মাসকাওয়াথ আহসানঃ বাংলাদেশ যেমন হাতছাড়া হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের হাত থেকে; আওয়ামী লীগও তেমনি হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগারদের হাত থেকে। বাংলাদেশ কীভাবে নদী মানুষের গাছ মানুষের বাঘ মানুষের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়েছে; সে কথা প্রতিদিনই লিখছি। তাই একটু খুঁজতে চাই; আওয়ামী লীগ কীকরে সমাজের মানুষের সেবা করতে চাওয়া মানুষের হাতছাড়া হলো।কাজলরেখা গল্পে আমরা পড়েছি; রাজকুমারী কত গভীর অধ্যবসায়ে জীবন্মৃত রাজকুমারের গোটা শরীর থেকে এক এক করে সুঁচ তুলেছিলেন। সবশেষে রাজকুমারের চোখ থেকে সূঁচ থেকে তুললেই তিনি মৃত্যুঘুম থেকে জেগে উঠবেন। ক্লান্ত কাজলরেখা স্নান করে এসে রাজকুমারের চোখ থেকে সূঁচ তুলবেন, এমন ভেবে ঘরের বাইরে গেলে, তার সহযোগী কাঁকন দাসী সে সুযোগ কাজে লাগায়; রাজকুমারের চোখের সূঁচ তুললে সে জেগে ওঠে; কাঁকন দাসী রাজকুমারকে বাঁচিয়ে তোলার কৃতিত্ব নিয়ে ফেলে।বাংলাদেশ হাতছাড়া হওয়া বাংলাদেশের মানুষ, আর আওয়ামী লীগ হাতছাড়া হওয়া আওয়ামী লীগাররা এই রাষ্ট্রের রূপকথার কাজল রেখা। আর এই দেশে ধর্ম-রাজনীতি ব্যবসা করে যে থাগস অফ বেঙ্গল এখন ওয়েস্টিনে পাপিয়ার আসরে উন্নয়ন রিরংসায় মত্ত; এরা এই বাংলাদেশ গল্পের কাঁকন দাসী।এই কাঁকন দাসীরা দুর্নীতি বসন্তের পুষ্পমাল্য খোঁপায় গুঁজে বাংলাদেশের মানুষকে ধর্ম ও দেশপ্রেম শেখায়। কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে, তাকে দেশ থেকে চলে যেতে বলে। ভিন্নমতে কাঁকন দাসী রেগে কাঁই হয়ে গেলে খুন করে ফেলে মুশতাককে; গুম করে ফেলে কিশোরকে।
আওয়ামী লীগ কারা শুরু করেছিলেন, তা খুঁজতে গেলে নিজের পরিচিতদের মাঝেই খুঁজি আমি। তাকিয়ে দেখি আমার শৈশব কৈশোরের বেড়ে ওঠার জনপদ আড়ানী-ঈশ্বরদী-রাজশাহী-নাটোরে। আমার নানার ঘরে খুব শৈশবে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা সুদর্শন এক নানার বয়েসী লোক আর রুপবতী এক নারী, নানীর বয়েসীকে দেখে প্রশ্ন জাগে;এঁরা কারা! নানা বুঝিয়ে বলেন, এরা হচ্ছেন শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী। এদের দুজনের কারণেই আমরা এই দেশটা পেয়েছি।নানার ছোট ভাইয়ের ঘরে পেলাম, ঐ কালো মোটা ফ্রেমের চশমা পরা ভদ্রলোকের ছবি। ছোট নানাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কী শেখ মুজিব! ছোট নানা খুব খুশী হলেন আমি ভদ্রলোককে চিনি বলে। আরেকটু বিস্তারিত বললেন উনার সম্পর্কে। বাংলাদেশের বন্ধু বলে দেশের মানুষ তাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকে, এটা জানালেন।বাড়ি ফিরে জ্ঞান জাহির করার জন্য আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কী বঙ্গবন্ধুকে চেনেন! আব্বা বললেন, উনি একজন প্যাট্রিওট। একজন ট্র্যাজেডির নায়ক। আব্বা প্যাট্রিয়ট কবিতা পড়ে শোনালেন। যে কবিতায় প্রথমে সবাই তাকে ফুল দেয়; পরে সেই একই মানুষকে পাথর ছুঁড়ে মারে। প্যাট্রিয়ট হতে গেলে এমন ঝুঁকি নিতেই হবে। একে ভয় পেলে চলেনা।আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম, ইন্দিরা গান্ধীকে চেনেন কীনা! আব্বা শেলফ থেকে আরেকটা বই বের করে পড়তে দিলেন, নেহেরু যেখানে তার মেয়ে ইন্দিরাকে চিঠি লিখছেন।আমার নানা ও দাদা ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক দল করার সময় ছিলো না। কিন্তু তারা রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজনৈতিক দল যেহেতু সমাজসেবা করতো সেসময়; তাই জনকল্যাণে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা করা অতীতের ব্যবসায়ীদের দায়িত্বের মাঝে পড়তো। এখন যাকে আমরা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটিজ বলি। নানা বাংলাদেশের মানুষ, উনি আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, আর দাদা ভারতের মানুষ, উনি কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আর পশ্চিমবঙ্গে বামদলকেও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন দাদা।সেসময়ের ব্যবসায়ীরা নিজে কখনো সাংসদ বা মন্ত্রী হতে চেষ্টা করতেন না। বরং নিজ নিজ এলাকার সাংসদ প্রার্থী বাছাইয়ে অভিমত রাখতেন।
ঈশ্বরদীতে আম্মার মামারা, আমার বেশ কিছু ইন্টেরেস্টিং নানা, আওয়ামী লীগের তেমন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মামাদের কেউ কেউ জাসদ, ছাত্রইউনিয়ন করতেন, একই গৃহে ভিন্নমত পোষণ করে। আম্মার এক মামা নিজের বাড়ির আওয়ামী লীগের দুর্গের মধ্যে বসবাস করে বিএনপি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হয়েছিলেন। সেসময় নতুন দল খুলতে রাজনৈতিক পরিবারগুলো থেকেই ট্যালেন্ট হান্টিং করতেন সেনাশাসকেরা। কারণ তারা জানেন, কী করে সংগঠন গড়তে হয়, তা এসব পরিবারের মানুষের শত বছরের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আছে।বড় খালার বাসায় বেড়াতে গিয়ে খালু সেই ছবি ফ্রেমের সুদর্শন মানুষটার মতো কোট পরে আছেন দেখলাম। আমাকে তাকাতে দেখে খালু, নিজেই বললেন, এটা মুজিব কোট। খালু সক্রিয় আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন। উনার বাবা ইপিসিএস অফিসার ছিলেন; অথচ তার ছেলে ঘরে বসে পাকিস্তানশাহীর বিরুদ্ধে রাজনীতি করতেন। এটাই তো রাজনীতির স্পিরিট। সেই ইপিসিএস ভদ্রলোক ছিলেন বাংলাদেশের সোনালী যুগের মানুষ। ধার্মিক, বিশুদ্ধ মানুষ; আবার উদারপন্থার প্রতি বিপুল আগ্রহ। তিনি আমার সঙ্গে দেখা হবার পর, দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিয়ে বললেন, সুনাগরিক হও। এরপর তার রিটায়ার্ড লাইফের হবি পাখি শিকারে গেলেন। খালু আওয়ামী লীগ করার পাশাপাশি বই পড়তেন সারাক্ষণ। বুকশেলফ ভর্তি তার বই। এই যে আজকাল আমরা শেখাই, বাচ্চাদের গালে চুমু দিতে নেই; এই পোস্ট মডার্ন আদর করার পদ্ধতি খালু সেসময়ই জানতেন। গালে দুটো আঙ্গুল সামান্য স্পর্শ করে, সে আঙ্গুল নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করতেন। তারপর পকেট থেকে নাবিস্কো লজেন্সের প্যাকেট বের করে দিতেন। কখনো প্রকৃতি দেখাতে নিয়ে যেতেন। নানারকম গাছ-পাখি-ফুল-ফল চেনাতেন। উনি বলেছিলেন, ঐ যে দেখো কিছু গাছ লাগিয়েছি; এগুলো হচ্ছে লাইফ ইনশিওরেন্স; নিজের আর নিসর্গের। খালা গান শিখেছিলেন শৈশবে। খালু সেটাকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন নিয়মিত। খালা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন, উনার দেবর নাসিম মামা তবলায় ঠেকা দিতেন। আমি বেড়াতে যাওয়ায় বাড়ির উঠোনে গানের আসর হয়েছিলো, সেখানে কয়েকজন আমন্ত্রিত শিল্পী ও বাদক ছিলেন। এতো ভালো লেগে গিয়েছিলো খালা-খালুর স্নেহ আর আমাকে আনন্দ দেবার আয়োজন, যে ফিরতেই চাইছিলাম না নাটোরের অদূরে সেই শান্তি নিকেতন কুমরুল থেকে। যথারীতি আম্মা গিয়ে কান ধরে নিয়ে এসেছিলেন আমাকে।
মোটামুটি এই হচ্ছে আমার আওয়ামী লীগকে জানা। এই আওয়ামী লীগের মানুষ নিজের জমি বিক্রি করে পার্টি ফান্ডে টাকা জমা দেয়া লোক, কোন রিটার্ণ বা প্রাপ্তির জন্য নয়। সমাজ সেবার আনন্দ পাবার জন্য। এরা ধার্মিক ছিলেন নৈতিকতা শিখতে ও চর্চা করতে। এরা উদার ও সংস্কৃতিমনষ্ক ছিলেন জীবনের সত্য-সুন্দর-মঙ্গলকে ধারণ করতে। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচনা মুখর বাংলাদেশ নাগরিক সমাজ। ফলে আওয়ামী লীগ মানে ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এ সক্ষম মানুষ; এটা খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
এই যে আজকের সহমত ভাই কালচার; এটা আওয়ামী লীগের কালচার নয়। সহমত ভাই কালচারটা হচ্ছে ঠগীদের। থাগস অফ বেঙ্গল, যারা পাল-সেন-মুঘল-তুর্কি- বৃটিশ-পাকিস্তানি শাসকের সহমত ভাই হয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করতো। এই যে তেলাঞ্জলি, নেতাকে নজরানা দেয়া; এটা রাজতন্ত্রের প্রথা। রাজ-কর্মচারী ও পারিষদ হিসেবে; থাগস অফ বেঙ্গল খুব উপযোগী। বাংলাদেশের যে কৃষক প্রজা, এরা তো নিজের সোনার জমিনে ফসলের রাজা। জমি থেকে ধান, শাক-সব্জি- পুকুর থেকে মাছ, পৃথিবীর সেরা স্বাদের খাবার খেয়ে তারপর পুঁথি পাঠ, বাউল গানের আসরে আনন্দ খোঁজা। মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে এই সম্পূর্ণ জীবনের জন্য স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানানো। ফলে শাসকের সামনে ঝুঁকে ঝুঁকে তেলাঞ্জলি দেয়া বাংলাদেশের মানুষের জীনে অনুপস্থিত।