মাসকাওয়াথ আহসান
চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলেছেন, সিমপ্লিসিটি ইজ দ্য আল্টিমেট সফিস্টিকেশন। আজ তারেক মাহমুদের মৃত্যুর খবর পেয়ে কেন যেন বারবার তার সিমপ্লিসিটি আর সফিস্টিকেশানের কথাই মনে পড়ছে। আমাদের সেই তরুণ বেলার আজিজ সুপার মার্কেট, চারুকলা অনুষদ কিংবা সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রায় প্রতিদিন দেখা হওয়া একটি উজ্জ্বল মুখ এই তারেক মাহমুদ। তাকে হাসিমুখে ছাড়া কখনো দেখিনি আমি। ঢাকার সোনালী যুগের বোহেমিয়ানরা গৃহস্থ হলে; যে ক’জন তরুণ ” বাউল কখনো গৃহস্থ হয় না” আপ্তবাক্যের ধণুক ভাঙ্গা পণ করেছিলেন, তারেক তাদের একজন; আরেকজন তারেক ছিলো যে সিনেমা নিয়ে আলাপ করতো দেখা হলে; সেও মারা গেছে কিছুকাল আগে।
এই যে টাকানগরী, যেখানে হাতের আঙ্গুলে অষ্টধাতুর আঙ্টি পরে টেকাটুকার ধান্দায় ঘুরে অসংখ্য জটিল পিঁপড়াবিদ্যা জানা তরুণ; সেইখানে তারেক মাহমুদের সফিস্টিকেশন খুঁজে পাওয়া যায়; তার সিম্পিলিসিটিতে। সরলতা, অহিংস মনোজগত, শিল্প-তৃষ্ণা আর সৃজনশীলতার আনন্দভূক এমন তরুণদের এ শহর বাঁচিয়ে রাখে না। এখানে শোবিজের গেম অফ থ্রোনসে কেবল তেলাঞ্জলি নির্ভর মিডিওকারের রাজত্ব।
ইদানিং আমি ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের আইরনি নিয়ে কিছু লেখালেখি করছি; কিন্তু তবুও বলতে হচ্ছে, কোলন, বার্লিন, প্রাগ, প্যারিসে তারেক মাহমুদের মতো তরুণদের জন্য রাষ্ট্রের কল্যাণ প্রকল্প দেখেছি। যে ছেলেটা দ্রোহী হয়ে এখানে-ওখানে ইতস্ততঃ গ্রাফিতি এঁকে বেড়ায়; রেল বিভাগ তাকে স্কলারশিপ দিয়ে রেলস্টেশনের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকার প্রণোদনা নিয়ে আসে। যে ছেলেটা পথনাটক করে; তাকে সংস্কৃতি দপ্তর থিয়েটার দল গড়ার অনুপ্রেরণা দেয়; যে ছেলেটা পথের পাশে গান করে, শহরের মেয়র তাকে কনসার্টের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে। শিল্পভূক তরুণদের দিকে কল্যাণরাষ্ট্রের এরকম সুনজর চোখে পড়েছে। ফলে আজও লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হবার স্বপ্ন দেখতে পারে ইউরোপের বোহেমিয়ান তরুণেরা।
কিন্তু আমাদের জিডিপি সাম্রাজ্যে দলের স্তুতি, দলীয় মাজার-ভিত্তিক ভক্তিশিল্প, উন্নয়নের বিজ্ঞাপনে কমপ্লেক্স তরুণদের খুঁজে খুঁজে বের করা হয়। ফলাফল তাদের আচরণ ও কাজের আনসফিস্টিকেশন। যেন থাগস অফ বেঙ্গলের জিন-মানচিত্র খুঁজে খুঁজে এ টাকা নগরীর পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি দেয়া হয়।
তাই এ শহরে যখন সহজ-সরল উতকৃষ্ট জিনের তরুণদের দেখেছি; অজানা আতংকে মন বিষাদ্গ্রস্ত হয়েছে। মনে পড়েছে জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর কথা, আবুল হাসান ও রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার অকাল প্রয়াণের কথা। এই সমাজ কতটা স্থূল ও নিষ্ঠুর হলে, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান লেখককে বলতে হয়, ভাতের সংস্থান করে তবে লেখালেখি করতে এসো।
এই যে ভাত-সভ্যতা; এই যে প্রতারক রাজনীতিক ও তাদের মোসাহেবের দোজখ, এই যে সমানুভূতিহীন নরভোজী পল্লী; সেইখানে তারেক মাহমুদ তার সরলতার কারণে শোবিজের সাইডলাইনে চলে যান। শোবিজ মাতাতে থাকে বোধ বুদ্ধিহীন কপি ক্যাট আর ভাঁড়েরা।
