের প্রমাণ হিসেবে অডিও-ভিডিও ও সোশ্যাল মিডিয়ার স্ক্রিনশট গ্রাহ্য হবে।
২ পথে-ঘাটে, যানবাহনে, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ও অফিসে, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নারীর দিকে হা করে তাকিয়ে থেকে তার দেহসৌষ্ঠব পরিমাপের বদ-অভ্যাস রয়েছে কিছু পুরুষের। এই বদ অভ্যাস কাটাতে শৈশব থেকে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ আচরণবিধি শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোন পুরুষ হা করে তাকিয়ে থাকলে নারী সরাসরি তাকে চ্যালেঞ্জ করার পরামর্শ রাখা হয়েছে।
৩ পুরুষ সমাজ বিভিন্ন রকম রুপকথার গল্প বলে থাকে যে, নারী তার পিতা-স্বামী ও ছেলের কাছ থেকে সম্পদ অর্জন করে। পুরুষ সমাজকে এই গালগল্প বাদ দিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন নারীর ভূমির মালিকানা এতো কম। কেন পুরুষই বেশিরভাগ ভূমির মালিক। তাকে প্রদর্শন করতে হবে, তার মা-স্ত্রী ও কন্যার জন্য রুপকথায় উল্লেখ করা সম্পদ কোথায়! নারীকে তার প্রাপ্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার দায়ে ও রুপকথার গল্প বলে আবহমান কাল ধরে ধোঁকা দেয়ার কারণে কেন পুরুষ শাস্তির আওতায় আসবে না তার কারণ দর্শাতে হবে।
৪ গোটা পৃথিবীর পুরুষ যখন জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণার মাধ্যমে সভ্যতার জন্য নতুন নতুন উপহার উদ্ভাবন করে; আমাদের সমাজের পুরুষ তখন ব্যস্ত থাকে নারী বিষয়ক গবেষণায়। নারী পোশাক ও নারীর চলন-বলন নিয়ে গবেষণা করে সময় নষ্ট করে যারা; তাদের নিজেদের পোশাক ও চলন-বলন পরিমাপের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সমুদ্র সৈকতে শর্টস পরা স্বামীর সঙ্গে হিজাব পরা স্ত্রী দেখা গেলে; ঐ পুরুষকেও হিজাব পরতে বাধ্য করতে হবে। ঐরকম বেপর্দা পুরুষ সমুদ্র সৈকতে ঘুরলে তা নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝেই নানারকম ভাব ও আইডিয়ার উদয় করতে পারে। নারী পোশাক নিয়ে পুরুষের ভাবনা চিন্তা ও পুলিশি নিষিদ্ধ করতে হবে। যেসব ইসলামি চেতনার হুজুর নারীকে হিজাব পরতে বাধ্য করে; তাদের হিজাব পরতে বাধ্য করতে হবে। সেসব সেকুলার চেতনার পুরুষ নারীকে স্কার্ট কিংবা পেট-পিঠ উন্মোচিত শাড়ি পরতে প্রলুব্ধ করে; তাদের স্কার্ট ও লোমশ পেট-পিঠ উন্মুক্ত শাড়ি পরতে বাধ্য করতে হবে। এই বর্ণনার অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে, নারীর পোশাক তার ইচ্ছার স্বাধীনতা। সে নিজেই ঠিক করবে সে কোন পোশাক পরবে, কিভাবে চলবে। এ ব্যাপারে পুরুষের নাক গলানোকে অনধিকার চর্চা হিসেবে বিবেচনা করে এই অপচর্চাকারী পুরুষকে সমাজে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে হবে।
