মাসকাওয়াথ আহসান
কী রঙ আহা কী উজ্জ্বলতা
দিল্লির সিং হাসনে সুলতান আসে সুলতান যায়; কিন্তু আমির খসরুর কবিতার বাদশাহী চলতে থাকে প্রেমের দোর্দণ্ড প্রতাপে। খসরুর লেখা গুররাত উল কালাম বা উতকর্ষের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তার ৩৪ থেকে ৪১ বছর বয়সের মাঝে লেখা কবিতা সমগ্র নিয়ে লেখা। বাউল কখনো গৃহস্থ হয়না। তবে কবিতার সঙ্গে খসরুর ঘর সংসারে পাকা গৃহস্থালীর চিহ্ন ফুটে উঠতে থাকে।
ফিরুজ শাহ খিলজির মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খিলজি দিল্লীর সুলতান হয়। আর তাকে ঠিকই শরণ নিতে হয় খসরুর কাব্যজগতে। খসরু সেসময় তার পাঁচটি মসনবি লিখে শেষ করে। খামসা-ই-খসরু প্রকাশিত হয় ১২৯৮ সালে। প্রথম মসনবি মাতলা উল আনওয়ার (আলোক উত্থানের জায়গা) লেখা হয় মাত্র ১৫ দিনে। এতে নৈতিকতা আর সুফি প্রপঞ্চ-র কথা বলে কবি। দ্বিতীয় মসনবি খসরু শিরিন। তৃতীয় মসনবি লায়লা মজনুন সেই অজর প্রেমগাথা। চতুর্থ মসনবি আয়না-ই ইস্কান্দারি কথা বলে আলেকজান্ডারের বীরগাথা নিয়ে। পঞ্চম মসনবি হাশত-বিহিশত সানসানিয়ান রাজ্যের পঞ্চম রাজা বাহরামের কিংবদন্তী নিয়ে। আলাউদ্দিন খিলজি মুগ্ধ হয় এই কাব্যগ্রন্থগুলো পাঠ করে; খসরুকে সম্মানিত করে হীরে জহরতে।
এসময় মায়ের মৃত্যু হলে খসরু লেখে,
যেখানেই তোমার পায়ের ধুলো পাওয়া যায়; সেটাই আমার জন্য বেহেশতের চিহ্ন।
গুজরাটের ভাঘেলা রাজবংশের রাজকুমারী দুভাল রাণী আর আলাউদ্দিন খিলজির ছেলে খিজির খানের বিয়ে নিয়ে একটি প্রেমময় উপাখ্যান লেখে খসরু। দুভাল রাণী তার শৌর্য–সৌন্দর্য-ঔদার্যে অতুলনীয় একটি চরিত্র হিসেবে ফুটে ওঠে এই মসবিতে।
এরপর খসরুর জীবনে আসে সেই অনঙ্গ আকাংক্ষার প্রেম, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে; জীবনের আলোকসম্ভবা এক অধ্যয়ে প্রবেশ করে সে।
হরিত বনভূমির মাঝে নক্সী জায়নামাজে বসে পাখির গান ঝরণার কলতান শুনতে শুনতে খসরু জিজ্ঞেস করে,
–কেন জীবনের এতো আয়োজন! কেন এতো আকুতি জীবন যাপনের জন্য।
–খোদার কাছ থেকে যে উপহার পেয়েছো; তাকে তো যত্ন আত্মি করতে হয় খসরু।
–যদি ফিরে যেতেই হয়; তবে কেন মিছে মায়ার খেলা চারপাশে। বাংলার লখনৌতি আমায় মায়ার টানে টেনেছে; পাতিয়ালি আমায় আপন করে নিতে চেয়েছে; মুলতান আমায় স্বপ্ন দিয়েছে; লাহোর আমায় সমুদ্র ঘোড়ায় রহস্য রাজ্য ঘুরিয়ে দেখাতে চেয়েছে; অযোধ্যা আমায় বুকে টেনে নিয়েছে, দিল্লি আমার গলায় হীরার হার পরাতে চেয়েছে; তবু “কী জানি কিসেরও আশায় প্রাণ করে হায় হায়”!
–এসবই তোমার কবিতার শব্দ বাক্য আত্মার আয়োজন; সবাই আসলে তোমায় সৃষ্টির আনন্দ দিতে চেয়েছে; পরিবর্তে কেউ কী কিছুই চায়নি তোমার কাছ থেকে। কারণ তোমার কাছ থেকে যে চাওয়া তা তুমি পূরণ করবে তা সবারই জানা ছিলো।
–আমি কী সংসার বিবাগী এক ভিখিরি! তবু কেন সবাই আমাকে আমির বলে; সে কি অতিশয়োক্তি!
