মাসকাওয়াথ আহসান
ছাপড়ি কালচারের রিক্সা বিদ্বেষ
পাডেল চালিত রিক্সা ছিলো অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব একটি যান। যে মধ্যবিত্ত ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা রেখেছে; শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছে; পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকের সোনালী যুগের বিনির্মাণ করেছে; তাদের প্রিয়বাহন ছিলো রিক্সা।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীটি দ্রুত-অতিদ্রুত গাড়িতে চড়ে মুক্তিযুদ্ধের সুফল অতি তাড়াতাড়ি কুড়াতে চাইলো।
বঙ্গবন্ধু-জিয়া-এরশাদ আমল পর্যন্ত তবু গলির ধারের ছেলেটির চুরি-ডাকাতি করে রাতারাতি ভ্যাকসিন চৌধুরী হয়ে ওঠা কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিলো। কিন্তু নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানের মাঝ দিয়ে আরেকটি দ্রুত আন্দোলনের সুফল কুড়ানোর প্রজন্ম পাওয়া গেলো।
এরা বস্তির ঘরে চারটি সেলাই মেশিন বসিয়ে গার্মেন্টস শিল্পবিপ্লবে যোগ দিলো কালু-ভুলু-দুলু। যেহেতু সিনেমায় দেখেছে চৌধুরী সাহেব বাড়ির পোর্টিকোর নীচে গাড়িতে উঠে এরপর কারখানার দরজার কাছে গিয়ে হর্ণ দেয়; এই কারণে নতুন গার্মেন্টস চৌধুরী কাফলিং আঁটা শার্ট পরে টয়োটা করোনায় চড়ে ভেঁপু দিয়ে বেড়াতে শুরু করলো।
ধীরে ধীরে পলিসি মেকিং-এ জায়গা করে নিতে থাকলো রেললাইনের ধারের ধানক্ষেত থেকে হাই কমোডে ওঠা আর বাঁশের মাচা থেকে হাই টেবিলে ওঠা ছাপড়ি কালচারের লোকেরা। তারা একটি গাড়ি হাঁকায়; আর তাদের স্ত্রী রুপালী-শেফালি আরেকটি গাড়ি নিয়ে শপিং করে বেড়ায়।
শেফালি এক সাঁঝে মুখভার করে বলে, রিক্সার যন্ত্রণায় গাড়ি নিয়ে বের হবার উপায় নাই!
বাতেন ধমক দেয়, গরুর গাড়ি থেইকে ইঞ্জিনের গাড়িত উঠিছাও; একুন রিক্সা দেকলি বিরক্ত তো লাগবিই।
বাতেন অফিসে এসে প্রস্তাব দেয়, ভি আই পি রোড করা প্রয়োজন ঐখানে রিক্সা নিষিদ্ধ করা হোক।
যন্ত্রণালয়ে গোঁফ কামড়ে কামড়ে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলবিদ বলে, একই শহরে বিভিন্ন গতির বাহন থাকতে পারে না। শুধু গাড়ি আর বাস থাকবে। শুধু যন্ত্রচালিত বাহন চাই।
শুরু হয় রিক্সা খেদাও আন্দোলন। রুপালি ও শেফালি তখন ভি আইপি রোড দিয়ে সাঁই সাঁই করে ঘুরে সরকারি গাড়ি নিয়ে।
বাতেনের ব্যবসায়ী বন্ধু মইনু বুদ্ধি দেয়, ব্যাটারি চালিত রিক্সা চীনে দেইখা আইলাম। ঐডা প্রচলন করা গেলে গোটা শহর যন্ত্রচালিত যানবাহনে চীন ও সিঙ্গাপুর হইয়া উঠবে।
মইনু লাইসেন্স পেয়ে যায় ব্যাটারিচলিত রিক্সা আমদানির। কাঁচা পয়সার কমিশনে বাতেন ক্যানাডায় সেকেন্ড হোম কিনে শেফালিকে দুটি ওবিস বাচ্চাসহ পাঠিয়ে দেয়। আর একটি পোরশে কিনে দেয় এক মডেল কন্যাকে। গাড়িপুরের বাগান বাড়িতে তাকে নিয়ে যায় ভালোবাসার যৌথখামারে কৃষিকাজ করতে অত্যন্ত নিয়ম করে।
