মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ইনডিজিনাস স্টুডেন্টদের ওপর স্টুডেন্টস ফর সভরাইনটি নামের একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠনের হামলা জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে অগ্রহণযোগ্য একটি ঘটনা। সন্দেহভাজন দু’জন হামলাকারী গ্রেফতার হয়েছে। বৃহত্তর তদন্তে নিশ্চয়ই এদের পরিচয় বেরিয়ে আসবে। এই হামলাকারীরা, তুমি কে আমি কে বাঙালি শ্লোগান দিয়ে হামলা চালায়। হামলার সময় ক্রিকেট স্টাম্পের সঙ্গে জাতীয় পতাকা বেঁধে তারা হাজির হয়। তাদের সম্পর্কে এর বেশি তথ্য এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কারো কাছে নেই। আশা করা যাচ্ছে দ্রুত এদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেয়া হবে। উগ্রজাতীয়তাবাদের এই রক্তাক্ত শো ডাউনের শাস্তি না হলে ভবিষ্যতে এরকম ভুঁইফোঁড় সংগঠনের আত্মপ্রকাশ বন্ধ করা যাবে না।
ইনডিজিনাস ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলার পর স্টুডেন্টস ফর সভরাইনটির সন্ত্রাসীদের “শিবির” বলে তকমা দিয়ে দেয়া হয়। এই শিবির তকমাটি আওয়ামী সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। ভারতীয় মিডিয়ার বাংলাদেশ বিষয়ক অপপ্রচারের ক্যাচওয়ার্ডও হচ্ছে জামায়াত শিবির। বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে জামায়াত গড়ে দুই-তিনটির বেশি আসন না পেলেও আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় মিডিয়ার তকমা শুনলে মনে হবে; এরা খুব জনপ্রিয় কোন রাজনৈতিক দল। ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি অত্যন্ত জনপ্রিয় বলেই; বাংলাদেশে জামায়াত জনপ্রিয় ন্যারেটিভটি তৈরি করতে হয় কিনা; তা ঠিক নিশ্চিত নই। এই প্রচার প্রচারণায় ইদানিং জামায়াতেরও ভ্রান্ত অধ্যাস হয়েছে যে, তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
স্টুডেন্টস ফর সভরাইনটি স্বনামে অপরাধ করেছে। সুতরাং স্টুডেন্টস ফর সভরাইনটির তীব্র সমালোচনা করাই যৌক্তিক। কিন্তু তাদেরকে শিবির বানিয়ে ফেসবুকে মাতম তোলার উদ্দেশ্য কি তা বোঝা দরকার। আর যে আওয়ামী লীগ তার শাসনামলে ইন্ডিজিনাসের বাংলা অনুবাদ আদিবাসী গ্রহণ করতে রাজি হয়নি; পতনের পর সেই আওয়ামী লীগ কর্মীরা যখন এসে আদিবাসীর জন্য কান্না জুড়ে দিয়ে স্টুডেন্টস ফর সভরাইনটিকে শিবির তকমা দিয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়তে থাকে তখন একে উদ্দেশ্যমূলক মনে হয়। ভারতের মিডিয়ার প্রোপাগান্ডাকে এপাশ থেকে সাবস্ট্যানশিয়েট করার আয়োজন বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের খুব সাধারণ মানুষ; যারা লিবেরেলিজম-সেকুলারিজম ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে পরিচিত নয়; তারা কার্যত লিবেরেল জীবন যাপন করে। এ কারণে বাংলাদেশে জামায়াত কখনোই জনপ্রিয় হতে পারেনি। জামায়াত টিকে আছে আসলে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞাপনে।
