মাসকাওয়াথ আহসানঃ
আজ অনেকদিন পর আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারের নায়ক Meursault-এর কথা মনে পড়ছে; যে বলছে, “My mother died today. Or maybe yesterday; I don’t know,” আজ আমার আব্বাকে হারানোর পঞ্চম বছর পূর্ণ হলো। এই একটা কষ্ট আমৃত্যু ভোগাবে আমাকে। গতকাল যখন আব্বার কথা ভাবছিলাম; সিনেমাটোগ্রাফির মতো শৈশবে তার হাতের কড়ে আঙ্গুল ধরে হাঁটার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছিলো অন্তর্চক্ষুর সামনে; হঠাতই শৈশবের বন্ধু লীন ঢাকা থেকে খবর দিলো পায়েল মামা নেই।
অবিশ্বাস্য এক শোকসংবাদ। পায়েল মণ্ডল, আম্মার মামাতো ভাই। ঈশ্বরদী-রাজশাহী হয়ে ঢাকায় যে’কজন মানুষ আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন; পায়েল মামা তাদের একজন।
শৈশবে ঈশ্বরদিতে রেলগেটের এপাশে তাদের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়িতে গেলে আনন্দের কলরোল পড়ে যেতো। বাড়ির লনে মুঘল আমলের মতো চারপায়াতে পায়েল মামার আব্বা খসরু নানা বসে থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কালক্রমে সুফি চিন্তায় আচ্ছন্ন, বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীন একজন মানুষ। আব্বার জন্য আরাম কেদারা আনা হতো। সেইখানে বসে দর্শনের নানা আলাপ হতো। পূর্ববঙ্গের জামাই আদর বিষয়টি আব্বা যেভাবে পেয়েছেন; তাতে তাকে সৌভাগ্যবান বলতে হবে। পায়েল মামা আমার ছোট ভাই রুবাইয়াতকে ঘাড়ে নিয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতেন তার পড়ার ঘরে। আম্মা অন্দরমহলে মামী ও মামাতো বোনদের সঙ্গে।

পায়েল মামা বেশ লাজুক ছিলেন, উনি আমার আব্বা দর্শনের শিক্ষক বলে তার সামনে সংকোচ বোধ করতেন। মাথা নীচু করে উনার ক্লাস করেছেন। আর আম্মা চশমা পরা সাহিত্যের শিক্ষক বলে বেশ ভয় পেতেন। আমাকে বলতেন, তুমি বাসায় একজন দর্শনের আর একজন সাহিত্যের শিক্ষক পেয়েছো। এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি হতে পারে।
পায়েল মামা যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়েন, তখন আমি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। লীন আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। পৃথিবীটা এতোটাই গোল যে লীন পায়েল মামার কাজিন। বুঝলাম উত্তরবঙ্গে কয়েকটি পরিবার বৈবাহিকসূত্রে আত্মীয়ের শাখা প্রশাখা রচনা করেছে। লীনের দাদা মি মাহতাব কুষ্টিয়ার খ্যাতিমান আইনজীবী ও রাজনীতিক ছিলেন।
পায়েল মামা রাজশাহীর বৃটিশ কাউন্সিলে বসে মৃদুস্বরে আমাকে কার্ল মার্কস বোঝালেন। বললেন, এইসব প্রাচীন সামন্ত সমাজ থেকে বেরিয়ে হ্যাভস নটের সঙ্গে মিশতে হবে; তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে হবে। তোমার নামই তো পাভেল। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাম্য সমাজের আকাঙ্ক্ষা।
