মাসকাওয়াথ আহসান
ধ্রুভ রাঠি নামে এক ক্ষুদ্র বালক নানার ঘরে আরেক নানার কালো কোট পরা ছবি দেখে জিজ্ঞেস করে, নানা ওটা কে!
নানা বুঝিয়ে বলে, তিনি আমাদের নেতা। আমরা তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি। তোমাকেও করতে হবে।
এরপর মামার ঘরের ড্রয়ারে সিলমোহর দেখে জিজ্ঞেস করে, মামা এটা কী! মামা সিল মেরে দেখায়। সভাপতি, মাসকেন্দো কলেজ ছাত্রলীগ।
ধ্রুভ বাবা-মা’র সঙ্গে রায় কাকার সাহিত্য-সংস্কৃতি আসরে গেলে, সেখানে লোকে পিন পিন করে রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত গায়। ধ্রুব’র মনটা পেলব ও কোমল হয়ে ওঠে।
ধ্রুভ তার মাকে জিজ্ঞেস করে, আমি কী বড় হয়ে গায়ক হতে পারি!
— না বাবা তোমাকে বিসিএস হতে হবে।
ধ্রুভ এরই মাঝে বুঝে ফেলে, তাকে প্রচন্ড প্রগতিশীল হতে হবে।
সে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা প্রগতিশীলতা কী!
–বড় হয়ে বারবার নৌকায় ভোট দেবে, তাহলেই প্রগতিশীল হবে।
ধ্রুভ তার বয়স আঠারো হলে প্রথমেই গিয়ে নৌকায় ভোট দেয়। প্রার্থী হেরে গেলে সে ফুঁস ফুঁস করে কাঁদে।
তার মামা তাকে বোঝায়, যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র করে নৌকাকে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। চারিদিকে চক্রান্ত চলছে, দেশটাকে মাথায় তুলে ওরা সাহারা মরুভূমিতে নিয়ে গিয়ে স্থাপন করবে!
ধ্রুভ “আমরা বনাম ওরা”-র প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়। বুঝতে পারে দেশটা একটা গন্ধমাদন পর্বত। একে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়।
নানা একদিন ডেকে বলে, ধ্রুভ পলিটিকস করে গরীব মানুষের ছেলেরা। বড় লোকের ছেলেরা পলিটিকস করতে গেলে পড়লেখাও হয়না আবার এমপি-মন্ত্রী হওয়াও হয়না। সুতরাং আই হেইট পলিটিকস হয়ে যা। শুধু ভোটটা দিবি নৌকায়!
ধ্রুভ’র মায়ের মুক্তিযোদ্ধা মামা বিশিষ্ট জাসদ, সে তাকে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করে। কিন্তু পঁই পঁই করে বলে দেয়, পলিটিকস করে আমার জীবন নষ্ট হয়েছে। সুতরাং বিদেশে চলে যাও। শুধু প্রগতিশীলতা ধরে রাখবে!
–প্রগতিশীলতা কী!
–মশালে ভোট দেবে, আর মশাল যদি নৌকার কোলে চড়ে তাহলে নৌকায় ভোট দেবে। কিন্তু নিয়ম করে রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত শুনবে।
ধ্রুভ ইউরোপে গিয়ে বিস্মিত হয়ে যায়, এইখানে এক দল এক দেশ এক নেতার কোন দেশ নাই। ভোট হয়; জনগণ জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে যোগ্যতা দেখে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয় মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। কোন দলীয় কোটা নেই। আর নাগরিক সমাজ, সরকারে যে দলই থাকুক তার কড়া সমালোচনা করে। তার আত্মীয় স্বজনের মত “আমরা বনাম ওরা” করে, আমরার অপরাধে কুলুপ এঁটে ওরার অপরাধে শতমুখ হয়না সমালোচনায়।
সভ্যতার শিক্ষায় ধ্রুভ ধীরে ধীরে গ্রামবাসী থেকে নাগরিক হয়ে ওঠে। ইউটিউবে শ্রীখণ্ডের উন্নয়নের সরকারের গুম, ক্রসফায়ার, জনমত ও মিডিয়ার টুটি চেপে ধরা আর দুর্নীতির সমালোচনা করতে শুরু।
ফোনে ধ্রুভ’র বাবা-মা বোঝায়, উনিই পারেন, উনিই পারবেন, উন্নয়নের সরকার বারবার দরকার। তুমি এসব বাদ দিয়ে শুধু এডুকেশন নিয়ে শো করো।
ধ্রভ’র ইউটিউব শো দেখে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যায় “চোরের খনি’র চাটার দল।” সরকারি গ্যাং চ-বর্গীয় গালির ডালা সাজায়।
উস্কানি রায়, কুঁচ কুঁচ করে বলে, ধ্রুভ যে ফরেনার বিয়ে করেছে, ইনুর সঙ্গে তার কিনুর সম্পর্ক!