–তোমার বাকিয়া নাকিয়া মসনবিতে যে বিশুদ্ধ পংক্তিমালার অনুসন্ধান তুমি করেছো; তাতে কী এর উত্তর নেই! পার্থিব প্রাপ্তি থেকে সন্তর্পণে নিজেকে সরিয়ে রাখাই তো আমিরের জীবনশৈলী।
–মামলুক, খিলজি, তুঘলক; দিল্লি সালতানাতের এই যে তিনটি শাহী বংশ; তাদের এই যে সিং হাসনের নেশা; অথচ তাদের তো কবিতার নেশাও ছিলো!
–জগতের বৈচিত্র্য এসব। যে কৃষক ফসল ফলায় কৃষিকাজ কবিতা তার, যে বস্ত্রশিল্পী বস্ত্র বয়ন করে; সে তো তার কাব্য জমিন, যে কুমার মৃতপাত্র বানায়; ঐ পাত্রই তো তার সৃজনশিল্প, যে রন্ধনশিল্পী আমাদের আহারের ব্যবস্থাদি করে; তার শিল্পের স্বাদ তো আমরা জিভ দিয়ে গ্রহণ করি। এ জগতে প্রতিটি মানুষই কবি-শিল্পী; অকবি হয়তো কেবল রাজা-বাদশাহ-রাই; তাইতো কবিতার জন্য অনন্ত তৃষ্ণা তাদের।
–রাজনীতি কী তবে অভিশপ্ত!
–প্রজারা যদি সাম্যের সুখে থাকে; তবে সে রাজা একজন জীবন শিল্পী। আর যদি প্রজার রক্ত ঝরে; তবে সে রাজা অভিশপ্ত। এটা নির্ধারণ করে রাজার অহম ত্যাগ করার শৈলীর ওপর।
–এই যে আমির-ফকির, হিন্দু-মুসলমান এসব বিভাজন ও বিদ্বেষের দাগ গুলো খোদা কেন টেনে দিলেন!
–কেউ প্রেম পায়, কেউ পায়না; কেউ ভালোবাসায় ধনী, কেউ ভালোবাসায় দরিদ্র্য। আমির-ফকির, হিন্দু-মুসলমান; হয়তো এসব বিভাজনের পরীক্ষায় ঠেলে দেয়া হয় প্রেম-ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য।
–আপনাকে নিয়ে লেখা আফজাল উল ফাওয়াইদ (শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ) কাব্যগ্রন্থ আপনার চরণে রাখতে পারি!
–আমি তো তোমার চোখের ভাষা, মনের অক্ষর, ভাবনার শব্দ, অনুভূতির বাক্য, স্বজ্ঞার পংক্তিমালা পড়তে পারি খসরু।
খসরুর মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে দেয় নিজাম। অন্তর্গত আলোকায়নের কাল উপস্থিত হয় খসরুর জীবনে। খসরু গাইতে থাকে,
আজ রঙ হ্যায় রি মা রঙ হ্যায় রি
মোরে মেহবুব কা ঘর রঙ হ্যায় রি
সাজন মিলাভরা সাজান মিলাভরা
সাজান মিলাভরা মোরে আঙ্গান কো
আজ রঙ হ্যায়
মোহে পীর পায়ো নিজামউদ্দিন আউলিয়া
নিজামউদ্দিন আউলিয়া মোহে পীর পায়ো
দেশ বিদেশ মে ঢুন্ড ফিরি হু
তোরা রঙ মন ভায়ো রি
জাগ উজায়রো জাগ উজায়রো
মে তো এয়সো রঙ অর নাহি দেখিরে
মে তো জাব দেখু মোরে সাঙ্গ হ্যায়
আজ রঙ হ্যায় হেই মন রঙ হ্যায় রি।।
সবখানে কী রঙ আমি দেখি ও মা কী রঙ
আমি আমার প্রেমের মানুষকে পেয়েছি; হ্যা আমি পেয়েছি
আমারই উঠোনে
আমি পেয়েছি আমার পীর নিজাউদ্দিন আউলিয়াওকে
আমি কত দেশ বিদেশে ঘুরেছি
একটি বিশুদ্ধ প্রেমের জন্য
সবশেষে ঐ মুখ আমার মনকে চঞ্চল করেছে
গোটা পৃথিবীর জানালা আমার জন্য খুলে গেছে
এমন উজ্জ্বল আলো আগে দেখিনি
আমি যখনই খুঁজি সে আমার সঙ্গে
হে প্রিয় আমাকে তোমার মাঝে রাঙ্গাতে দাও
আমাকে বসন্তের রঙ্গে রাঙ্গাও প্রিয়
কী রঙ আহা কী উজ্জ্বলতা।।
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মৃত্যুর মাত্র ছয়মাস পরে ১৩২৫ সালের অক্টোবর মাসে ৭২ বছর বয়সে খসরুর মৃত্যু ঘটে। প্রেমময় আধ্যাত্মিক গুরু নিজামের মৃত্যু শোক নিতে পারেনি খসরু। তাকে সমাহিত করা হয় নিজামুদ্দিনের দরগায়। মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে খসরু লিখে শেষ করে নিহায়াত উল কামাল (শক্তিময় উতকর্ষ)।