পরিশ্রমী নয়, কিছু করে খাওয়ার মোটিভেশন নাই, আলস্য আর লিবিডো-তাড়না, অলস মস্তিষ্কে শয়তানের কারখানা লোকগুলো রুমাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো, হাটুরেদের কাছ থেকে সওদা-মোহর ছিনতাইই করতে। লোক ঠকিয়ে সম্পদ অর্জন, প্রয়োজনে রুমালের ফাঁসে বিনা অনুতাপে মানুষ হত্যা; জৈবিক তাড়নায় নারীকে একা পেয়ে ধর্ষণ, তারপর রুমালের ফাঁসে শ্বাস রোধ করে হত্যা; এই যে ঠগী পেশা; এর যে জীনগত আশ্লেষ; তা থেকে তৈরি হয়েছে থাগস অফ বেঙ্গল গোত্রটি। এরা পাকিস্তান কায়েমের ১৯৪৭-এর মুক্তিসংগ্রামীদের সরিয়ে দিয়ে সহমত ভাই হয়ে পড়ে। এদের অত্যাচারে আর উন্নয়নের বেহুদা ঢোলে বিরক্ত হয়েই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম; আর তা থেকে আওয়ামী লীগ। ১৯৭১ পর্যন্ত মুক্তির যুদ্ধে বাংলাদেশের বাঘ মানুষ-গাছ মানুষ-নদী মানুষকে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বাংলাদেশের সারা শরীর থেকে একটা একটা করে উপনিবেশের সূঁচ তুলে; ১৬ ডিসেম্বরে চোখের সূঁচ তোলার সময় মাথায় পতাকা বেঁধে হাতে রাইফেল নিয়ে থাগস অফ বেঙ্গল এসে পড়ে; স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হয়ে। সিক্সটিনথ ডিভিশন দখল করতে থাকে অবাঙ্গালিদের ব্যবসা-বাড়ি; আর যে হিন্দুরা প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়েছেন; তাদের স্বপ্নের গৃহ দখল করে বসে থাগস অফ বেঙ্গল; রুলিং এলিট। বঙ্গবন্ধু এদেরকে চাটার দল ও চোরের খনি বলেছিলেন।সেই যে কৃষক যে বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ জানায়; অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়েছিলো; ঘরে ঘরে মুক্তির দুর্গ গড়েছিলো; তারা ফিরে যায় কৃষিকাজে। আর হিস্ট্রির ফারমার্স ব্যাংক বানিয়ে ফ্যাঁসফেসে গলায় দেশপ্রেম শিক্ষা দিতে শুরু করে থাগস অফ বেঙ্গল পরিবারগুলো। মামা-ভাগ্নে সেই থেকে জোড়ায় জোড়ায় দেশ লুন্ঠন করছে। অদৃশ্য সাবানে হাত কচলে রাষ্ট্রীয় পদক নিচ্ছে। ক্যান্টনমেন্টের অনুষ্ঠানে আবার সানগ্লাস পরা হানিট্র্যাপ থাগসেরা ঠিক যেন সেই জেনারেল রাণী-ব্ল্যাক বিউটি। বাংলাদেশে ক্ষমতায় রয়ে গেলো থাগস অফ বেঙ্গল; রুমাল রাজা ও রাণীরা। বৃটিশ-পাকিস্তান যে সম্পদ লুন্ঠন করে পাচার করেছে; তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি লুন্ঠন ও পাচার করেছে এই থাগস অফ বেঙ্গল উপনিবেশ।
এই যে সেদিন একটি পরিবার স্বনির্ভরতা অর্জনের পর প্রধানমন্ত্রীর অনুদানের গৃহ ফেরত দিলেন, সেই পরিবারটিই বাংলাদেশ। আভিজাত্যের ডেফিনেশন আমি দেখেছি করাচিতে সমুদ্রে মাছ মেরে জীবন নির্বাহ করা বাঙালি পরিবারে। সেই পরিবারের মাজেদা আপা করাচিতে আমাদের গৃহে সহযোগী ছিলেন। সততা-নিষ্ঠা-আভিজাত্য দিয়ে মাজেদা আপার ছেলেমেয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষক, আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য হয়েছে। ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে যাবার পর মাজেদা আপা আমার স্ত্রীকে যখন বলেন, এখন থেকে বাড়তি টাকা চৌকিদার সদরুদ্দিন-ড্রাইভার আযম খানকে দিয়েন; ওদের বাচ্চারা এখনো মানুষ হয়নি। বাঙালি নারী একজন সিন্ধি আর একজন পাঠানের পরিবারের ভালোর জন্য; নিজের প্রাপ্য বাড়তি উপহার ওদের উপহার দিলেন; এই মাজেদা আপাই বাংলাদেশ। নির্লোভ-হাসিখুশি-সোনার বাংলার সোনার মানুষ।