মিডিয়া হাউজগুলোর শীর্ষপদে সেই সোনালী যুগের মতো মেধাবী মানুষেরা আর অধিষ্ঠিত হননা। অষ্টধাতুর আংটি পরা, চুলে কলপ করা, ছদ্মবুদ্ধিজীবীর মতো চশমা পরা, “প্রশ্ন নয় প্রশংসা করে এসেছি”-র মিডিয়া ব্যাপারী ও মিডিয়া মজিদেরা পেটে বাতাবি লেবুর মতো ফেঁপে ওঠা চর্বি নিয়ে ঘুরে। কে কতটা ধূর্ত কে কতটা কায়দা করে ও চালবাজি করে ঘুরতে পারে; তারওপর নির্ভর করে এই বোয়ালমারী ও চিতলমারীর আড়তে কথিত সাফল্য।
ফলে তারেক মাহমুদকে দেখলেই আড়তদারদের মনে হয়, সে তাদের মতো ধূর্ত ও চালবাজ নয়। সুতরাং তাকে দিয়ে ওদের পারপাস সার্ভড হবে না।
তারেক মাহমুদ কখনো তেলাঞ্জলি দেয়া কিংবা বসকে খুশি করা রাশির লোক ছিলেন না। ফলে তিনি এই ফোকলোর মেট্রোপলিটনে মিসফিট ছিলেন।
ফেসবুকে মিডিয়া পাড়ার লোকেরা শোক জানাতে যতটা পারঙ্গম, কাউকে সহযোগিতা করতে তেমনটা নন। সে কারণে হরিদাসপুরের আকাশ-বাতাস মথিত করে “ঠিক কারো মৃত্যু খবরে” এই মরাকান্দন এতোটুকু স্পর্শ করে না। এই তো কিছুদিন আগে তারেক মাহমুদের মিসকল দেখুন জমা হয়ে আছে আপনার ফোনে। আপনি যেহেতু একই সঙ্গে হোয়াইট হাউজ ও ক্রেমলিন চালানোর মতো ব্যস্ত; যারে দিয়া আপনার কাম হবে না; তার ফোন ধরেন না আপনি।
হলো তো পনেরো বছর অনেক হ্যা হ্যা করে হাসা; অনেক পাওয়ারের লোকের জন্মদিনে পুষ্পমাল্য আবেগ ও স্তুতি দিয়ে ভ্যা ভ্যা করা হলো তো। আবার ক্ষমতাহীন সূতা ছেঁড়া ঘুড়ির মৃত্যুতে ভেউ ভেউ করতে হবে কেন বলুন তো! সহমত ভাই ছাড়া কাকপক্ষীও বসে না; লাইক কাউন্টার বন্ধ রাখতে হয়েছে; সেইখানে তারেক মাহমুদের মতো মৌলিক মানুষের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে লাইকের দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে চাওয়া এইতো! জীবনে যারে তুমি দাওনি মালা, মরণে তারে কেন দিতে এলে ফুল!
এই কারণে সিম্পল ও সফিস্টিকেটেড তরুণেরা এই মিডিওক্রেসির দোজখ থেকে পালাতে চেষ্টা করে; আর দু’চারটি ক্ষমতাভাঁড় আবার বুদ্ধিজীবী সেজে কলাম লেখে “ব্রেনড্রেন” বা “মেধাপাচার” নিয়ে। যাদের বুদ্ধিমাছের পচাগন্ধে টিকতে না পেরে হয় তরুণেরা বিদেশে চলে যাচ্ছে; অথবা তাদের জন্য তারেক মাহমুদের মতো মৃত্যুশয্যা প্রস্তুত হচ্ছে; তারা যেন জানে না; এই তারাই এই চারপাশের তারেক মাহমুদদের বাতিগুলো নিভে যাবার কারণ। মেধার মার্কেট তেল দিয়ে ডাম্প করলে; কোয়ালিটি সম্পন্ন মানুষেরা সেখানে বাঁচবে কেমন করে!
এই নিষ্ঠুর পুলিশ নগরী, যেখানে প্রবেশ পথে নাতসিরা এসে দেহ ও মোবাইল ফোন তল্লাশী করে; যেখানে নিজের পেছনটা বাঁচাতে মিডিওকার সওদাগর এতো নীচে নামতে পারে যে অধোঃগমনের কোন সংজ্ঞা হয় না।
সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া মানে সব যন্ত্রণার অবসান। এই ঠগীতে গিজ গিজ করা ক্ষমতাপট্টির ব্রোকারদের ধাক্কায় তারেক মাহমুদ যেন তার সেই বইয়ের ঝোলা, প্রিয় একটি বাঁশী আর কখনো দুটি কদম ফুল কিংবা হাসনাহেনা নিয়ে প্রবেশ করেন অনন্তলোকে; ঔদার্য্যের উঠোনে; যেখানে গোপালভিলেজের অনৈতিকতার বোটকা দুর্গন্ধ নেই; জটিল মনের ঐ গলায় ফাঁস দেয়া রুমাল নেইও।
হয়তো এই প্রতিদিনের চালিয়াতের পেছনে ছুরি চালানো; প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কদর্য কালচার ছেড়ে; তারেক মাহমুদ একটা প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেবার উদ্যান চেয়েছিলেন; সেখানে সরলতা আর আভিজাত্য আছে। আমি ঠিক জানি তারেক মাহমুদের আত্মা ঠিক সেইখানে পৌঁছে গেছে। চাওয়ার মতো করে চাইলে মানুষ ঠিক তা পায়।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।