মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ললিতাদি ফুলদানিতে ফুল সাজাতে সাজাতে বসে রবীন্দ্র সংগীত শুনছে,
হে ক্ষণিকের অতিথি,
এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া
ঝরা শেফালির পথ চাহিয়া ॥
এমন সময় ক্ষণিক সাদাত এসে পৌঁছে। গুড মর্নিং বলে সে সোফায় বসে। ললিতাদি আধো আধো বুলিতে সুবর্ণা মুস্তাফার মতো চোখ নাচিয়ে বলে, কিরে এই তোর আসার সময় হলো!
–সারারাত ফেসবুকে মৌলবাদিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি। খুব ক্ষিদে পাইসে দিদি।
বুয়া এসে দুটি সিদ্ধ গাজর আর দুই পিস ব্রেড দিয়ে যায়। সঙ্গে ব্ল্যাক কফি। খাবারের দিকে তাকিয়ে ক্ষণিকের কান্না পায়। কিন্তু কি করবে; ললিতাদিকে সবসময় ট্রেন্ডি থাকতে হয়। ইংরেজি মুভিতে যেরকম খাবার টেবিলে দেখে, দিদি ঐরকম করে টেবিল সাজায়। ফলে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির লুচি, সবজি, বুন্দিয়া; অথবা গরম খিঁচুড়িতে ঘি আর আচার হারিয়ে গিয়ে সেদ্ধ গাজর, দুই পিস ব্রেড হয়ে গেছে। কোথায় গেলে পাবে আর মশলা দেয়া চা। এখন ব্ল্যাক কফিতে সুগারলেস তেতো সকাল।
ফোনের দিকে তাকিয়ে খিল খিল করে হেসে ওঠে ললিতাদি। ক্ষণিক রাত জেগে ফটোশপ করেছে ভিন্নমতের লোকেদের মেয়েদের ছবি। কিন্তু তা দেখে ললিতাদির হাসি পাবে কেন! হয়তো কাভি খুশি কাভি গাম কালচার এটা। নারী ও পুরুষ উভয়ের চোখ রয়েছে ললিতাদির।
প্লাস সাইজের ওয়েস্টার্ন আউটফিট চড়িয়ে আনারকলি আসে। কুসুমকলি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী আনারকলি স্কলাসটিকার বার্গার ছাত্রী সেজে ঘুরে। সে এসে ললিতাদি ও ক্ষণিককে হাগি দেয়। পকেট থেকে একটা কিটক্যাট চকোলেট বের করে ক্ষণিককে দেয়। ললিতাদি অত্যন্ত ডায়েট সচেতন। মিষ্টি তার চোখের বিষ। তার ভালো লাগে তেতো জিনিস। আনারকলি ক্ষণিককে বলে, তোর একটা ট্রিট পাওনারে। তুই রাতে যে গালি দিয়েছিস স্বাধীনতার শত্রুদের। ক্রিয়েটিভ ছেলে যে তুই।
ক্ষণিক তার খোলা চুল গুছিয়ে একটা পনিটেল করে জন লেননের মতো ভাব নিয়ে বসে। দু’চারটে ইংরেজি শব্দ রপ্ত করেছে। ফলে কথা শুনলে মাঝে মাঝে বোঝা কঠিন হয়, সে কোন কাননের ফুল।
এসে পৌঁছে বাল্টন লাল; ঘরে ঢুকতেই একটা বোঁটকা গন্ধ আসে। ললিতাদি নাক কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কিরে বাল্টন চান করা ছেড়ে দিয়েছিস নাকি!
–হ্যা দিদি, মৌলবাদীদের পতন না ঘটা পর্যন্ত আমি চানও করবো না, দাঁতও মাজবো না।
আনারকলি এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করে বাল্টনের সুগন্ধ দূর করে। কিন্তু যখন বাল্টন কথা বলে, মনে হয় নর্দমার খোলা হাওয়া এসে লাগছে। এ কারণে ফেসবুকে বাল্টন মুখ খুললে, সেখানে লোকজনের পক্ষে টেকা দায় হয়ে পড়ে।
আজ ললিতাদি একটা মিটিং কল করেছে। ফেসবুকে কাকে গালি দিতে হবে, কার মেয়ের ফটোশপ করতে হবে, সেসব ঠিক করে দেবে সে।
সবশেষে সহমত ভাই ও শিবব্রতদাদা এসে পৌঁছে। তাদের দুজনের চোখ গম্ভীর। ৫ অগাস্টের পর তারা এখনো মাফলারে মুখ ঢেকে; কভিডেরকালে কেনা মাস্ক পরে ঘুরছে।
শিবব্রত দাদা, কাঁধের ঝোলা থেকে চারটে মাস্ক বের করে ললিতাদি, আনারকলি, ক্ষণিক ও বাল্টনকে উপহার দেবার সময় বলে, যদি বইমেলায় যাও; অবশ্যই পরে যেও। দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষ নিঃশ্বাস।
আনারকলি বলে, যে বইমেলায় নোংরামি হয় সেখানে আর যাবো না। অসভ্য ও রুচিহীনদের মেলা ওটা। হুমায়ূন আহমেদ মরে বেঁচেছেন। নইলে মেলায় এসব ইতর কান্ড দেখলে সহ্য করতে পারতেন না।
ক্ষণিক তার তৈরি করা একটা ফটোশপ এপ্রুভালের জন্য শিবব্রতদাদাকে দেখায়। দাদা মুচকি হেসে বলে, এ যে দেখছি পিনোন্নত রসভরী। শাস্ত্রে এমন নারীকে বলে হস্তিনী। এ চিত্র চলবে মানে! দৌড়াবে হে!
শাস্ত্রের কথা শুনলেই মুগ্ধ চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সহমত ভাই, কত কিছু জানে দাদা; সে পোচন্ড জ্ঞানী লুক।
আজ বাসায় ক্ষণিকের ছেলেরা উপস্থিত হয়েছে বলে ললিতাদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হে ক্ষণিকের অতিথি গানটা শুনছে। শিবব্রত দাদা বলে, রাগ ভৈরবী, তাল কাহারবা।
সবার চোখে মুখে মুগ্ধতার রেশ। শিবব্রত দাদা উঠে গিয়ে ফুলদানির ফুলের সুবাস নেয়। বলে, আহা রজনীগন্ধার কি সুবাস। ও বাবা আবার দেখি হাস্না হেনার গন্ধ আছে ঘরে। আনারকলি বলে, ওটা এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। বাল্টন একটু কুঁকড়ে বসে।
শিবব্রত দাদা, ফুলদানির একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে। লিখে দেয়, অন্তর মম বিকশিত করো।
বাল্টন চ বর্গীয় গালি দেয়া একটা পোস্ট শিবব্রত দাদাকে দেখায় পোস্ট করার আগে। দাদা বলে, সব ঠিকই আছে, একটু হিজবুত শব্দটা জুড়ে দিও শত্রুদের নামের আগে।
ললিতাদি বাল্টনের পোস্টটা দেখে বলে, ব্রিলিয়ান্ট পোস্ট লিখসিস বাল্টন। চান করে এলে তোকে হাগি দিতে পারতাম।
এমন সময় ললিতাদির বারান্দার তোতা পাখিটি বলে ওঠে, গুড মর্নিং। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে গিয়ে পাখির খাঁচার চারপাশে ঘিরে দাঁড়ায়। পাখিটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, গেট লস্ট।
শিবব্রত দাদা পাখির মানভঞ্জনে গেয়ে ওঠে,
পাখি রে, তুই খাঁচা ভেঙে আমার কাছে আয়
চোখের মণি চোখের কাছে না থাকলে
মনটা আমার আকুল হয়ে মরে যেতে চায়।
পাখিটা এবার বলে, শাট আপ; তুই কোলাবরেটর।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।