মাসকাওয়াথ আহসানঃ
চারুকলা কিংবা সাহিত্যের ছাত্রেরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী হবে সেটাই স্বাভাবিক। এই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র হতে পারে, ধর্ম হতে পারে, নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থা হতে পারে। সেদিক থেকে চারুকলার ছাত্রছাত্রীরা শিল্পীর স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ায় আসন্ন বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রার শিল্প ও মোটিফ নির্মাণে অস্বীকৃতি জানানো খুবই যৌক্তিক।
চারুকলার ছাত্র-ছাত্রীদের মনে শুধু এটুকু প্রশ্ন জাগা উচিত, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ও এস এম সুলতানের পর সেলিব্রেট করার মতো আর কোন চিত্রকর আমরা কেন পেলাম না। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো কাজ হয়তো হচ্ছে; কিন্তু তা ছাড়িয়ে যেতে পারছে না সীমাবদ্ধ জল ও সীমিত সবুজ।
এই লক্ষ্মণরেখাটা কে এঁকে দিলো; যেখানে চারুকলার মতো মুক্ত প্রতিষ্ঠানে একপেশে চিন্তার ঘেরাটোপ তৈরি হলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়ার সময় দিনের অর্ধেকটা কাটাতাম চারুকলায়। সে এক অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ ছিলো। আমার প্রতিষ্ঠান বিরোধী মন চারুকলায় গেলে মুক্তির স্বাদ পেতো। আমি তাদের কাজ মন দিয়ে দেখতাম। তারা আমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থিয়েটার দেখতে আসতো। কখনো শিল্প নির্দেশনায় সাহায্য করতো। ক্রিস্টোফার মার্লোর ড ফস্টাস নাটকে ফস্টাসকে স্বৈরাচারির কস্টিউমে রাখতে দেখে আর ল্যাম্পুন ধাঁচের বাংলা সংলাপে ওরা উপভোগ করেছিলো আমার অনুদিত ও নির্দেশিত এই নাটক।
এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফুঁসছিলো। তখন মঙ্গল শোভা যাত্রায় স্বৈরাচারের ক্যারিকেচার দেখে উদ্দীপিত হতাম। মোয়া আর রঙ চা খেতে খেতে আমার বন্ধুরা তৈরি করতো মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা মোটিফ। তারা এতো পরিশ্রম করতো যে, ভোর বেলা ক্লান্ত হয়ে নিজেরাই শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারতো না। কিন্তু তাদের সৃষ্টি দ্যোতনা জীবন মিছিল হতো।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শোভাযাত্রার মতো প্রত্ন শিল্প উপাদানের মোটিফ থাকতো সেখানে। শিল্পী তো চারপাশের বাস্তবতা বিবর্জিত হয় না; তাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নানা প্রতীক উঠে আসতো অনেক মোটিফে।
আমরা সবাই কে কবে ছড়িয়ে গেছি জীবনের নানাগন্তব্যে। কিন্তু প্রজন্মের রিলে রেসে চারুকলার ছাত্র ছাত্রীরা প্রতিবছর এঁকে চলেছে মোটিফ। রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের আসরে কট্টর ইসলামপন্থীদের বোমা হামলা ও পরে দেশব্যাপী জঙ্গী হামলার প্রেক্ষিতে জঙ্গী বিরোধী মোটিফও এসেছিলো স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ২০০৯ সালে ভারতের নেতা প্রণব মুখার্জির অভিভাবকত্বে বাংলাদেশের আকাশে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারের আগমন ঘটলেও; চারুকলার মঙ্গলশোভাযাত্রা আটকে রইলো ২০০৮ সালের ওপারটায়। বুঝতে পারলাম না; এ পাশে আসতে কেন মানা!
