মাসকাওয়াথ আহসানঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। নাৎসি নেতারা পালিয়ে যে যেখানে পারে চলে গেছে। খ্যাতিমান লেখক ও ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সমর্থক এজরা পাউন্ড গ্রেফতার হয়েছেন। জার্মানিতে হিটলারের সমর্থক লেখক-কবি-শিল্পীদের রামরাজত্বের সমাপ্তি ঘটেছে। ইতালির মুসোলিনি সমর্থক ফুটবলাররা পালিয়েছে দেশ ছেড়ে। জার্মানি ও ইতালিতে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট আমলের হোয়াইট টেলিফোন মুভিতে সাদা পোশাক, ম্যাচিং ব্যাগ, জুতো পরে যে নায়িকারা সাদা রং-এর ফোনে কথা বলতো নানা লাস্যে, ঠোঁটের ওপর তিল নাচিয়ে যারা দর্শককে বুঁদ করে রাখতো; যাতে তারা মুসোলিনির সরকার বার বার দরকার বলে রব তোলে; তারা বিমর্ষ হয়ে বলতে থাকে, এবারের মতো এমন বিমর্ষ কার্নিভাল আর আসেনি।
মুসোলিনির ছেলে যে চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন বের করে আঁতলামো করতো; তার ভাড়াটে লেখকেরা ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেষ্টা করে; ইতালির চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের অবসান ঘটেছে। ইতালির তরুণেরা তাদের কাউকে কাউকে রোম ও নেপলসের রাস্তায় ধরে চড় থাপ্পড় মেরে জামা ছিঁড়ে স্ট্রিপটিজ বয় বানিয়ে পুলিশের কাছে নিয়ে গেলে মুসোলিনির কালচারাল উইং ছ্যা ছ্যা করে।
এই যে ফ্যাসিস্টের গুলিতে এতো মানুষের প্রাণ গেছে; তাতে কোন অনুশোচনা নেই সোশ্যালাইট ফ্যাসিস্ট আন্টিদের। তারা ঠোঁট উলটে বলে, রুচিবোধ হারিয়ে গেছে ইতালির সমাজ থেকে। ইতালি এখন মবের মুল্লুক। এজরা পাউন্ড জেলে না থাকলে মব ও বিবিধ বেলুন নামে গল্প লিখতে পারতেন।
জার্মানির কার্নিভালে হিটলারের এফিজি প্রদর্শিত হলে হিটলারের “প্রশ্ন নয় প্রশংসা” করতে এসেছির আসরের সাংঘাতিকেরা ক্ষিপ্ত হয়। এই সাংঘতিকেরা জার্মান মিডিয়ায় বসে নিও নাৎসি পুনর্জাগরণের চেষ্টা করছে।
জার্মান সংস্কৃতি মন্ত্রী সরোয়ারস্টাইন এক সংবাদ সম্মেলনে হিটলারকে খুনি বললে, হিটলারের কালচারাল উইং-এর সাংবাদিক দীপ্ত স্পিয়েগেলের গোয়েমিজানেবলস আপত্তি জানায়, আদালতে কি প্রমাণ হয়েছে হিটলার খুনি! এতোগুলো খুন কি তিনি একাই করেছেন! আপনি এভাবে বলছেন কেন!
জার্মান সংস্কৃতি মন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জ তো এ সংক্রান্ত রিপোর্ট দিয়েছে। গোটা পৃথিবীর মিডিয়ায় অসংখ্য প্রতিবেদন রয়েছে। আপনি হোমওয়ার্ক করে তারপর কথা বলুন।
নাখখ্রিস্টেন আই-এর সাংবাদিক বলে, এভাবে কার্নিভালে হিটলারের এফিজি ঘোরালে রিকনসিলিয়েশন হবে কি করে!