পোকা খাওয়া দাঁত বের করে বেড রুম বিশেষজ্ঞরা তৈরি করে আকাশ কুসুম গল্প। ধ্রুভ চরিত্রহীন আর তারা ফেসবুকের রেললাইনের ধারে প্রাতঃক্রিয়া সমিতি অত্যন্ত সাধু ও সন্ন্যাসী।
অনেকে শুভাকাংক্ষী সেজে ইনবক্সে মেসেজ পাঠায়, ধ্রুভ, আজ হইতে আপনি চদ্ধা হারাইলেন। খুব মেধাবী ভাবছিলাম আপনেরে; কিন্তু একুন দেকতেছি আপনে দেশদ্রোহী!
চাঁদপুর কলেজ থেকে টেনেকষে বিকম পাশ রাজেশ বালটন ধ্রুভকে নিয়ে রগড় করে, সে আমৃকার দালাল। ডলারে ভাসতেছে।
আবার ধ্রুভ অসাম্প্রদায়িক ও ইনক্লুসিভ সংস্কৃতি নিয়ে শো করায়, হাট হাজারি মাদ্রাসা থেকে টেনে কষে কওমি পাশ করা কামান আবদুল্লাহ তাকে নাস্তেক ও শাহবাগী বলে তকমা দেয়।
সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট পাওয়া ধ্রুভকে প্রতিদিন সার্টিফিকেট দিতে থাকে আলফাডাংগা আমব্রেলা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পুটিমারি লাইলাতুল ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্বপ্রণোদিত সনদ প্রণেতারা।
এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে বাপ-দাদার থুতনিতে দাড়ি, চুলে টিকি, বউয়ের পরনে হিজাব, কপালে একগাদা সিঁদুরওয়ালা ধর্মীয় চিহ্ন প্রদর্শনকারীর ছেলে -নাতি ও স্বামী হঠাত জিনস ও টি-শার্ট পরে এসে ধ্রুভ’র পোগোতিচিলতার সনদ কেড়ে নেয়।
সে এদের বোঝাতে ব্যর্থ হয়, জামাত সমর্থিত বিএনপি আর বিজেপি সমর্থিত আওয়ামী লীগ; একইরকম ভ্যাড়ভেড়ে মৌলবাদ।
ধ্রুভ বিএনপির ২০০১-০৬ শাসনকালের সমালোচনা করলে সাফারি পরা লোক এসে তাকে আম্মি লীগের দালাল বলে। সে আওয়ামী লীগের ২০০৯-২৪ শাসনকালের সমালোচনা করলে কালো কোট পরা লোক এসে তাকে বিম্পির দালাল বলে।
ধ্রুভ কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারেনা, যোগ্যতা থাকলে কারো দল করে খেতে হয়না। জনস্বার্থে কথা বলাই দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব।
শ্রীখণ্ডে “কাঁদো বাঙালি কাঁদো”, আর “কাঁদো বাংলাদেশী কাঁদো” নামের যে দুটি লালসালু মাজার সংস্কৃতি; সেইখান থেকে জন্ম নেয়া খাদেম, বেনজির-বেয়াই; কোহিনূর-মামুন দেশ ডাকাতি করে শ্রীখণ্ডকে ঝাঁঝরা করে দেয়। অথচ নির্লজ্জ ও দলান্ধ খাদেমেরা কক্ষণো জনগণের পক্ষে দল নিরপেক্ষ অবস্থান কল্পনাও করতে পারে না।
ছাপড়ি থেকে দুর্নীতির টাকায় দালানে উঠেই জিদ ধরে, ধ্রুভ আন্নের অবস্থান পস্ট করুন।
শ্রীখণ্ডের লোকেরা এই যে ধ্রুভকে তার নিয়মিত বক্তব্য, দর্শন, স্বচ্ছ চিন্তার মাঝ দিয়ে এতোদিন ধরে জানে ও চেনে; তবু তারা অপেক্ষা করে সেই সকালের জন্য; যেদিন দলীয় লোক ধ্রুব’র দিকে গোবর ছুঁড়ে একটা ফেইক স্ক্যান্ডাল তৈরি করে ভাইরাল করলেই এসে চুক চুক করে বলবে,
–আগেই সন্দ করছিলাম একটা কিন্তু আছে; নাইলে একটা মানুষ এতোটা নিঃস্বার্থ আর ভালো হয় কী করে! গো ধ্রুব গো!
শ্রীখণ্ড এইভাবে হয়ে ওঠে ধ্রবতারার লাশকাটা ঘর!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।