৫ এই যে আমরা জন্মের পর থেকে আমরা শুনছি, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসিত করে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে। অথচ লালসার লালামাখা লম্পট পুরুষদের যৌনতৃষ্ণার কোন শেষ নেই। এরকম চাহিদা সম্পন্ন পুরুষ আছে জন্য তার যোগান হিসেবে সমাজে যৌন কর্মী আছে। সেই যৌনকর্মীরা পার্টির মাস্তান, পুলিশ ও পাশবিক পুরুষের সতত নির্যাতনে লীন। অথচ তাদের জন্য কোন আইনি রক্ষাকবচ নেই। সেই কল্পিত পুনর্বাসন ও মূলধারায় নিয়ে আসা সুদূর পরাহত। তাই তাদের জন্য আইনি রক্ষা কবচ অত্যন্ত জরুরি। এইক্ষেত্রে যে বিরাট সাধু ও বিশুদ্ধ পুরুষ এসে বলে, এভাবে সমাজটাকে নষ্ট করার মানে হয় না; তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে ধনী-গরীবের ব্যবধানের চেয়ে বেশি নষ্ট ব্যাপার এ সমাজে আর কোনটা। ঐ ব্যবধান না থাকলে আর কোন অনাহারী নারীর দুটো ভাত-কাপড়ের জন্য ঐ কষ্টের জীবন বেছে নিতে হবে না।
৬ যে সব পুরুষ বলে নারীদের কাজ করার দরকার নাই; তারা ঘরের শোভা; ঐসব পুরুষের আয়ের উতস সম্পর্কে দুদকের মাধ্যমে খোঁজ খবর নিয়ে অবৈধ আয় পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড নারী শ্রম। সতভাবে জীবন যাপনে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পেশাজীবী হওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে দেশের সব পুরুষের সংসার পাগলা মসজিদের দান খয়রাত বাক্স, হাসিনার খাসজমি, প্রণয় নিকেতনের মাসহরা দিয়ে চলে না। সব পুরুষের অতো রসের জীবন নাই যে হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে আশেকদের বাড়ির জেয়াফত খেয়ে চর্বি জমাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বে সর্বত্র নারী শিক্ষা গ্রহণ করে; ব্যবসা বানিজ্য করে, বিভিন্ন অফিসে কাজ করে। কায়রো, ইস্তাম্বুল, কাতার, দোহা, কুয়ালালামপুর, জাকার্তা এসব জনপদের ঐতিহ্যবাহী আলেম সমাজ নারী সমাজের বিকাশকে উতসাহিত করতে পারলে বাংলাদেশে তার অন্যথা হবে কেন! মহানবী মুহাম্মদ (দঃ)-এর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাঃ), প্রথম মুসলমান নারী; তিনি ছিলেন একজন স্বাবলম্বী ব্যবসা উদ্যোক্তা। সেই আত্মনির্ভর নারীর জীবনের অনুপ্রেরণায় আরব বিশ্বের নারীরা আজ স্বনির্ভর, শিক্ষিত ও কর্মজীবী। একজন সৌদি নারী নভোযাত্রী মহাকাশ যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
৭ বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব ঘটিয়েছে নারী সমাজ। হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের ১৫ বছর পুরুষ সমাজ অনেক চেষ্টা করেছে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। নারী সমাজকে সম্পৃক্ত করতে না পারায় তা সফল হতে পারেনি। জুলাই বিপ্লবে যখনি নারী সক্রিয় হয়ে পথে নেমে এসেছে; জননী সাহসিকার বীরোচিত অংশ গ্রহণে রাজপথ হয়ে উঠেছে সাহসী মিছিল। ফ্যাসিস্ট প্রাণভয়ে পালিয়েছে। বাংলাদেশকে ভারতের ছায়া উপনিবেশের অসুর মুক্ত করে দ্বিতীয় জন্ম দিয়েছে জুলাইয়ের মায়েরা। মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশই সন্তানের জীবনকে আলোকিত ও সুখি করে। এই গভীর বোধ পুরুষ সমাজের মাঝে যত তাড়াতাড়ি জারিত হবে, তত দ্রুত বাংলাদেশ মা তার কাংক্ষিত সকাল উপহার দিতে পারবে।
(ছবিতে জুলাই বিপ্লবে নারীর সাহসী প্রতিরোধ)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।