মাসকাওয়াথ আহসান
পাল-সেন-সুলতানী-মুঘল-নবাবী আমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ, ধর্মীয় সম্প্রীতি মিলিয়ে ইউরোপের চেয়ে সমৃদ্ধ একটি জনপদ ছিলো পূর্ববঙ্গ। এ কারণেই বৃটিশ-ফরাসি-ডাচ-পর্তুগীজেরা ভাগ্যান্বেষণে এখানে আসতে থাকে। এখন যেমন ভাগ্যান্বেষণে বাংলাদেশ থেকে অনেকে ইউরোপ-এমেরিকাতে যায়।
ইংরেজরা সুতানুটি বা আজকের কলকাতায় খুঁজে পায় মীরজাফর- জগতশেঠ-রায়বল্লভদের। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে সামষ্টিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত ছিলো। ইংরেজরা ব্যবসা করতে এসেই নিজেদের ইংল্যান্ডের দশ ফুট বাই দশফুট ইট পাথরের বস্তিজীবনের সঙ্গে নবাবী আমলের প্রাসাদ ও দিল্লির মুঘল স্থাপত্যকলার তুলনা করে ঈর্ষান্বিত হয়। হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিক, বাংলা ও হিন্দাভি কাব্য, চিত্রকলা-নকশাচিত্র দেখে বুঝতে পারে এ অনেক পুরোনো ঐতিহ্য। এখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম জনমানুষের যৌথ সমাজ-সভ্যতার বিপুল বিকাশ ঘটেছে। সম্পন্ন কৃষি ও কারিগর সমাজ রয়েছে।
সুতানুটির কোলাবরেটরদের সাহায্যে পলাশীর যুদ্ধে জিতেই; বৃটিশেরা ঘোষণা দেয়, ইংলিশ অনলি ইংলিশ উইল বি দ্য মোড অফ এডুকেশন। বাংলা-আরবি-সংস্কৃত-ফার্সি জানা মানুষ হচ্ছে অশিক্ষিত। ১৭৭০-৭৬ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করে প্রায় এক কোটি মানুষ হত্যা করে, কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে, কারিগরদের আড়ং উচ্ছেদ করে; আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দেয় সাধারণ মানুষের।
সুতানুটির কিছু কোলাবরেটর দ্রুত ইংরেজি শিখে বৃটিশদের তেলাঞ্জলি দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হয়ে বসে। সেই থেকে সুতানুটির জীবনব্যাপী সার্বভৌমত্বহীন গোলামির নিয়তি নির্দিষ্ট হয়।
কলকাতায় বৃটিশ শিক্ষক ডিরোজিও বলেন, আইসো তোমাদের এনলাইটেনমেন্ট শেখাই। অমনি পেটমোটা-কুঁজো-বেগুনী মুখমণ্ডলের কতিপয় বাঙালি আর্য হবার আশায় বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রথম আলোর দোকান খুলে। তারা কবিতায়-গল্পে-মনের মাধুরী মেশানো ইতিহাসে পূর্ববঙ্গের মানুষকে নিম্নবর্গের কৃষক তকমা দেয়। বম্বে থেকে শাড়ি আনিয়ে স্ত্রী-কন্যাদের পরিয়ে; নিজেরা বৃটিশ সাহেবের মতো সাসপেন্ডার দিয়ে ভুঁড়ি সামলে হাজির হয়ে যায় এরিট্রোক্রেসি বিনির্মাণে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রসিক মানুষ। তাই তিনি বাংলা গানের বাণীতে ইউরোপীয় সুর বসিয়ে চারুলতাকে পিয়ানো বাজানো শিখতে লাগিয়ে দেন। আর নিজে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে গিয়ে পূর্ববঙ্গের মাটি ও মানুষের সুরে অবগাহন করতে থাকেন।
