ফারদিন ফেরদৌস
আজকের বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ধারণ করবার যোগ্যতা, সক্ষমতা বা আন্তরিকতা রাখে? এক কথায় উত্তর হলো না। বাংলাদেশে নজরুল চিন্তা দ্বিধারায় বিভক্ত। অতি ধার্মিকরা নজরুলকে মুসলিম কবি পরিচয় দিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভোগে। ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘হেরা হতে হেলেদুলে নূরানী তনু’ কিংবা ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ যিনি লিখতে পারেন তিনি নিখাদ মুসলিম না হয়ে পারেনই না।
অপরদিকে অতি প্রগতিশীল যারা তারা নজরুলকে উত্তরাধুনিকতার চূড়ায় তুলে রাখেন। তারা বলতে চান সেক্যুলারিজম নজরুল ছাড়া আর কে বুঝেছেন? ধর্মের শেকল কে এমন করে ভাঙতে চেয়েছেন?
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল!
মূর্খরা সব শোনো,
মানুষ এনেছে গ্রন্থ;
গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।…”
এখনও মানুষ নজরুলকে নিয়ে আলোচনাটা সর্বজনীনতা পেল না।
যিনি কিনা এত সুন্দর করে ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান রচনা করেছেন কবিতায় গানে, তাঁকে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত করবার মানস বড় সেকেলে। নজরুল না উত্তরাধুনিক, না প্রাচীনপন্থি। তাহলে নজরুল কী? এক কথায় উত্তর হলো কবি নজরুল সর্বকালের সমসাময়িক মানুষ। মনুষ্যত্ববোধের মহত্তম পরাকাষ্ঠা নজরুল দেখিয়েছেন। তাঁকে মহিমান্বিত মর্যাদায় চিনে নেয়ার দায় বর্তমান মানুষের।
নজরুল ও প্রমীলার কালজয়ী প্রেম-প্রণয় ইতিহাসের অনন্য আখ্যান।ভিন্নধর্মী আশালতা সেনগুপ্ত তথা প্রমিলা দেবীর সাথে সুখের সংসার রচনা করতে কবিকে দ্বিতীয় ভাবনা কোনোদিন তাড়িত করেনি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর চার পুত্রের নাম রেখেছিলেন যথাক্রমে কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।
এইসময় যদি কোন বাবা তার সন্তানের নাম কৃষ্ণ মুহাম্মদ রাখতেন, তাহলে তার পরিণতি কী হতে পারে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অথচ অসামান্য অসাম্প্রদায়িক নজরুল আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেই এই সাহস দেখিয়েছিলেন, ধর্মের নামে কুসংস্কার ও অন্ধত্বের বিভেদ দূর করতে অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়ে গেছেন যতক্ষণ পেরেছেন!
তাঁর “মানুষ” কবিতায় সেই অসামান্য দৃঢ় উচ্চারণ আজও জাজ্বল্যমান…
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
কবি আরও লিখেন…
আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা’বলে বন্ধ করনি প্রভু
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি!’
কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রেষ্ঠতম মানবিক বাণীই যেন কবি নজরুলের আরাধ্য ও প্রেরণা।
বস্তুত ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ -কালের চিরায়ত এই অমৃত বাণীটি প্রচার করায় কবি নজরুলের সময়কালেও নানা ধরনের নোংরামি আর কুৎসার শিকার হতে হয়েছিল তাঁকে। কবির কপাল ভালো তিনি এ সময়ে জন্মাননি। তাহলে হয় তাঁকে বেঘোরে মারা পড়তে হতো, নাহয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন মেনে নিতে বাধ্য হতেন কবি!
সভ্যতার ধারাবাহিকতায় আধুনিক কাল এখন। এই আধুনিকতা মানুষকে সহনশীলতা শেখানোর কথা। কিভাবে অন্যের শোকে মর্মাহত হওয়া যায় সেই উপলব্ধি অর্জন করবার কথা। মানবিক মানুষ হয়ে উঠবার মন্ত্রণা পাওয়ার কথা। আষ্টেপৃষ্ঠে ঔদার্য ও সংযম অর্জন করবার কথা।
কিন্তু আমরা সেগুলোর কোনটা তো আত্মস্থ করতে পারিইনি, বরং একজন অসাম্প্রদায়িক ‘মানুষ’ নজরুলের উত্তরসূরী হয়ে সবার উপরে মানুষ সত্যের বদলে উগ্র ধর্মান্ধতাকে সত্যি মেনে সর্বমানুষের উপর চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করছি। সদলবলে এগিয়ে চলছি এক অন্ধকার গহ্বরের দিকে। অতল নিমজ্জনের দিকে।
স্বতন্ত্র ভাষাশৈলি, মানবীয় আবেগ, প্রেম ও তুমুল বিদ্রোহের কবি নজরুলকে নির্দিষ্ট একটি বলয়ে যেমন আটকে রাখবার জো নেই, তেমনি নজরুলকে পাশ কাটানো কিংবা ভুলে যাওয়ারও দিন ফুরিয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, মানবাধিকার, প্রেম, ভালোবাসা, ধর্ম, দর্শন, হামদ, নাত, শ্যামাসংগীত ও সৌন্দর্য; কী নেই নজরুলের ভাবনায়?
কথিত মানুষের সমাজে হাজার অনৈতিকতা যেখানে রোজকার চর্চার বিষয়, সেখানে এমন সত্য, সুকুমারবৃত্তি ও সুন্দরের পূজারী নজরুল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। তাঁর বাণীর প্রতিটি অক্ষর মানুষকে যথার্থ উপলব্ধি ও বোধ জাগানোর দিশা দিতে হয়ে আছে অনন্য আলোকবর্তিকা।
আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভুলব না। ভুলতে পারি না। কবিও এটা নির্ঘাত জানতেন। তাই তো কাব্যের রস কিংবা গানের সুরে কবিকন্ঠ উচ্চকিতই থাকবে কাল থেকে কালান্তর। আমাদের সমন্বিত ভালোবাসার সুরের নেশায় যখন আকাশ ঝিমাবে, কাঁদবে পবন; তখন আমাদের বক্ষে রোদন হয়ে দুলতে আসবেন কবি। প্রাণ উজার করা কারুণ্য নিয়ে কবি গাইবেন…
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।”
১২৫তম জন্মজয়ন্তীতে সাম্যবাদের আইকন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পূণ্য স্মৃতির প্রতি জানাই অতল শ্রদ্ধা। প্রার্থনা করি, কবি নজরুল থাকুক আমাদের রোজকার চর্চার সত্য ও সুন্দরে।
ফারদিন ফেরদৌস, লেখক, সাংবাদিক।
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ | ২৫ মে ২০২৪