মাসকাওয়াথ আহসানঃ
জুলাই আন্দোলনটি আমাদের চোখের সামনে ঘটছিলো। আমরা দেখছিলাম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রছাত্রীদের ডাকে রাজপথে নেমে আসছেন আবাল বৃদ্ধ বণিতা। মধ্যবিত্ত ও মেহনতী একাট্টা হচ্ছে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে।
আন্দোলনের শুরুতেই ভারতের গদি মিডিয়ায় মোদি জনতা বলতে শুরু করে “এটি ইসলামপন্থীদের আন্দোলন”। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সমর্থক সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি প্রথম এই ন্যারেটিভ চালু করেন। বিজেপি বাংলাদেশ শাখার আওয়ামী লীগ সমর্থক ও মোদি জনতা তখন তোতাপাখির মতো বলতে থাকে, এটা মৌলবাদী ও জঙ্গিদের বিপ্লব। রংপুরে সাঈদ শহীদ হলে; মোদি জনতা সেই মৃতদেহকে জঙ্গী তকমা দেয়। কিন্তু সিলেটে রুদ্রের শহীদ হওয়া হিন্দুত্ববাদী ঐ ন্যারেটিভকে শত্রুতামূলক প্রমাণ করে। হিজাব পরা মেয়ে স্কার্ট পরা মেয়ের হাতে হাত রেখে ভারতীয় ছায়া উপনিবেশের দানব শেখ হাসিনাকে সরাতে লড়াই শুরু করলে; ভারতীয় ন্যারেটিভ মুখ থুবড়ে পড়ে।
৫ অগাস্টে ভারতের পুতুল হাসিনা অভ্যুত্থানের মুখে ভারত পালিয়ে গেলে; ভারতীয় মিডিয়া তখন রীতিমত ঘেউ ঘেউ জুড়ে দেয়, আওয়ামী লীগ বাদে বাংলাদেশের সবাই মৌলবাদী। এগারো বছর ধরে ভারতের হিন্দুত্ব মৌলবাদী মোদির রাষ্ট্রক্ষমতার সেবাদাস মোদিজনতা কতটা নির্লজ্জ হলে; ইসলামি মৌলবাদি গড়ে দুই-তিন শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়া বাংলাদেশের ললাটে মৌলবাদের তকমা এঁকে দিতে চেষ্টা করে।
৫ অগাস্টের পর বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধ থেকে ভারতীয় মিডিয়ার সমস্ত সাম্প্রদায়িক উস্কানিকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। বাংলাদেশকে অচল করে দিতে সক্রিয় থেকেছে কেবল মোদি জনতা ও তৌহিদি জনতা।
ভারতীয় প্রোপাগান্ডা ধরে ধরে বাস্তবায়ন করেছে তৌহিদি জনতা; আর মোদি জনতা তৌহিদি জনতার উচ্ছৃংখলতার দৃশ্য ভিডিও করে ভারতীয় মিডিয়ার কাছে পাঠিয়েছে। বিজেপির বাংলাদেশ শাখা আওয়ামী লীগের সিপি গ্যাং সদস্যরা ভারতের মিডিয়ায় যুক্ত হয়ে তাদের ইসলামোফোবিক ন্যারেটিভকে সাবস্ট্যানশিয়েট করার চেষ্টা করেছে।
তৌহিদি জনতার মাজার ভাঙ্গা প্রকল্পে কেসস্টাডি ধরে ধরে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জামায়াত, হেফাজত, ওলামা লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এর নেতৃত্ব দিয়েছে। এই জামায়াতের আমিরকে ৫ অগাস্টের পর পুনঃ পুনঃ ভারত তোষণমূলক বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। হেফাজতকে আমরা দেখেছি শেখ হাসিনাকে কওমী মাতা উপাধি দিয়ে খাস জমি ও অন্যান্য উপঢৌকন নিতে। শেখ হাসিনা মডেল মসজিদগুলোকে গড়ে তুলেছেন তৌহিদি জনতার একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ বিরোধী নৈরাজ্য করার জন্য।
ভারতের মিডিয়ায় বীণা সিক্রি বাংলাদেশ হিজবুত তাহরীরের দখলে প্রোপাগান্ডা চালানোর পরপরই; ঢাকায় কালো পতাকার ওপর আরবি লিখে মিছিল করে; ভারতীয় মিডিয়াকে ফুটেজ সরবরাহ করেছে কথিত হিজবুত অভিনেতারা । পুলিশ হিজবুতের মুখপাত্রকে গ্রেফতার করার পর থেমে যায়; সেই নাটকের মঞ্চায়ন।
ভারতের উত্তর প্রদেশের হিন্দুত্ববাদী নেতা আদিত্য যোগীর নির্বাচনী প্রচারণায় আমরা নিয়মিত সেখানকার ইসলামপন্থীদের দেখেছি। ভালোবাসা দিবসে বাংলাদেশের ইসলামি ছাত্র শিবির ও ভারতের হিন্দুত্ববাদী বজরং দলের ভালোবাসা বিরোধী পোস্টারের ভাষা আইডেন্টিক্যাল। বাংলাদেশ ইসলামপন্থার দখলে; বীণা সিক্রির এই একটি মিথ্যা শতবার বলার ফসল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি গোলায় তুলেছে দিল্লির নির্বাচনে।
