মাসকাওয়াথ আহসান
শেখ হাসিনা সিল্ক শাড়ি পরে এমনভাবে উদ্ভাসিত, এ যেন “আইরন ফিস্ট ইন আ ভেলভেট গ্লাভ”। কোমল হাত মোজার নীচে কতৃত্ববাদের লৌহ মুঠো।
গত দুটি নির্বাচন এমেরিকা ও ইইউ-এর চোখে সুষ্ঠু নয়।
সন্দেহজনক মামলায় বিএনপি নেত্রী কারা-অন্তরীণ ও অসুস্থ। প্রায় ৪০ লাখ মামলা করা হয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।
প্রতিহিংসা পরায়ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাঝ দিয়ে আসন্ন নির্বাচন হতে যাচ্ছে “স্বৈরশাসক হিসেবে হাসিনার অভিষেক”। স্বৈরশাসনের মুকুটে চূড়ান্ত পালক লাগার ব্রান্মমুহূর্ত যেন।
বিএনপি নেতা মীর্জা ফখরুলের বিরুদ্ধে ৯৩ টি মামলা করা হয়েছে। নয়বার কারাগারে গেছেন উনি। সরকার বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার করে চলেছে।
পশ্চিমের কাছে বাংলাদেশ দুটো কারণে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ শান্তি মিশনে সেনা যোগান ও এমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক মহড়ায় নিয়মিত অংশগ্রহণ।
বাংলাদেশে এমেরিকার সরাসরি বিনিয়োগ সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রপ্তানী বানিজ্যের গন্তব্য এমেরিকা।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়াকে পশ্চিমা দেশগুলো সাধুবাদ জানিয়েছিলো। কিন্তু পরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা সুযোগ দিতে ও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে হাসিনা প্রশাসন।
ডেসপটিজম বা স্বৈরব্যবস্থায় উপনীত হওয়ায় এমেরিকার গণতন্ত্র সম্মেলনে গত দুবার বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
গত মে মাসে এমেরিকা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করবেন এমন ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, এমেরিকা গণতন্ত্র নির্মূল করে তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়।
চীনের নিকট প্রতিবেশী হিসেবে একদলীয় ব্যবস্থায় না গিয়ে বাংলাদেশ যেন গণতান্ত্রিক দেশ থাকে, সেই লক্ষ্যে এমেরিকা তার ডেমোক্রেসি পলিসির টেস্ট কেস হিসেবে বাংলাদেশকে গ্রহণ করেছে।
কিন্তু এসব উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে; হাসিনা ক্ষমতায় থেকে যেতে সম্ভব সবকিছুই করবেন।
বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ বলে পরিচিত হলেও সাবেক সেনাশাসক এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করায়, ধর্মীয় কট্টরপন্থার সুযোগ খোলা রয়েছে।
বাংলাদেশের দুটো পরিবারের দুই মহিলা তিক্ত এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। এরা উভয়েই মুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ পরিবারের ভূমিকা বড় করে অপরকে খাটো করার প্রতিযোগিতা করেছেন। পরিবারতন্ত্রের এই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিষময় ফল বয়ে এনেছে জনজীবনে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, শুধু নির্বাচনই তো সমস্যা নয়; নির্বাচনকে ঘিরে ও এরপরে যে পরিবেশ তৈরি হবে; তা উদ্বেগের ব্যাপার।
কেয়ার টেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে হাসিনার হেরে যাবার আশংকা রয়েছে; আর উনি নিজের সব সেইফ এক্সিট বন্ধ করায় ক্ষমতায় না থাকা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