এইচএসসি পাশ করে ঢাকায় এডমিশন টেস্ট দিতে এসে লীনের সঙ্গে ওর লালমাটিয়ার বাসায় গিয়ে দেখি, পায়েল মামা বসে। উনি জেমস জয়েসের আ পোট্রেট অফ দ্য আর্টিস্ট এজ আ ইয়াং ম্যান নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ লেকচার দিলেন। তারপর বললেন, সায়েন্সের ছাত্র বলেই ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে কেন! তোমার তো আব্বা-আম্মা কিংবা ছোট ভাইয়ের দায়িত্ব নিতে হবে না। এফলুয়েন্সকে কাজে লাগাতে তোমার লেখক হওয়া উচিত। বাবার কাছে দর্শন শিখেছো; মায়ের কাছে সাহিত্য শিখেছো; সুতরাং ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ো। শেক্সপিয়ারের নাটকের শিশু সংস্করণ থেকে অনেক কিছু তো শৈশবেই পড়ে ফেলেছো। এখন জেমস জয়েস, আলবেয়ার কামু, ফ্রাঞ্জয কাফকা এসব পড়তে হবে। আমি তখন একটা উপন্যাস লিখছিলাম। পাণ্ডুলিপি দেখে বললেন, তোমার স্টোরি টেলিং খুবই ভালো; কিন্তু ভাষায় বংকিমের প্রভাব দেখছি। মনে রাখবে ভাষা পরিবর্তনশীল; প্রতিদিনের ভাষায় লিখতে হবে।
আব্বা-আম্মাকে গিয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার প্রস্তাব দিতে ভয় পাচ্ছিলাম। পায়েল মামা অভয় দিলেন, আমি তোমার সঙ্গে যাবো। শ্যালেতে বসে পায়েল মামা মাত্র দুই পাত্র খুশিজল পান করলেন অন দ্য রকস। আমাকে বললেন স্প্রাইট পান করতে। লীন একটু এডভান্সড লেভেলের ছাত্র হওয়ায় একপাত্র খুশিজল পান করলো।
আমরা ঈশ্বরদীর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। লীন আমার আব্বা-আম্মার সামনে এই এডভেঞ্চারে রাজি না হওয়ায় ঢাকাতেই রয়ে গেলো।
ঈশ্বরদী কলেজ পাড়ার দ্যুতি-অরণীতে প্রবেশ করে পায়েল মামা নার্ভাস হয়ে গেলেন। আমি দর্শনের একটা আলাপ তোলার পর; আব্বা একটু আলোচনা করলেন। কিন্তু পায়েল মামা আমার কাংক্ষিত পারফরমেন্স দেখাতে পারলেন না। আম্মা ততক্ষণে বুঝে গেছেন কোন একটি উদ্দেশ্য আছে আমাদের আগমনের। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন আমাকে কি ব্যাপার। আমি খুলে বললাম যে ইংরেজি সাহিত্যে পড়তে চাই; ইঞ্জিনিয়ার হয়ে লাভ নেই; এদেশে গবেষণার সুযোগ কম। আম্মা এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। তখন আম্মা আব্বাকে জানালেন আমাদের আগমনের হেতু। আব্বা একটু সিরিয়াস হয়ে গেলেন। পায়েল মামা তখন বললেন, দুলাভাই আপনি যে লাক্সারি থেকে দর্শন পড়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে; ঐ লাক্সারি থেকে পাভেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার কথা। আর ইংরেজিতে পড়লে ক্যারিয়ারের অনেকগুলো দরোজা খোলা থাকে।
আব্বাকে কেউ যুক্তিতে হারিয়ে দিলে উনি তা মেনে নেন। ফলে আমাদের মিশন একমপ্লিশড হলো। এরি মাঝে পায়েল মামার কাছ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের অনেক রেফারেন্স বুক আমি পেয়ে গেছি। এইভাবে উনি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে আমি লেখক হই। ভোরের কাগজে বিষণ্ণতার শহর ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হলে; নিজের কর্পোরেট অফিসের ব্যস্ততা একপাশে রেখে আগারগাঁও-এ জাতীয় বেতার ভবনে আমার দপ্তরে এসে বলেন, ফ্র্যাগমেন্টেড ভিশনের লেখা হিসেবে এটা দাঁড়িয়ে গেছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসে আমার মৃত্যুর শহর উপন্যাস কিনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে থাকেন। মন্তব্য করেন, আজকের ভাষায় লেখা। কার্যোপলক্ষ্যে আমি ইউরোপে গেলেও উনি ফোন করতেন। লেখালেখির খোঁজ নিতেন। বইমেলায় আমার প্রকাশিত হতে থাকা উপন্যাস সংগ্রহ করতেন। দেশে ফিরলে বইমেলায় প্রকাশিত আমার ইংরেজি গল্পগ্রন্থ মঙ্গা ক্যারাভান কিনতে বইমেলায় আসেন। সুহরোয়ার্দি উদ্যানে কথা সাহিত্যিক সুমন ভাই আর এনায়েত ভাইকে সঙ্গে নিয়ে আড্ডা দেন।
