মাসকাওয়াথ আহসানঃ
আধুনিকতা হচ্ছে সাম্য চিন্তা; প্রতিটি মানুষকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে শেখা। ইউরোপের কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে ধর্ম-গোত্র-অর্থনৈতিক সঙ্গতি নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদা উপভোগ করেন।
দক্ষিণ এশিয়াতেই একটু ফর্সা জামাকাপড় পরলে; কুঁড়ে ঘর থেকে দালানে উঠলে, গরুর গাড়ি থেকে যন্ত্রের গাড়িতে উঠলে, পেটে দুটো বিদ্যা পড়লে নাক কুঁচকে ঘুরতে শেখে একটি মহল।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আরো পিনপয়েন্ট করলে বঙ্গে এই নাক কুঁচকানোর রঙ্গটা অনেক বেশি। ভারত-পাকিস্তানের পাঞ্জাবের গম ক্ষেতগুলোতে এই উন্নাসিকতা আগে ছিলো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম সেই গ্রাম্য মোড়লের বা চেয়ারম্যানের ছেলে-মেয়ের অহংকার থেকে বেরিয়ে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
এই নাক কুঁচকানোর স্বভাবটা হিন্দু ধর্মের কাস্ট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছিলো। পরে বৃটিশ আমলে কলকাতায় বেঙ্গল রেনেসাঁর মাধ্যমে এই উন্নাসিকতাকে শিল্প-সাহিত্যে বিস্তৃত করা হয়। পূর্ববঙ্গে এই উন্নাসিকতা ব্যাপারটা একেবারেই ছিলো না। এর প্রচলন হয় বৃটিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারি পাওয়া নতুন বড়লোকদের মাধ্যমে। বেঙ্গল রেনেসাঁর দম্ভের সঙ্গে জমিদারির দাপট মিলিয়ে পূর্ব বঙ্গ হয়ে ওঠে উন্নাসিকতা প্রদর্শনের লীলাভূমি।
বেঙ্গল রেনেসাঁ নতুন কাল্পনিক উচ্চ বর্ণতা তৈরি করে; যেখানে গাত্রবর্ণ শ্যামল অথবা ঘন শ্যামল হলেও; বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্যাপ্টিজম নিয়ে কল্পনায় নতুন আর্য হয়ে ওঠা যায়। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর লোকেরা হিন্দুত্ববাদী ছিলেন। ফলে ইসলামোফোবিয়া তাদের মনোজগতে বাসা বাঁধে ইসলামোফোবিয়া শব্দটি তৈরি হবার আগেই।
ঢাকায় সংস্কৃতি সমাজটি হিন্দুত্ববাদি বেঙ্গল রেনেসাঁকে সভ্যতার চারুপাঠ বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ফলে দাড়ি টুপি মুসলমানদের ডিহিউম্যানাইজ করার প্রক্রিয়াটিই সেকুলারিজম হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। সমাজে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারির স্বপ্ন জারিত হওয়ায় দুটি টাকা হলে বা একটি সরকারি চেয়ার হলেই লোকে নিজেকে আপার কাস্ট ভাবতে শুরু করে। এরপর কিছু সংস্কৃতিও চাই তার। ফলে গান শিখতে গিয়ে, আবৃত্তি শিখতে গিয়ে, এমনকি বিতর্ক শিখতে গিয়ে নতুন আর্য হিসেবে বেরিয়ে আসে ছেলেমেয়েরা। আওয়ামী লীগ ও বামের প্রেমে জবুথবু হয়ে তারা বাকি মানুষকে “ছাগু” বলে ডাকতে থাকে। জাতে ওঠার আরেকটি বিশেষ পথ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া। একটু চুটুর পুটুর করে ইংরেজি বলতে শিখলেই; কল্পনায় গরিবের নিটশে হয়ে ওঠে ছেলেমেয়েরা।
অথচ আপনি আমেরিকা-ক্যানাডা-ইউরোপের এলিট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ের সঙ্গে মিশে দেখুন; নিরহংকার স্বাভাবিক ছেলেমেয়ে তারা। দাড়ি-টুপি দেখে বঙ্গের ললিতাদি কিংবা শিবব্রত দাদা যেরকম আঁতকে ওঠে কিংবা হেসে কুটিপাটি হয়; এরকম কুচুটে মন মানসিকতা আপনি পশ্চিমে পাবেন না। এ আপনি উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব কোথাও পাবেন না। এইসব হীন মানসিকতা একমাত্র মোটাতাজা হয়েছে দুই বঙ্গে। এরা এতো বড় জমিদার হয়েছে যে, অপরকে বাঙ্গি বলে নিজের একরকম এলিটায়ন ঘটায়।
আফঘান মুজাহিদ হিসেবে এমেরিকার সঙ্গে যূথবদ্ধ হয়ে সোভিয়েতের সঙ্গে যুদ্ধ করা বাংলাদেশের কিছু লোক ফিরে এসে নাইন ইলেভেনের পর ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ পরিচালনা করে। বাংলাদেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনী দক্ষতার সঙ্গে এই সন্ত্রাসবাদকে পরাজিত করে। সেনাবাহিনীর সেই দক্ষ কর্মকর্তাদের পিলখানায় হত্যা করে কে বা কারা; যারা পরে এই হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি হয়েছে; তারা সেকুলার বলেই নিজেদের পরিচয় দেয়।
