মাসকাওয়াথ আহসান
একজন উপাচার্যের জীবন ” লাইফ অফ পাই” য়ের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ; এখানে জলে হেলমেট পরা কুমির আর ডাঙ্গায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রী বাঘ; প্রতিটি রাত নির্ঘুম কাটে; গতকাল কুমিরদের কতটা তুষ্ট করতে পেরেছি; আগামীকাল কোন বাঘ আবার নতুন আবদার নিয়ে আসে।
ভোরবেলা একটু ঘুম লেগে আসতেই বাংলোর বৈঠকখানায় কুমিরের আর্তনাদ আর বাঘের গর্জন কানে আসে। চাপরাশিকে বলা আছে, সবাইকে ছাছপছমুছা দিয়ে ওদের ক্ষিদে কমাতে। ওগুলো পেটে পড়লে আর্তনাদ ও গর্জন কমে এলে ভয়ে ভয়ে বৈঠকখানায় এসে দেঁতো হাসিতে তাদের আশ্বস্ত করতে হয়, মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক; আমি নৌকার লোক; আমার জীবন সেই লাইফ অফ পাই।
এভাবেই শুরু হয় গ্রন্থটির উপাচার্য জীবনের চালচিত্র। বর্ণনায়, বাক্যে, শব্দচয়নে একজন সমাজবিজ্ঞানীকে খুঁজে পাওয়া যায়; যিনি সমাজের হিংস্র জলে সাঁতার কাটেন ভয়ে ভয়ে আর পা টিপে টিপে ডাঙ্গায় হাঁটেন। তার খুব আকাংক্ষা ছিলো কেউ এসে একটু একাডেমিক বিষয় নিয়ে আলাপ করবে, কেউ এসে জার্নালে প্রকাশ হওয়া নতুন গবেষণা প্রবন্ধ দেখাবে। কিন্তু সবাই আসে পার্থিব চাওয়া নিয়ে; নতুন প্রকল্প পরিকল্পনা নিয়ে যেখানে নতুন দালান আর কমিশনের ইতিউতি, বাঘ ও কুমির উভয়কে তুষ্ট করে এক একটি প্রকল্প। আর ফাইল পড়ে থাকে রাশি রাশি; জানালার পর্দা, চেয়ার টেবিল, তোয়ালে কেনার দর বিশগুন বাড়িয়ে বিল, সেখানে স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য উন্মুখ বাঘেরা। কোন বিল নিয়ে প্রশ্ন করার কোন উপায় নেই; চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, আমরা আপনাকে প্যালা দিয়ে রেখেছি জন্যই আপনার চেয়ারটা এখনো ঝড়ে উড়ে যায়নি।
আছে তেলাঞ্জলিও আছে, গিরগিটিরা এসে তেলও দেয়; যারা সাধারণত চেয়ারটা চলে গেলে কনুইবাজি করে ছবির ফ্রেম থেকে বের করে দিয়ে শিবলিঙ্গের মতো ফুলের তোড়া হাতে নতুন উপাচার্যের সঙ্গে ছবি তোলে। এই গিরগিটিগুলো তাদের সরু কোমর নড়িয়ে এমন মাখো মাখো করে কথা বলতো যেন, স্ত্রীর চেয়েও বেশি শুভাকাংক্ষী তারা। এরপর পিন পিন করে তারা স্বজনপ্রীতির আলাপটা তুলতো; আর সেইসঙ্গে আমন্ত্রণ জানাতো কবিতা অথবা সংগীত অথবা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর সাঁঝে।
পৃথিবীর আর সব সমাজে যারা কবিতা করে, সংগীত করে, ছবি আঁকে; তারা সাধারণত সুন্দরের মানুষ হন; কিন্তু এই একটি সমাজ যেখানে কবি-গায়ক ও চিত্রকর গিরগিটির মতো রঙ বদলে হিংস্র পলিটিক্যাল ক্যাডার হয়ে যায়। অন্যায়কে সমর্থন করতে তাদের বিবেকে এতোটুকু বাধে না। পৃথিবীর সমস্ত সমাজ-মনোবিজ্ঞানের গবেষণা ফলকে এরা মিথ্যা করে দেয়। অবশ্য হিটলারও দুর্বল চিত্রশিল্পী ছিলো, মুসোলিনিও ফুটবল খেলতো, কিম জং উনও সংগীত প্রিয়, লুকাশেংকোও নৃত্য পছন্দ করে। কিন্তু তাদের বিদূষকেরা এমন গিরগিটি কলা জানে কী! সংস্কৃতি কর্মীকে ক্রসফায়ার সমর্থন করতে পৃথিবীর আর কোন সমাজে দেখিনি।
এমনো হতে পারে সেই যে উইনস্টোন চার্চিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলার চালগুলো বৃটিশ সেনাদের খাইয়ে দিয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছিলো; সেই যে ক্ষুধা; সেই ক্ষুধাই মৃত্যুক্ষুধা তৈরি করেছিলো এ অঞ্চলের মানুষের অবচেতনে। তারাই শার্ট-প্যান্ট পরে বাঘ-কুমির-গিরগিটির বেশে বিশ্ববিদ্যালয়টাকে; এরপর দেশটাকে খেয়ে ফেলতে চায়।
