মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ভার্চুয়াল আর ভূমি বাস্তবতার বন্ধুত্ব; এই দুই’ই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। ফলে ঈদ কাটলো এই দুই জগতের বন্ধুদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। চাঁন রাতে বাসার সামনে ঢোল-বাদ্য বাজাচ্ছিলো পাড়ার ছেলেরা। এরা রোজার পুরোটা মাস ঢোল বাজিয়ে সেহরিতে ঘুম ভাঙ্গিয়েছে; তারাবির নামাজের আগে ঢোল-বাদ্যের ছন্দে আহবান জানিয়েছে। এই ঢোল-বাদ্য সারাবছরই থাকে। শৈশবে এই ঢোল বাদ্যের শব্দ ঈদের কাফেলাতে শুনেছি; পুজোর সময় শুনেছি। ঢোলের বোল একইরকম। দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি সুর ও ছন্দের মাঝ দিয়ে সম্পর্কিত।
চান রাতে প্রথম হোয়াটস এপে ঈদ মোবারক জানান কলকাতা থেকে লেখক ও সংগঠক পিনাকী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি কভিডকালে কলকাতায় প্রথম ভার্চুয়াল লিট ফেস্ট করলে; আমাকে আমন্ত্রণ জানান এই তিনদিনব্যাপী লিটফেস্ট হোস্ট করতে। সেই থেকে আমরা ভার্চুয়াল বন্ধুত্বে এমনি কাছাকাছি রয়েছি। দ্বিতীয় ঈদ মোবারকটি জানান হিন্দুস্তানী ক্লাসিকাল সংগীতের সাধক শিল্পী সানি জোবায়ের। ঢাকার এই শিল্পী ভারতে কিংবদন্তীর সব শিল্পীদের কাছে তালিম নিয়েছেন। এখন ক্যানাডায় বসবাস করেন। তৃতীয় ঈদ মোবারকটি আসে দিল্লির বান্ধবী সুনন্দা রাওয়ের কাছ থেকে। সে সাংবাদিক ও অপেরা শিল্পী; ডয়চেয়েভেলের সাবেক সহকর্মী। এরপর ঈদ মোবারক জানান পাকিস্তানের কবি ও পরিবেশ কর্মী তারেক আলেক্সান্ডার। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম; ভার্চুয়াল জগতে ভূগোলের কাটাকুটির ঝামেলা নেই। সুতরাং রেডক্লিফের পেন্সিলের আঙ্গুলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে মনের ভূগোলে। আম্মার সঙ্গে দুইঘন্টা টেলিফোনে আড্ডা দিয়ে ঈদের জন্য একটা ফুরফুরে আনন্দের মন তৈরি হয়ে গেলো।
ভারতে রাজস্থানে ঈদের জামাতে পুষ্পবর্ষণ করছিলেন হিন্দুরা। ঈদের জামাতের পাশে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের শরবত পরিবেশন করছিলেন হিন্দু নারী। পাকিস্তানের সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশে ঈদের শোভাযাত্রা হলো গান বাদ্যে। বেলুচিস্তান ও খায়বারপাখতুন খোয়াতে রঙ্গিন ঈদ মেলা চলছিলো। করাচিতে আরব সাগরের কোল ঘেঁষে ঈদ উতসব আর ব্যান্ড মিউজিকের ঐকতান। বাংলাদেশে অনেক বছর পর খুব রঙ্গিন একটি ঈদ শোভাযাত্রা হলো। ঢাকা থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগামী মানুষেরা ব্যবস্থাপনার গুনে ট্রেনে ও বাসে আনন্দে গৃহমুখী হলো।
ঈদের দিন দুপুরে আমার পার্টনারের মায়ের দাওয়াতে গেলাম। সেখানে একদল জেন জি ঘিরে ধরলো, বাংলাদেশের জেনজি’দের কালার রেভোলিউশান সম্পর্কে জানতে। কেন পাকিস্তানের জেনজিরা সেনা-ফ্যাসিজমকে সরাতে পারছে না! বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অন্য একটি দেশের জেনজি’দের কি করা উচিত তা বলা আইনানুগ নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যেভাবে বলি ঠিক সেভাবে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী মুক্তিযুদ্ধে পূর্ববঙ্গের বা বাংলাদেশের তরুণদের অসম সাহসিকতার গল্প বললাম। আমি ওদের বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভগত সিং ও সীমান্ত গান্ধীর সংগ্রামশীলতার ইতিহাস পাঠ করার অনুরোধ করলাম। আর এফলুয়েন্সের কমফোর্ট জোন থেকে বেরিয়ে মুগ্ধ কি করে জুলাই মুক্তির নায়ক হয়ে উঠলো সে গল্প করলাম।
সেই ঈদ পার্টিতেই দেখা হলো, করাচির মোহাট্টা প্যালেসের সামনে প্রতিবছর বিশাল কাব্য আসর আয়োজনকারী মোবাশ্বেরের সঙ্গে। সরকার কিংবা প্রাইভেট সেক্টরের কোন আর্থিক সাহায্য না নিয়ে পাঁচজন বন্ধু কবিতাকে জনপ্রিয় করতে এই আয়োজন করে চলেছে বছরের পর বছর; সেই গল্প শুনলাম।