সেই একই ক্লিশে মোটিফ, বর্ষাকালে শরতের গান। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা মোদির বাংলাদেশ সফরে প্রতিবাদী বাম ছাত্রদের পিটিয়ে দিলো ছাত্রলীগের গেরুয়া জঙ্গীরা। পুলিশ মাদ্রাসা ছাত্রদের মোদি বিরোধী মিছিলে গুলি চালিয়ে ১৭ জন কিশোর-তরুণকে হত্যা করলো। দিকে দিকে ক্রসফায়ারের শব্দ; স্বজনের কান্না; আব্বু তুমি কান্না করতেছো কি! অবোধ শিশু প্রেসক্লাবের সামনে অশ্রুসজল, গুম হয়ে যাওয়া পিতার ছবি নিয়ে তার ফিরে আসার অপেক্ষায়। মনিরুল জঙ্গী নাটক সাজিয়ে নারী-শিশু হত্যা করছে; অন্তঃসত্বা নারীকে নিয়ে গেছে হারুনের ভাতের হোটেলে; আয়নাঘরের টর্চার সেলে। কিন্তু চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা দাড়ি টুপিওয়ালা পুতুলের শিং এঁকে হেঁটে চলেছে। সেতো আটকে আছে ২০০৮ সালের গানের ওপারে।
আবিষ্কার করলাম, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করলেও; কয়েকজন আদুভাই এখনো ছবির হাট ছাড়েনি; মোয়ার জায়গায় পেস্ট্রি, রঙ চায়ের জায়গায় কফি এসেছে তার। যাদের কেউ ১৯৯০ সালে কোন আলোচনায় আমি বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করলে চোখ পাকিয়ে বলতো, শেখ মুজিব বলো হে; তারাই ফেসবুকে বঙ্গবন্ধুর জন্য কেঁদে আকুল। জয় বাংলা আর জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানের লাঠি হাতে লাটিমের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে শাহবাগ জুড়ে। এদের অনেকে যখন বলতো, সিরাজ শিকদারের মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়; আশংকা হতো একসময় এরা কোন একটি পক্ষে এক্সট্রিমিস্ট হয়ে উঠবে। তাই তো হয়; যারা রেগে রেগে ধর্ম, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদের ভাষণ দেয়; তারা ক্রমশঃ এক্সট্রিমিস্ট হয়ে যায়।
ফলে শুধু দাড়ি টুপি থাকলেই যে মানুষ জঙ্গী হয় তাতো নয়, রবীন্দ্র সংগীত শুনতে শুনতে ছবি এঁকেও মানুষ জঙ্গী হয়। ধর্মান্ধতা-মতান্ধতা-দলান্ধতা এসবই এক গোয়ালের গরু। আত্মপরিচয়ের সংকটে মওলানা ছগিরের ছেলে ইসলামপন্থী জঙ্গী হয়, পুরোহিত ধনঞ্জয়ের ছেলে হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী হয়, কেরানি বাসেত শিকদারের ছেলে প্রগতিশীল জঙ্গী হয়।
চারুকলার দলীয়করণ আমাকে বিষণ্ণ করেছিলো। শেখ হাসিনার ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রয়োজনে বাংলাদেশের মুক্তির নায়ক বঙ্গবন্ধু হয়েছেন হাসিনাৎসির টুল, উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন উগ্র বাঙালি জাতিয়তাবাদের অস্ত্র; সুতরাং প্রতিষ্ঠান বিরোধী চারুকলা আওয়ামী প্রতিষ্ঠানের দলান্ধতার নেশায় বুঁদ হয়ে শিল্পের স্বাধীনতার আত্মাহুতি দেবে; এতে আশ্চর্য হবার কি আছে!
জুলাই মাসের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে চারুকলা ভাইয়ের গাড়ির জানালার কাছে এসে অনির্বাণ বলেছিলো, তোমার তো আমাদের সঙ্গে থাকার কথা ছিলো বন্ধু। আমি তো হাসিনার গুলিতে মারা যাবো, আমার একটা গ্রাফিতি এঁকে দিও। গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে দিয়ে দ্রুত সটকে পড়েছিলো চারুকলা।
(ছবিতে বিশ্বখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।