তাই তো মনোযোগ দিয়েছিলাম হলের খাবারে; ডালটা বুড়িগঙ্গার পানির মতো ছিলো; তাকে একটু ঘন করে জগন্নাথ ও শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের পানির মতো করেছি। খাক; ডাল দিয়ে গাপসিলাক; তাতেও যদি ক্ষুধা কমে। একটু পড়ালেখায় আর গবেষণায় মন দেয়।
এই যে বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় থাকতে না পারার গঞ্জনা সয়ে এতোগুলো বছর কাটালাম, কিন্তু কী করবো বলুন। একদল মাথায় হেলমেট পরে মন্ত্রী-এমপি হবার স্বপ্নে বিভোর আর এক দল মাথায় সর্ষের তেল দিয়ে বিসিএস গাইড পড়ে। স্বপ্নের দৈর্ঘ্য সংসদ ভবন আর সচিবালয় পর্যন্ত হলে; আমি কী করে গবেষণাগারে পাঠাবো তাদের।
এই যে যারা আমার কাছে চাকরি চাইতে আসতো, তারা তো আমাকেই গল্প শোনাতো, এমপি সাহেব এলাকার চারশো ছেলেকে চাকরি দিয়েছে, সচিব সাহেব এলাকার চারশো ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছে; আর আজকাল তো সরকারি দলের সহ-সভাপতিরাও চাকরি দেয়; আর আপনি চাকরি দিবেন না তা কী করে হয়! আমাকেই চাকরি দেবার প্রতিযোগিতায় ফেলে দিলো ওরা।
আমি যখন আমার সাবেক ছাত্রদের সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, পুলিশ, প্রশাসক, সংস্কৃতি-কর্মী হিসেবে বাতাবি লেবুর সুবাস মৌ মৌ টিভিতে মিথ্যা কথা বলতে দেখি, মানবতা বিরোধী অপরাধকে অন্ধভাবে সমর্থন করতে দেখি; মনে হয় আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো কী যুগে যুগে শুধুই কোলাবরেটর তৈরি করে! অমানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেই কী একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম।
“দ্য লাইফ অফ আ ভাইস চ্যান্সেলর” আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি এইভাবে যেন বিষাদসিন্ধু হয়ে ওঠে; কখনো যেন “মেঘনাদ বধ কাব্যে”-র দ্যোতনা একে বিষণ্ণ করে; কোথাও কোথাও চসারের “বেওউলফ” আখ্যানের চিত্রকল্প খুঁজে পাওয়া যায় ক্যাম্পাসের বর্ণনায়। গণরুমের ট্র্যাজেডি যেন মনে করিয়ে দেয় একাত্তরের বিভীষিকা অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের জীবন। কোথাও কোথাও যেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অসহায়ত্ব জায়নিস্টদের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনিদের কান্নার শব্দের মতো শোনায়।
সংবাদপত্র বন্ধের দাবীতে মানব বন্ধনে উপাচার্যের অংশগ্রহণ, অপরাজেয় বাংলার সামনে নোবেল পুরস্কার কমিটি আর বিশ্বের নোবেল বিজয়ীদের বিরুদ্ধে ফোঁসফোঁস শব্দে; আহমদ ছফার “গাভী বিত্তান্ত” যেন মূর্ত হয়ে ধরা দেয় পাঠকের মনে।
গ্রন্থের এক পর্যায়ে তাই তো আক্ষেপ শোনা যায়, ছফাকাল থেকে এ পর্যন্ত নাহয় গাভী বিত্তান্ত শুনলেন, এবার “ষাঁড় বিত্তান্ত” লেখার প্রস্তুতি নেন। কারণ উপাচার্য বলতে যে শান্ত চেহারা ভেসে ওঠে; এখানেই তার ইতি। এবার বলিবর্দ ষাঁড় যুগ শুরু হলো। এ যেন সেই ম্যাটাডোরের ষাঁড়; সাদা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, শিক্ষাবিদের ভেক; কিন্তু ভেতরে থিকথিকে রিরংসা; রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। হয়তো এবার উপাচার্যের ভাতের হোটেলে মাথা ফাটিয়ে দেয়া নিরীহ ছাত্রকে “ভাত খাইছো” বলে ভং করা হবে; আয়নাঘরে জিজ্ঞাসাবাদ হবে ভিন্নমতের ছাত্রদের। প্রশ্নহীন বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কারাগার নির্মাণের মহাযজ্ঞ এই শুরু হলো।