কিন্তু গালে সুপোরি পুরে চলচ্চিত্রের ছবি বিশ্বাসের মতো গম্ভীর হয়ে ওঠেন কলকাতার আলোর দোকানের ময়রারা। বৃটিশেরা যেহেতু সবচেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন সিভিল সার্ভেন্টদের শ্রীখণ্ডে পাঠাতো; তাই তাদেরকে প্রচন্ড গম্ভীর থেকে পদমর্যাদা রক্ষা করতে হতো। ওটা হুবহু কপি করে ফেলে নেটিভ সরকারি চাকুরে ও সরকারি বুদ্ধিজীবীরা।
পাল-সেন-সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমলের বাংলা সাহিত্যকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কলকাতার নীলক্ষেতে লেখা হতে থাকে বাংলা সাহিত্যের উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি। বাঙালি সংস্কৃতির নতুন নির্মাণ কাজ চলতে থাকে।
১৯২১ সালে কলকাতার আলোর দোকানের বাধার মুখেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়। নব্য শিক্ষিত মুসলিম ছাত্রদের ধারণা দেয়া হয়, তোমরা নিম্নবর্গের কৃষক, তোমাদের কোন ইতিহাস নেই। সুতরাং তোমরা বাংলা সংস্কৃতি শিখবে কলকাতার কাছে। প্রমিত বাংলা ভাষা শিখতে আকাশ বাণী শুনবে। বংকিমচন্দ্রের সাহিত্য পড়বে।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিম যুবকেরা পূর্ব বঙ্গে এসে; কলকাতার আলোর দোকান থেকে শিখে আসা বাঙালি সংস্কৃতির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হয়ে পড়ে। তারা নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠে। ধানক্ষেত থেকে উঠে আসা কলকাতার জমিদার আর গম ক্ষেত থেকে উঠে আসা লাহোরের জমিদারের নতুন এরিস্টোক্রেসির দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। লাহোরের জমিদারেরা আরেক কাঠি সরেস হয়ে আরবি হরফে বাংলা লেখার পরামর্শ দেয়। আর কলকাতার জমিদারেরা ভারি ভারি সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করে বাংলাকে ভারাক্রান্ত করতে চেষ্টা করে।
পূর্ব বঙ্গের কৃষকের সম্পদ লুন্ঠন করে অর্জিত এফলুয়েন্সের গর্ব দেখিয়ে কলকাতা ও লাহোরের রেসিজম চলতে থাকে পূর্ব বঙ্গের মানুষের ওপর। বলাই বাহুল্য কলকাতার মতো লাহোরের জমিদারেরাও ঐতিহ্যগতভাবে ক্ষমতাসীনের কোলাবরেটর। তাই তো আজো উভয় শহরের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার যথাক্রমে দিল্লির সাউথ ব্লক ও পিন্ডির আর্মি ব্লকের গোলামী করে চলেছে।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাঝ দিয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেও ভারতের নাগিনী শ্রীদেবীর মতো নেচে বেড়াতে থাকে বাংলাদেশময়। ফলে ঐ যে দেশের মানুষকে তুচ্ছ করে তাকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বলে কলকাতার আলোর দোকানের মাত্র একশো বছরের সংস্কৃতি শেখানো চলতে থাকে। সেই জোড়াসাঁকো নেই; তবু বম্বে থেকে আনা শাড়ি পরে ; মুঘল সম্রাট আকবরের পোশাকটাকেই বুক থেকে ডানদিকে পাঁচটা বোতাম দিয়ে নক্সী পাঞ্জাবি বানিয়ে বড্ড সংস্কৃতি খালা ও মামা হয়ে ঘুরতে থাকে আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং। গণভবনে “কি ব্যথা অন্তরে ওগো মা” বলে কেঁদে ওঠার কদিন পরেই মা পালিয়ে দিল্লির সাউথব্লকে গিয়ে আশ্রয় নিলে; মায়ের এতিম ছেলেমেয়েরা কেঁদে ওঠে, “কোথায় গেলে ও আমার মাম্মা, এতো অবহেলা আর প্রাণে সহেনা।”