এখন বোঝা দরকার একটু শিক্ষিত হলে, বৃটিশ আমলের জমিদারদের মতো পোশাক পরলে, অমন করে টিপে টিপে প্রমিত বাংলা বলতে শিখলেই কেন জামায়াত ও শিবিরকে খুঁজে বের করে গালাগাল করতে হয়। আসলে বৃটিশদের কপি করে যে নতুন আধুনিকতা; তা যথেষ্ট আধুনিক হতে না পারায়, তাকে সুপিরিয়র সাজতে কাউকে ইনফেরিয়র বলে সাব্যস্ত করতে হয়। বংকিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজে সুপিরিয়র সাজতে যেমন ইনফেরিয়র হিসেবে পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বামদলগুলো বাংলাদেশের আর্য হিসেবে আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে অন্যদের অনার্য হিসেবে ডিহিউম্যানাইজ করতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ বা বামদলের তরুণ বা তরুণী হত হলে তা প্রজাপতির হত হওয়া; আর অন্য দলগুলোর তরুণ বা তরুণী হত হলে তা তেলেপোকা মারার আনন্দ; এইভাবে গড়ে উঠেছে ছদ্ম অভিজাত একটি কথিত সাংস্কৃতিক মনন। কাউকে ছোট করে বড় হতে হয় তাদের; যাদের নিজেদের গঠন প্রক্রিয়ায় ক্ষুদ্রত্ব আছে।
এই অপরায়নই বাংলাদেশ সমাজের মূল সমস্যা। ঐ যে পূর্ববঙ্গের কৃষক-কারিগরকে ছোটলোক তকমা দিয়ে বৃটিশের কোলাবরেটর যে নব্য কিছুটা ধনী ও কিছুটা শিক্ষিত লোক বাবু সেজে বসেছিলেন; ঐ বাবু স্বপ্নই কাল হয়েছে বাংলাদেশ সমাজে। যে কারণে জুলাই আন্দোলনে শহীদ তরুণ-তরুণীদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামা ও খালাদের কোন অনুতাপ নেই; বরং শহীদ আবু সাঈদ শিবির করতো, অতএব তেলাপোকার মৃত্যু হয়েছে; প্রজাপতি মরেনি; এমন একটি প্রচারণা তাদের। বামেরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত তরুণদের পাশে দাঁড়ালেও; তাদের সাংস্কৃতিক বৈঠকখানাটি সেই বাবু কালচারের; ফলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাংস্কৃতিক নেমন্তন্ন খেতে হয় তাদের। ফলে তাদেরকেও অনার্য মুসলমানই সব সমস্যার মূলে; এই ন্যারেটিভে তাল মেলাতে হয়। এই আনস্মার্ট লিবেরেলিজম উদারপন্থী সমাজ গড়ার পথে বড় একটি সমস্যা।
ইউরোপের সমাজে বাংলাদেশের একজন শ্রমিককে সাম্যের চোখে দেখা হয়। ইউরোপীয়দের সঙ্গে তাদের চমতকার সখ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে একটু শিক্ষিত বাবু হয়ে ইউরোপে গেলেই তারা শ্রমিকদের এড়িয়ে চলে। মানুষের কটা ডিগ্রি কটা রবীন্দ্র-নজরুল সংগীত শুনেছে দেখে মেশার এই চল পৃথিবীর আর কোন দেশের মানুষের মধ্যে নেই। যে কলকাতার কল্পনা নিয়ে ঢাকাই বাবু কালচার গড়ে উঠেছে; সেই কলকাতার লোকও এতো শ্রেণী সচেতন নয়। এই ফাঁপা উন্নাসিকতাই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মভাব প্রবল করেছে।
কেবল সভ্য-সাম্য চিন্তাই পারে এই আউটডেটেড সংস্কৃতি মামা ও খালাসমাজকে বৈশ্বিক সভ্যতার ধারায় যুক্ত করতে। বাংলাদেশ সমাজে বাউল ও সুফি ভাব প্রবল। ফলে মানুষের মনোজগতে কোমল ইসলাম বিরাজ করে। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতিকে ঢাকার প্রগতিশীল সংস্কৃতি হিসেবে নির্মাণের বিপরীতে একসময়ের সৌদি কঠোর ইসলামের সংস্কৃতি বাংলাদেশে প্রসার লাভ করেছে। সেই সৌদি আরবই যেখানে কোমল ইসলাম চর্চা করছে; ফলে বাংলাদেশে কঠোর ইসলামের যে আর কোন ভবিষ্যত নেই; এ তো বলাই বাহুল্য।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।