আবার দেশান্তরী হলে পায়েল মামা ফোন করে লেখালেখির খবর নিতে শুরু করেন। লেখালেখির বাঁক বদল করে পলিটিক্যাল স্যাটায়ারে যাওয়ায় প্রশংসা করেন, লেখককে সময়ের প্রয়োজনে ফর্ম বদলাতে হয়; ঠিকই আছে। ৫ অগাস্টের পর পায়েল মামার কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের বন্ধুরা আমার পলিটিক্যাল স্যাটায়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে; উনি তাদের বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পরিবারের যে রক্ত ও ত্যাগ; সেখানে পাভেলকে কেন চেতনার পরীক্ষা দিতে হবে! পায়েল মামা আমাকে ফোন করে হতাশা প্রকাশ করেন, শিল্প-সাহিত্যের মানুষের ঔদার্য্য না থাকলে হয় নাকি! ৫ অগাস্টের অভ্যুত্থানের পর এতো অনুতাপহীন হয় কি করে তারা!
পায়েল মামা তিক্ততা একদম পছন্দ করতেন না। আমার ধারণা যাদের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা করে বেড়ে উঠেছেন; তাদের স্থূল সৌন্দর্য্য ধারক, শাসক-শোষক-পরিতোষক-বিদূষক হতে দেখে গভীর দুঃখ পেয়েছেন। বন্ধুবান্ধব সারাজীবনের সঞ্চয়। বয়স হলে তারাই হয় সুখ-দুঃখের সঙ্গী। পায়েল মামা ক্যারিয়ারে সফল হওয়ায় কখনো দলান্ধতা ও আনুগত্য দেখিয়ে বেনিফিশিয়ারি হবার দলে ছিলেন না। উনার বাবা যেমন মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়াতে যাননি। দেশকে নিঃশর্তভাবে ভালো বেসেছেন খসরু ও পায়েল পিতা-পুত্র।
ইংরেজি ধ্রুপদী সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কাজ রেখে গেছেন তিনি। তার নিজের লেখা একাধিক গ্রন্থ রয়েছে । ফেসবুকে একের পর বাংলা অনুবাদ করে গেছেন। জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এর ১৮৬টি এপিসোড প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ কাজের মধ্যে ওরহান পামুকের My name is red, সিলভিয়া প্লাথের নোট সহ বেশ কয়েকজন বিশ্বনন্দিত লেখকের বই রয়েছে।
আমার আব্বা আর পায়েল মামার মিলের জায়গা এটা। দুজন দুটি ভঙ্গিতে একই কথা বলেছেন আমাকে। আব্বা বলেছিলেন, আমি তোমার আম্মার মতো ক্রিয়েটিভ রাইটার নই; আমি প্রবন্ধ লিখতে পারি বড় জোর। তাজমহল বানানোর সাধ্য আমার নেই; কিন্তু ইট দিয়ে হুবহু তাজমহলের মতো কিছু একটা বানাতে পারি। পায়েল আমাকে বলেছিলেন, তোমার মতো ফিকশন লেখার হাত আমার নেই। আমি বিশ্বসাহিত্যের হীরকখণ্ড তুলে এনে অনুবাদ করতে পারি। সেটা যে কতো বড় কাজ; তা আমরা বুঝি; যারা শৈশবে রুপের ডালিতে রাশিয়ার শিশু সাহিত্যের অনুবাদ পড়েছি। পায়েল মামার বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ একালের রুপের ডালি; যা পাঠকের সামনে তুলে ধরে হীরের নাকছাবি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।