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বিপ্লবী ছাত্রদের পছন্দে জুলাই বিপ্লবের ম্যান্ডেট নিয়ে ড ইউনুস ক্ষমতায় এলে; ক্ষমতাকে সেবা হিসেবে দেখতে থাকেন। পশ্চিমা বিশ্ব থেকে জুলাই বিপ্লবের স্বীকৃতি আসতে শুরু করে। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। কিন্তু হাসিনার বিরহে লীন সংস্কৃতি মামা ও খালার দিনরাত্রি কাটে ছিদ্রান্বেষণ করে। পুরান ঢাকায় প্রচলিত কাওয়ালি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইলে তারা কাওয়ালির মধ্যে জঙ্গীবাদ খুঁজে পায়। জোরে জোরে প্রচার করতে থাকে বাংলাদেশ মৌলবাদিদের খপ্পরে পড়ে গেছে। কিন্তু সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকির উদ্যোগে সারাদেশে শিল্পকলা একাডেমিতে সংস্কৃতি চর্চা বেগবান হলে, হাসিনার তৈরি মডেল মসজিদে বসে ওলামা লীগ বলে, ও গুলো বেদাতী কর্মকান্ড। চান রাতে সংগীত উতসব হলে, হাতে মেহেদি আঁকার আয়োজন হলে; আওয়ামী সংস্কৃতি মামা ও খালারা মুষড়ে পড়ে।
সুলতানি-মুঘল-নবাবী-বৃটিশ-পাকিস্তানি আমল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুর দিকে ঈদে কাফেলা বের হতো। সেখানে গান-বাদ্য-নৃত্য সবকিছুই থাকতো। কিন্তু আওয়ামী লীগের তৈরি ইতিহাসের সিলেবাস শুধু ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত। ফলে পূর্ববঙ্গের সংস্কৃতি সঞ্জাত সব কিছুই বাদ দিয়ে স্বাধীন দেশে আবার শুরু হয় আলোর দোকানে সংস্কৃতি নির্মাণ। আশির দশকের শেষে চালু হওয়া বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা ও পরে মঙ্গলশোভাযাত্রা উইল বি দ্য অনলি বেঙ্গলি কালচারাল সিম্বল বলে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে আওয়ামী লীগ।
ফলে আওয়ামী লীগের শেকল ছিঁড়ে শ্রীদেবীর নাগিন ডান্স বন্ধ করে; ঐতিহ্যগত ঈদের আনন্দযাত্রা বা কাফেলাকে; এই প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করতে নাসিরুদ্দিন হোজ্জা, সিন্দাবাদ এরকম মোটিফ দিয়ে সাজানো হলে; তাতে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি ও বাংলাদেশের আদি বাহন গরুর গাড়ি দিয়ে রঙ্গিন করা হলে; শুধু হাসিনার জোকস শুনে হেসে কুটিপাটি হওয়া রসের বাইদানিরা হোজ্জাকে চিনতে না পেরে পুরো ঈদের দিন খিল্লি খেলতে থাকতে। এবছর ঈদে গণভবনের সেমাই নেই; বিপু ভাইয়ের বাসায় বিরিয়ানি নেই, দীপু আপার সেলামি নেই; বাসা থেকে বের হতেও ভয়; ফ্যাসিস্টের দোসর বলে শিশু-কিশোরেরা দুয়ো দেয় কীনা! নিজের জীবন তেতো হলে সবার জীবন তেতো করে তুলতে সাধ জাগে। সমাজের সবচেয়ে ইনফেরিয়র সংস্কৃতির লোকের কালচারাল সুপিরিয়রিটির পরাবাস্তব আলাপ যদি কেউ দেখতে চান; ঘুরে দেখুন আফসোস লীগের দৈনিক দুঃসংবাদ ফেসবুক আইডিগুলো।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।