“বীর শহীদেরা কবরে শুয়ে থাকে; আর অনন্তকাল ধরে ক্ষমতার আমারে চিনোস ধমক দিয়ে রাজত্ব করে দুধের মাছি ও বসন্তের কোকিলেরা।”
বইতে অনেকগুলো জায়গায় চোখ আটকে গেলেও এই সহীহ্ লাইনটা দিয়ে রিভিউ শুরু করছি। ক্ষমতায় যাবার পর ফেরেশতাও যে শয়তান হয়ে যায় সে গপ্পো আমরা বহু বছর ধরে শুনছি। কিন্তু সবচেয়ে করুণ ব্যাপার হচ্ছে যে কোনো একটা বিপ্লবে সম্মুখ সারিতে থাকা বীর-যোদ্ধারা একটা মটো নিয়ে বিপ্লব করে এবং বিপ্লবের ফসল ঘরে এনে যার যার কাজে ফিরে যায়৷ বিপ্লবের সময় ঘরে বসে ধরি মাছ না ছুঁই পানি করতে থাকা মাছিরা তারপর আনন্দ মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ‘চিনোস আমারে’ বলে খিস্তি খেউড় করে হামলে পড়ে অসহায়, সাধারণ নাগরিক শ্রেণীর উপর। বারেবারে যুদ্ধ হয়, বিপ্লব হয় কিন্তু আমরা যে সাম্যের রাষ্ট্র চাই সেটা আর কায়েম হয় না। ক্ষমতার দলাদলিতে পড়ে নিষ্পেষিত হয় সাধারণ মানুষ। তেলমাথায় আরো তেল দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় এলিট শ্রেণী।
বলছিলাম মাসকাওয়াথ আহসান’র ”স্যাটারিক ভার্সেস ফ্যাসিবাদ বিরোধী রম্য” বইটার কথা। বইটার বেশিরভাগ ছোট ছোট রম্যগুলো লেখা হয়েছে ৫ই অগাস্টের পরে। কিছু কিছু এর আগেরও আছে। চলমান বিভিন্ন ঘটনা যেমন শেখ হাসিনার ভারত পলায়ন, মন্ত্রী আমলাদের বেশভূষা বদল করে পলায়ন, শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙা, ফেসবুকের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মাজার ভাঙার প্রকল্প, তথাকথিত আফসোস লীগের ফেসবুক বিদ্রোহ, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হবার ঘটনা, বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের ফসল নিজেদের দাবি করার প্রচেষ্টা, কলকাতার টিভি চ্যানেলে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের লাফালাফির ঘটনা ইত্যাদি প্রায় প্রতিটা বিষয় নিয়ে এখানে রম্য এসেছে একাধিক!
তীব্র শ্লেষ আর কটাক্ষ করে লেখক প্রত্যেকটা চরিত্রকে নামে-অনামে তুলে এনেছেন। পড়তে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম কিছু কিছু জায়গায়, এতটা ডার্ক স্যাটায়ার দেখে। আমি তো আওয়ামী রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ততটা চিনি না, তাই লেখক যখন একেকটা চরিত্র হাজির করছিলেন তখন মুশকিলে পড়ে যাচ্ছিলাম এটা বুঝতে যে এবার কাকে কটাক্ষ করলেন!
বইটা পড়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক বুঝতে পেরেছি লেখক এখানে একক কোনো রাজনৈতিক দলকে কটাক্ষ করেননি। ওনার লেখায় বাংলাদেশের প্রথম সারিতে থাকা প্রতিটা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার অন্যায্য ফললাভের প্রচেষ্টার চিত্র ওঠে এসেছে। লেখক নিজের অভিজ্ঞতায় তো জানেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে, এদের ক্ষমতা হাতবদল হয় কিন্তু স্বভাব-চরিত্র সেই সহমত আর চোরাই লেভেলেই আটকে থাকে। তাই প্রতিটি ছোট ছোট প্রবন্ধে লেখকের অভিজ্ঞতার একটা বড় অংশের ভাবনা চলে এসেছে।
বইটা নেওয়ার আগে আমি ভেবেছিলাম দু’চার লাইনের কবিতা টাইপের কোনো রম্য হবে। কিন্তু পড়ার সময় দেখলাম ছোট ছোট প্রবন্ধ টাইপের রম্য। ফেসবুকের কল্যাণে লেখার বিষয়গুলো আমাদের সবার-ই প্রায় জানা, বিশেষ করে যারা ফেসবুকের সব বিষয় শেয়ার করে, তারা তো জানবেই।
আমি মনে করি লেখকের লেখার ধাঁচটা চেখে দেখার জন্য একজন পাঠকের এই বইটা পড়া উচিত৷ আমার মনে পড়ছে আমি এরকম রম্য পড়েছিলাম বোধহয় আবুল মনসুর আহমেদের ‘আয়না’, ‘ফুড কনফারেন্স’ বইতে। কিন্তু বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পড়তে গেলে মাসকাওয়াথ আহসান এর এই লেখাগুলো অন্য একটা ফ্লেভার দিবে পাঠকের মননে।
পাঠক চিন্তার খোরাক পাবেন এত ভালো বাক্য বিন্যাস, বিশেষ করে বাংলা-ইংরেজি-স্ল্যাং প্রভৃতির মিশ্রণে বেশ আধুনিক লেখা মনে হবে এগুলোকে।
কিছু জায়গায় হাসির উদ্রেকও হতে পারে।
এক নজরে:
বই: স্যাটারিক ভার্সেস ফ্যাসিবাদ বিরোধী রম্য
লেখক: Maskwaith Ahsan
জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
মলাট মূল্য: ২৮০
পৃষ্ঠা : ১১১
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২৫