পথে উত্তরায় ব্যাটারি চালিত রিক্সা গাড়ির গতিরোধ করলে বাতেনের মাথায় ক্ষমতার শৌর্যবীর্য উঠে যায়।
গাজিপুরে সে যখন আজন্মের কৃষকতায় ব্যস্ত তখন শ্যালিকা হুসনা; এখন যে নিজের নাম নিয়েছে হাসিন, সে ফোন করে অভিযোগ করে, ব্যাটারি চালিত রিক্সার যন্ত্রণায় রাস্তায় জ্যাম লাইগা থাকে। বাবুর স্কুলে দেরি হইয়া যায় দুলাভাই।
বাতেন বিরক্ত হয়, অহন রাহো দেহি। সামনে ক্যাবিনেট মিটিং-এ ব্যাপারটা তুলতেছি।
মিটিং-এ কে একজন বলে, ঢাকা শহরে আসলে গাড়ি কমানো দরকার। একই পরিবারের চারজন চারটা গাড়ি নিয়ে বের হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় বুঝতে পারেন।
এক প্রবীণ লোক বলেন, বাচ্চাদের জন্য স্কুল বাস চালু হোক।
রেগে কাঁই হয়ে যায় আলফাডাঙ্গার আমব্রেলা ইঞ্জিনিয়ার ভ্যাকসিন চৌধুরী, আমার ছেলে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিশে নষ্ট হয়ে যাবে; ওরে বাসে তাই দিতে চাইনা। বাসায় তার জন্য চিড়িয়াখানা বানাইছি; যাতে বাচ্চা চিতাবাঘ আর হরিণ নিয়ে খেলতে পারে।
আরেকজন তেলাঞ্জলি দিয়ে বলে, যে শহরে মেট্রোরেল আছে; সেখানে রিক্সা কী দরকার!
সিদ্ধান্ত হয়, ব্যাটারি চালিত রিক্সা বন্ধ।
ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি কিনে ক’মাস আগে যারা রিক্সা থেকে ঝাঁপ দিয়ে গাড়িতে উঠেছে, তারা সমস্বরে বলে, ব্যাটারি রিক্সা খুবই রিস্কি।
কেউ কেউ বলে, প্যাডেল চালিত রিক্সা বাদ দিয়ে যারা ব্যাটারি রিক্সা চালু করলো, তাদের আগে ধরেন। এতোগুলো রিক্সাচালকের জীবনের কী কোন মূল্য নাই।
চুক চুক করে একজন উন্নয়নের বিদূষক বলে, মহৎ কাজে কিছু স্যাক্রিফাইস লাগে। সিঙ্গাপুরে লী কুয়ানও কিছু গরীব জবাই দিছিলো।
পুলিশ ব্যাটারি রিক্সা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়; পুলিশের মার খেয়ে ঘর্মাক্ত ক্ষুধার্ত রিক্সাওয়ালা পিতা বস্তির ঘরে ফিরলে; অনিশ্চয়তার ভেলায় বসে থাকা রোজ এনে রোজ খাওয়া লখিন্দরের সন্তানেরা মনে মনে শপথ করে, তারা বড় হয়ে সহ সভাপতি কিংবা পুলিশ হবে; এই গরীবীর প্রতিশোধ নেবে; গরীবীরে পিটাইয়া লম্বা করে দেবে।
এইভাবে যুগের পর যুগ অত্যাচার ও প্রতিশোধের হিংস্রবৃত্ত রচিত হয়; অসংখ্য মানুষের অশ্রু-রক্ত-ঘামের ওপর শাসনদণ্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকে দ্য সিটি অফ ক্যানিবালস।
এরপর ভোর বেলা ঈশ্বর ভদ্রপল্লী থেকে নেমে আসেন বস্তিতে। লখিন্দরের সন্তানদের কানে ফিস ফিস করে বলেন, রিক্সা চলবে।
আবার চারদিকে দেবশিশুদের কলরব ওঠে, থ্যাংক ইউ দাদুমণি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।