মন্ত্রী বলেন, আগে তো মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার; তারপর রিকনসিলিয়েশন।
এটিএনওয়েলের সাংবাদিক বলে, আদালতে প্রমাণ হবার আগে আপনি হিটলারকে খুনি বলতে পারেন না।
জার্মান তরুণেরা হিটলারের হত্যাযজ্ঞ ডিনাই করার অভিযোগে ঐ তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মিছিল করে। হিটলারের পতনের পর দীপ্ত স্পিয়েগেলের প্রায় লালবাতি জ্বলে গিয়েছিলো। তাই ছেনালি করে তারা এই সুযোগে সংবাদ প্রচার বন্ধের ঘোষণা দেয়। হিটলারপ্রেমী গোয়েমিজানেবলকে বরখাস্ত করে। তাদের দেখাদেখি নাখখ্রিস্টেন আই ও এটিএনওয়েলের ঐ হিটলারপ্রেমী সাংবাদিকদ্বয়কে বরখাস্ত করে মিডিয়া হাউজগুলো।
অমনি এজরা পাউন্ড একটা খাঁচার মধ্যে বসে ছড়া কাটে, এ কেমন প্রেস ফ্রিডম, প্রশ্ন করলেই দেয় ডিম, এ কেমন স্বাধীনতা, কেটে দিচ্ছে মুক্তবাকের ফিতা! ছড়া শুনে হিটলারের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রমোদ বালিকারা তা তা থৈ থৈ বলে নাচতে থাকে।
প্রেস ফ্রিডম শব্দটা শুনেই কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটালকে কুরান ভেবে অন্ধভাবে যারা চর্চা করে সেই লিংকস পার্টির লোকেরা গাল ফুলিয়ে বলে, হিটলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো ফ্রিডম অফ স্পিচ হরণ; এখনো তা হলে আর এই পরিবর্তনে লাভ কি হলো। হিটলারের হাতে নির্যাতিত লিংকস পার্টির এটা স্টকহোম সিনড্রোম কিনা জানিনা; হিটলার পুনর্বাসনের এই প্রগলভ ফোর প্লের অংশ হয়ে পড়ে তাদের অনেকে। সেদিনই ঠিক হয়ে যায় জার্মানির রাজনীতিতে নিও নাৎসিরা ফিরে এলেও লিংকস পার্টির কোন ভবিষ্যত নেই। লিংকস পার্টি তোতাপাখির মতো বলতে থাকে, প্রশ্ন কখনো ভুল হয় না, ভুল হয় উত্তর।
বন ইউনির্ভাসিটির হিটলার চেয়ারের অধীনে স্কলারশিপ নিয়ে যারা এমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়েছিলো, তাদের একজন একাডেমিক পেপার লিখতে বসে যায়, সাংবাদিকতা মানেই প্রশ্ন করার স্বাধীনতা। প্রশ্ন যতই অপ্রিয় হোক তার জন্য কারো চাকরি যেতে পারেনা। আমি কর্নেলিয়া ইউনিভার্সিটিতে লব্ধ জ্ঞান থেকে এটা বলছি।
জার্মান তথ্যমন্ত্রী ফ্রিডরিশ মাহফুজসে তখন মিডিয়াকে বলেন, আমরা দীপ্ত স্পিয়েগেলের সংবাদ প্রচার বন্ধ করিনি।
সংস্কৃতি মন্ত্রী বিবৃতি দেন, কোন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতির সঙ্গে সরকারের কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু তাতে কি বিবিসি রাম ততক্ষণে খবর ছেপে ফেলেছে, জার্মানিতে বাক স্বাধীনতা ও প্রেস ফ্রিডমের ধস। প্রথম রাম ও স্টার রাম এ বিষয়ে নিবন্ধ লিখতে লোক লাগিয়ে দিয়েছে। দশ চক্রে ভগবান ভুত প্রমাণ করতে ডয়চেভেলে রামও লেগে পড়ে। চোখে কাজল দিয়ে নাতসি রমণী মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গায়, ফিরিয়ে দাও গোয়েমিজানেবলের বিশুদ্ধ চাকরি।
ভাবখানা এমন, নাৎসি পার্টি পুনর্বাসনমূলক বক্তব্যই বাকস্বাধীনতা ও প্রেস ফ্রিডমের সূচক। নিও নাৎসিরা তখন বিওর পান করে খুশিতে কুলু কুলু হয়ে বুন্ডেসলিগা ফুটবল দেখতে ডুসেলডরফ স্টেডিয়ামে যায়। সেখানে প্ল্যাকার্ড উঁচিয়ে তোলে, ইস লিবে ফ্রুয়েরার।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।