তৌহিদি জনতার সামনে মোদি জনতা স্বপ্নের আলেয়া তৈরি করেছে, ইধার হাম, উধার তুম। এখানে আমি গেরুয়া পোশাক পরে মধ্যযুগের ভারত রচনা করেছি; সুতরাং ওখানে তুমি মধ্যযুগের বাংলাদেশ রচনা করো। আর মাঝখানে রয়েছে কলকাতার সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর আমলে পূর্ববঙ্গের সম্পদ লুট করে গড়ে তোলা আনন্দবাজার কুটির। বিজেপি বাংলাদেশ শাখার মোদি প্রগতিশীলেরা যেন পূর্ব বঙ্গের জমিদারি উদ্ধারের লেঠেল। ভগ্ন জমিদার বাবুকে কুর্ণিশ করে সংস্কৃতি দলিতেরা ইসলাম থেকে আবার হিন্দু ধর্মে ঘর ওয়াপসির স্বপ্নে বিভোর। তাদের কাজ বাংলাদেশের প্রতিটি নৈরাজ্যের ঘটনাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ভগ্ন জমিদার বাবুর কানে তোলা। আজতক ও রিপাবলিক বাংলায় গিয়ে গালে থকথকে পাওডর দেয়া উপস্থাপককে দাদা দাদা দিদি দিদি করে মুখে ফেণা তুলে ফেলা। ডিএনএ-র প্রজাসুলভ দাসত্বকে রবীন্দ্র নন্দনতত্ত্বের নকসী পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে মোদি প্রগতিশীলতার ভেক ধরা।
মোদি জনতার আশার ছলনে ভুলে যে তৌহিদি জনতা উধার মোদি ইধার তৌহিদি কল্পনায় পাগলপারা; তারা জানে না; এই মুহূর্তে ইজরায়েলের নেতানিয়াহুর ক্রাইম পার্টনার মোদি; ভারত থেকে গিয়ে ইজরায়েলের খুনে সেনাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্যালেস্টাইন গণহত্যা চালাচ্ছে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। সুতরাং তাদের মিডিয়া প্রোপাগান্ডায় নেচে নেচে যে তৌহিদি জনতা ভারতীয় প্রোপাগান্ডাকে সত্যে প্রমাণের মিশনে রয়েছে; তাদের ধারণাও নেই; কি বিষাক্ত সাপের সঙ্গে জটলা পাকিয়ে সাপ হয়ে নাচছে সে।
সাড়ে পনেরো বছর আওয়ামী লীগের মোদি জনতা যে বর্বরতা চালিয়েছে; গত ছয়মাসে তা অনুকরণ করে পেশীপ্রাধান্য দেখাতে চেষ্টা করেছে তৌহিদি জনতা। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী জামায়াতে যোগদানের খবর মিডিয়ায় ধারাবাহিকভাবে এসেছে। আন্ডার গ্রাউন্ডে লুকিয়ে থেকে দাড়ি গজালেই মোদি জনতা মুজিব কোট খুলে, মাথায় সাদা টুপি দিয়ে তৌহিদি জনতা হয়ে পড়েছে। এ হচ্ছে ডেভিল ডিজাইন। সুতরাং অপারেশন ডেভিল হান্টের বাংলাদেশ বিরোধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে তৌহিদি জনতার ছদ্মবেশে সক্রিয় মোদি জনতাকে আইডেন্টিফাই করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
মোদি জনতাই হোক, তৌহিদি জনতাই হোক; যে-ই বাংলাদেশের আইন শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চেষ্টা করছে; তাকেই থামাতে হবে। কারাগারকে সংশোধনাগারে রুপান্তর করে শয়তানের আত্মাকে মানুষের আত্মায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এরা ছোট খাট মানুষ। এরা বিক্রি হয়ে যেতে পারে দেশডাকাত আওয়ামী লীগের টাকার কাছে; ভারতীয় মিডিয়া প্রোপাগান্ডাকে সত্যি ভেবে ব্যাঙ নিজেকে হাতির মতো ফুলাতে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু এদের বে আইনি কর্ম কাণ্ডের দূষণ ও অশান্তি থেকে রক্ষা করতে হবে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের।
দেড় দশক মোদি জনতার হেলমেট পরা হনুমান নৃত্য দেখে ক্লান্ত দেশবাসী আর তৌহিদি জনতার টুপি পরা বানর নৃত্য দেখতে চায় না।
(ছবিতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণায় মোদির বাহুডোরে ইসলামপন্থী নেতা)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।