“দ্য লাইফ অফ আ ভাইস চ্যান্সেলর” যেন বিশ্বের বিদ্যা লয় বা বিনাশ প্রাপ্ত হবার গল্প; ফ্রানয কাফকার “মেটামরফসিস” গল্পের মতো ভীত সন্ত্রস্ত পোকা-মাকড়ের বসতির গল্প।
উপাচার্যের জীবনের ট্র্যাজেডি যেন সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলচ্চিত্র শিয়েন্ডলার’স লিস্টের মতো; যখন পুলিশের কাছে নিজের ছাত্রদের তালিকা দিতে হয়; কারা কারা বশ মানেনি, প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্ন করে! কারা কারা গোপাল ভিলেজের কালচার মেনে না নিয়ে গ্লোবাল ভিলেজের কালচার দাবী করেছে। এরকম পেডোফিলিক-ব্যবস্থার সাক্ষী গোপালই যে একজন উপাচার্য; যাকে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের মর্যাদা না দিয়ে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা সুপার কিংবা হরিদাসপুরের মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে দেখেন রণভবনের মালিক। অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানি প্রত্যাশা করেন মালিক; কথায় কথায় ডক্টর অফ লিটারেচার ডিগ্রি পেতে চান; কুমির চাষের জলমহাল চান, বাঘের বিচরণের জঙ্গল চান। এই যে এতোসব লোকজ চাওয়া; তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর মেট্রোপলিটান হয়ে ওঠা হয় না। হয়ে পড়ে নেহাত সার্টিফিকেট বিকিকিনির পাটগাঁতি বাজার অথবা পয়সার হাট।
মাঝখান থেকে সৌদি আরব আর হিন্দুস্তানের কালচারে ছেয়ে যায় এই একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। চারিদিকে হুক্কাহুয়া রবে এ যেন হয়ে ওঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ ফক্সফোর্ড। ছাত্র-শিক্ষকের মুখের ভাষা; আহা কী খাসা! মুসলিম ব্রাদারহুড আর রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের অপসাংস্কৃতিক দড়ি টানাটানিতে তৈরি হয় সেই রুচির দুর্ভিক্ষ; যে রুচির দুর্ভিক্ষ টের পেয়ে ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন।
“দ্য লাইফ অফ আ ভাইস চ্যান্সেলর” এর ট্রুথ, লাভ এন্ড আ লিটল ম্যালিসের সোনালি গড়ে যেন হয়ে ওঠে চারপাশের বাতিগুলো নিভে যাবার স্মারক। অপরাজেয় বাংলা যেন পরাজিত মেঘদলের মতো স্বপ্নভঙ্গের বেদনালীন হয়। স্বোপার্জিত স্বাধীনতাকে প্রায় ঢেকে দিয়ে উন্নয়নের মেট্রোরেল চলে যায়; যে কোন সময়ে বাংলাদেশের একমাত্র সার্বভৌম মুক্তাঞ্চল যেন ক্রমশঃ পলাশীর স্বপ্নহারা ধূসর প্রান্তর হয়ে ওঠে।
মনে হয় যেন দার্শনিক জিসি দেব কপালে হাতের তালু রেখে প্রখর রোদ আটকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন, ইটের পর ইট মাঝে সহমত কীট; নতুন প্রকল্পের রং-এর কড়া ঝাঁঝ, স্যুট-টাই পরা কয়েকটা বাঘ আর নক্সী পাঞ্জাবী পরা কুমীর। কয়েকটা গিরগিটি যেন ফতুয়া পরে ষড় ষড় শব্দ করে এদিক-ওদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আর সব স্তুতি, তেলাঞ্জলি থেমে গেলে মাথা নীচু করে হেঁটে যাচ্ছেন “দ্য লাইফ অফ আ ভাইস চ্যান্সেলর”। একটা ঠেলাগাড়িতে তার ধুলো-ঝুল পড়া বইগুলো। তিনি যেন ফিস ফিস করে বলেন, এবার আমার বই পড়ার ছুটি।
“সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।