খোলা চোখেই দেখা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে অদাড়ি অটুপিওয়ালাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যে সংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে; টুপি-দাড়িওয়ালাদের সন্ত্রাসে তার তুলনায় গৌণ সংখ্যায় প্রাণহানি ঘটেছে।
বাংলাদেশ সমাজে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির কাস্ট সিস্টেমের জেরে আলোর অলক্ষ্যে দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে বেড়ে উঠেছে দাড়ি টুপিওয়ালারা। কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কোন আশ্রয় তো তাদের নেই। রাষ্ট্র ব্যস্ত তার নতুন রুলিং এলিটদের চর্বি বাড়াতে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের মৌলিক রস সৃষ্টির অক্ষমতা থেকে শুধুই দাড়ি টুপিওয়ালা নিয়ে হাসাহাসি। রবীন্দ্র দুপুরে দাড়ি টুপিওয়ালাদের নিয়ে প্রণব মুখার্জির মতো মুখ টিপে হাসতে শিখলেই পোড়া বেগুনের মতো মুখমণ্ডলের পথিকৃত বাতেনের প্রেমে পড়ে যায় শিল্পসম্মত আকলিমা নদী। মাঝে সুষুপ্ত হিন্দুত্ববাদী এসে ইতিহাস আওড়ায়, ছাগুরা কতো পিছিয়ে আছে; আর হনুমানেরা পাঁচ হাজার আগে উড়ন্ত রথ ও গদার ক্ষেপনাস্ত্র তৈরি করেছিলো।
এইরকম কালচারাল হেজিমনির মাঝ দিয়ে দাড়ি টুপি ছাগুর অপরায়ন করলে; মোদির আগমনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মাদ্রাসার কিশোর তরুণ নিহত হলে সেকুলার জগতে আনন্দের সুরলহরী বাজতে থাকে। অথচ নাট্যকলার শিক্ষিকাকে একটি পুলিশ টিপ নিয়ে অনভিপ্রেত কথা বলার অভিযোগে সুষুপ্ত ও বাতেনেরা টিপ ও ক্রস ড্রেসিং করে নেমে পড়ে হ্যাশ ট্যাগ প্রতিবাদে।
শাপলা জনসমাবেশের হোতাকে লীগের দরবেশ হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় এনেছিলেন; খাস জমি আর আর্থিক অনুদানের নজরানায় তাদের কওমি জননী হয়ে উঠেছিলেন হাসিনা নিজেই। অথচ শাপলায় খুনে পুলিশ বেনজিরেরা কিশোর-তরুণদের হত্যা করলে; তা নিয়ে কেউ প্রতিবাদ জানালেই কালচাড়াল সহমত-শিবব্রত-ললিতা-আনারকলি সেখানে ছোট্ট করে ছাগু লিখে দিয়ে যেতো। তারা দিনমান কেলিয়ে কেলিয়ে “কানধরা দিবস” বলে রগড় করতো। এই তো আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ইসলামোফোবিক বাঙালি সংস্কৃতি। এইখানে আইদার ইউ আর উইথ আস অর এগেইন্সট আস। আপনি বেঙ্গল রেনেসাঁর এঁকে দেয়া লক্ষ্মণরেখার মাঝে থাকলে মন্থরা বুবুর বাসায় আট রকম ভর্তার দাওয়াত পাবেন। আর লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করলেই বুবু বলবে, তুমি আমাদের লোক নও।
এই ভাবে কাল্পনিক আর্য সেজে দাড়ি টুপিওয়ালাদের বংকিমচন্দ্রের চোখে নিম্নবর্গের মানুষ হিসেবে দেখে আমরা দূরত্ব ও বিভাজন তৈরি করেছি। আমি বুঝিনা এদের এতো আর্য হতে হয় কেন! ফলাফল দেখতেই পাচ্ছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে একদিকে খাসজমি, আর্থিক প্রণোদনা ও মডেল মসজিদ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ইত্রামিস্ট। যারা ইসলামিস্টের অভিনয় করে দশচক্রে ভগবান ভূত করবে, ঐ দ্যাকো হাসিনা নেই বলে ইসলামিস্টের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। আর রয়েছে পনেরো বছরে জঙ্গীদমনের নাটকে হত্যা গুম ক্রসফায়ার কারাগারের তিক্ততায় বিক্ষুব্ধ হওয়া ইসলামপন্থী। ২০২৪-এর ৫ অগাস্টের পর পাওয়া মুক্তির আনন্দ উদযাপনে সে দিশেহারা। এদের অনেকে চোখের সামনে আওয়ামী লীগের ঘষেটি বেগমদের নিষ্ঠুরতা রেখে নারী সম্পর্কে অশ্রাব্য সব কথা বলে বেড়াচ্ছে লীগের সিপি গ্যাং-এর ভঙ্গিতে।
অথচ এই যে জুলাই বিপ্লব এর মূল সাংগাঠনিক শক্তি ছিলো নারী সমাজ। এখানে হিজাব ও পশ্চিমা পোশাক পরা নারী পাশাপাশি লড়েছে। হিন্দু-মুসলমান মা সন্তানকে এগিয়ে দিয়েছেন রাজপথে। নারীদের সাংগাঠনিক ক্ষমতা এই বিপ্লবকে সর্বব্যাপী করেছে। নারী তুলে ধরেছে পুরো আকাশ। এই নারীকে শ্রদ্ধা করতে না পারলে তা হবে ভীষণ কৃতঘ্নতা।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।