বিএনপি রক্ষণশীল দলগুলোর সঙ্গে সখ্য রাখায়, শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ বিরোধী অভিযানের অজুহাতে কাউন্টার টেরোরিজমকে ব্যবহার করেছেন নিজ শাসনকে পাকাপোক্ত করতে।
নোবেল বিজয়ী ইউনুসের বিরুদ্ধে ১৭৪ টি মামলা হাসিনা সরকারের প্যারানয়ার ফলাফল। বিশ্বের ১৭০ জন কৃতি ব্যক্তি ইউনুসের বিরুদ্ধে চলমান নিগ্রহ অবসানে হাসিনার কাছে চিঠি লিখলেও তিনি এতে কান দেননি।
শেখ হাসিনা দাবি করেন তিনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করেছেন। কিন্তু দেখা যায়, দেশটির অর্থনীতি রেমিটেন্স, কৃষি আর সস্তা শ্রম ভিত্তিক পোশাক রপ্তানীর ওপর নির্ভরশীল। ওপর থেকে অর্থনীতির সবকিছু মসৃণ দেখালেও ভেতরটা দুর্বল। আর এই যে বলা হয়, দেশ অনুন্নত থেকে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল হবে; এখন অনুন্নত বলতে এ এলাকায় কেবল আফঘানিস্তান, কম্বোডিয়া, মায়ানমার রয়ে গেছে। আর দুর্নীতি সূচকে বিশ্বের ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ্র অবস্থান ১৪৭। ইরানের সমান আর আফঘানিস্তানের চেয়ে এক ধাপ ওপরে; এরকম একটি চিত্র পাওয়া যায়, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে।
হাসিনা সরকার বলতে চেষ্টা করেন, বস্তির কথা বাদ দাও। দেখো আমাদের গ্রামগুলো কত উন্নত হয়েছে। তাই যদি হবে তাহলে প্রতিদিন ২০০০ লোক গ্রাম ছেড়ে শহরে আসে কেন। মুদ্রাস্ফীতি যে জায়গায় পৌঁছেছে, মুদ্রা সংকট যে জায়গায়, রিজার্ভ সংকট দৃশ্যমান। এমেরিকা তাই অন্য দেশে বিনিয়োগের গন্তব্য খুঁজছে।
হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে, দেশে তার সরকারের মানবাধিকার লংঘনের ব্যাপারগুলো পশ্চিমারা খানিকটা ওভারলুক করেছিলো। কিন্তু সেই মানবাধিকার লংঘনের মাত্রা দৃষ্টিকটুভাবে সীমা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ এমেরিকা ও চীন-ভারত-রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। সেক্ষেত্রে এমেরিকা বেশি চাপাচাপি করলে বাংলাদেশের চীনের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়ার আশংকা আছে।
শেখ হাসিনা মাত্র দু’ঘন্টার সাক্ষাতকারে বারোবারেরও বেশি বাবার প্রসঙ্গ এনেছেন। তার কোন পলিসির সমালোচনা করলেই তিনি তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, যা-ই করুন, কিছু লোক এর সমালোচনা করবেই। সাইবার সিকিউরিটি এক্টের ভয়াবহতা নিয়ে প্রশ্ন করলেও তিনি তাই বলেছেন। যে কোন কঠিন প্রশ্নে “বটমলেস ওয়েল অফ ফ্যামিলি ট্রমা’তে উনি আলোচনাকে নিয়ে যান। অথচ উনি তার পরিবারের বিরুদ্ধে যে অন্যায় হয়েছে বলে অভিযোগ করেন; একই অভিযোগ তার বিরুদ্ধে তার শাসনামলে নির্যাতিতদের।
শেখ হাসিনা কাল্ট অফ মুজিব তৈরি করেছেন।সর্বত্র তার ছবি। এমনকী বিমানবন্দরে যাত্রী অপেক্ষার স্থানে আটকে থাকা যাত্রীদের অনেকটা যেন জোর করে তার বক্তৃতার ভিডিও দেখানো হয় জায়ান্ট স্ক্রিনে। মুজিব গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করেছিলেন, শেখ হাসিনার শাসনকে বাকশাল টু পয়েন্ট ও বলে সমালোচকেরা।
শেখ হাসিনা যখন বলেন, একেকদেশের গণতন্ত্র একেকরকম; নির্বাচন সামনে রেখে সেটা কোন আরামদায়ক মন্তব্য মনে হয়না। উনি বলেন, গণতান্ত্রিক পথে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না; অন্য কোন ভাবে সরালে সরাক। আমি মৃত্যুকে ভয় পাইনা।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।