এক ফাঁকে বসে একটু দাবা খেললাম জেনজি’দের সঙ্গে। আমি সুযোগ পেলে তরুণদের সঙ্গে দাবা খেলি; ঈদের দিনেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কি করে। আর খুব নিয়ম করে ছেলে মিদ্রাহ’র সঙ্গে লম্বা আড্ডা দিই। এই জেনারেশনটা আমাদের বাবার জেনারেশনের কথা মনে করিয়ে দেয়। যারা সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং-এর লোক ছিলেন। আনন্দভূক ছিলেন। নির্বোধ ইঁদুর দৌড়ের বাইরের মানুষ ছিলেন। আমরা মাঝখানের জেনেক্স ও মিলেনিয়ালদের একটি অংশ সেই কনফিউজড প্রজন্ম; যারা বুঝতেও পারলো না; জীবন আসলে শিল্প; যেখানে মুড ইজ দ্য কিং।
আমি সবসময়েই সামাজিক মানুষ; ফলে করাচিতেও ঈদে অনেক নেমন্তন্ন। যে বন্ধুরা সারাবছর আমাকে মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকার বেদনা ভুলে থাকতে নানা আনন্দের আয়োজন করে; তাদের দাওয়াত রক্ষা আমারও দায়িত্ব। আর আমি দাওয়াত করি প্রতি ঈদের ছুটি শেষ হলে; কর্মস্থলে যোগ দেবার পর আসা প্রথম উইকেন্ডে। ঈদের ছুটি ফুরিয়ে যাবার নীল বেদনা ভোলাতে।
মাঝ বয়সে তিন দিন ব্যাপী ম্যারাথন দাওয়াত খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকে এসে বন্ধুদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। এই আরশীনগরের বন্ধুদের নাম ও ছবি মুখস্থ করি আমি। কারণ পৃথিবীর প্রতিটি সম্পর্ক সমান গুরুত্বপূর্ণ। একটু আগে ঈদের একটা ছবি আপলোড করায় ইনবক্সে কয়েকজন বন্ধু জানতে চেয়েছে, আমি ঢাকায় কিনা! এই যে রিফ্লেক্স; এটাই বন্ধুত্ব।
বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে তিক্ত অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যাওয়ায়; মাঝে মাঝে বেশ কিছু তেতো লেখা লিখতে হয়। বন্ধুত্বের সত্ত্বাকে লুকিয়ে বিতার্কিক সত্ত্বায় আবিভূর্ত হতে হয়। মাঝে মাঝে সেজন্য অনুতাপও হয়। শৈশবে একসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ানো অনুজপ্রতিম যখন ফোন করে বলে, পতিত শাসকের বেনিফিশিয়ারি না হয়েও তরুণ বয়স থেকে ছাত্রলীগ করায়; অজানা আশংকায় এবার নিজের শহরে ঈদ করতে যেতে পারেনি; শুনে মন খারাপ লাগে। বিভাজন ও বিদ্বেষের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের শাসনামলে তৈরি হয়েছে; ঐ ভাইরাস সভ্য সমাজ তৈরির পথে অন্তরায়।
নিজের যাপিত জীবনের সঙ্গে কক্ষণো কোন রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক হতে দিতে নেই। যে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকলেও যেন লাইফস্টাইলে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন না ঘটে; সেই চেষ্টাটা অবিরাম করতে হয়। আর এফলুয়েন্স লুকিয়ে রেখে যতটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়; ততোই কাছাকাছি যাওয়া যায় জীবনের সব হাঁটাপথের মানুষের। এমনকি রাম গোরুড়ের ছানার সঙ্গেও দেখা হলে যদি হাসি মুখে তাকে সম্ভাষণ জানানো যায়; ধীরে ধীরে তার মাঝ থেকে খেলনা অহংকার হারিয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে আসার সুযোগ থাকে।
ঈদে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ভুলে সৌহার্দ্য বিনিময় আসলে সাম্যের সভ্যতার শিক্ষা। যেন ধীরে ধীরে পশ্চাদপদ সামন্ত সমাজ বুঝতে পারে, বৃটিশ কুইনের নাতি-নাতনি তো সে নয়। দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিভিত্তিক সমাজের লোক সবাই। তাই অযথা এলিট ভং দেখিয়ে লাভ নাই। সৌম্য নিরহংকার কার্টিয়াস জীবন চর্যাই এভলভড মানুষের পরিচয়। ঈদের ছুটির পর আমরা যেন ভুলে না যাই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।