মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ব্যক্তিগত জীবনের সাফল্যের চেয়ে আমরা সামষ্টিক সাফল্য বেশি উদযাপন করতে চাই। সে কারণে আমাদের নারী ফুটবল টিম যখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাফল্য আনে; আমরা তখন অকুন্ঠ প্রশংসা করি। কেউ যখন বিজ্ঞান, কুরান তেলওয়াত, চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য সৃজনশীল ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে; আমরা প্রশংসার ঔদার্য্যে তাদের সম্মানিত করি।
এই মুহূর্তে পৃথিবীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের যে সরকার প্রধানরা রয়েছেন; তাদের মধ্যে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনুস উল্লেখযোগ্য। তার শান্তিতে নোবেল বিজয়, পৃথিবীর নানা দেশে দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ক্ষুদ্র ঋণ ও সামাজিক ব্যবসা মডেল ব্যবহৃত হওয়া, পৃথিবীর নানা প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পাঠ্য হওয়া, তার বক্তৃতা গোটা পৃথিবীর আগ্রহের বিষয় হবার মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের মুকুটে তিনি একটি উজ্জ্বল পালক যুক্ত করেছেন। সে কারণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে তিনি যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন, যেখানে সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাদের সরকার প্রধানের এই ঔজ্জ্বল্যকে উদযাপন করে।
কিন্তু জুলাই বিপ্লবের আগে পর্যন্ত যারা স্বাধীন বাংলাদেশে রাতারাতি তৈরি হওয়া নতুন বুর্জোয়া শ্রেণীর অংশ ছিলো; কাল্পনিক অভিজাততন্ত্রের বালিশ বালক ছিলো, ফ্যাসিস্ট শাসক হাসিনার প্লট-পদক-পদবী ও আর্থিক আনুকূল্যে ক্ষমতার সারিন্দা হয়েছিলো; তারা ড ইউনুসকে নিয়ে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাসকে বাড়াবাড়ি মনে করছে। এদের অনেকেই শেখ হাসিনার শিখিয়ে দেয়া বোলে, ইউনুস সম্পর্কে অশালীন সব কথা বলে। দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন এমেরিকা, আমেরিকা, ইউরোপ সর্বত্র ইউনুসের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্প ও সামাজিক ব্যবসা মডেল সফল হয়েছে। কিন্তু এরা হাসিনাতসির এমিরেটাস প্রেস সেক্রেটারির নেতৃত্বে কাকের মাংস খেয়ে প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা করেছে; ইউনুস কিছুই নন।
গোটা দুনিয়া যাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তিনি যেন আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং-এর স্বীকৃতির অপেক্ষা করছেন। খেয়াল করলে দেখবেন আফসোস লীগ ও গেরুয়া লীগ এই ইউনুস বিরোধী প্রচারণার অগ্রভাগে থাকে। এরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অমর্ত্য সেনের নোবেল বিজয়কে উদযাপন করে। আর ইউনুসকে অসম্মান করে “অসাম্প্রদায়িকতা” ধর্ম পালন করেন। আবার খোদ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেনকে অসম্মান করে গেরুয়া সংহতি। কারণ রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্যকে তারা তাদের হিন্দুত্ববাদের আদলে পেতে ব্যর্থ হয়ে তাদের প্রতি এমন অসহিষ্ণু হয়েছে। আর ইউনুসের ক্ষেত্রে মনোভাবটা হলো, পূর্ববঙ্গের মুছুম্মান কেন নোবেল পাবেরে!
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লীগ মিছিল করেছিলো ইউনুসের নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নেবার জন্য। অনেক আগে অনলাইনে পরিবারে প্রথম পশ্চিমে গিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া কিছু লোককে দেখেছিলাম ইউনুসকে হাসিনার অভিধানের অনভিপ্রেত শব্দ দিয়ে অসম্মান করছে।
বৃটিশেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের সম্পন্ন কৃষক ও কারিগর শ্রেণীর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়ে নতুন মিডলম্যান জমিদার শ্রেণী তৈরি করেছিলো। সেই থেকে ক্ষমতা কাঠামোর কোলাবরেটর হয়ে খেলনা অভিজাততন্ত্রে ঢুকে পড়ার একটা নেশা রয়েছে আমাদের সমাজে। সরকারের দেয়া আধা সের সম্পদ, এক মুঠো দলীয় আদর্শ আর এক চিমটি রবীন্দ্রনাথ মিলিয়ে একটি নতুন জমিদারির ওরস্যালাইন পান করার নেশা রয়েছে আমাদের সমাজে। ইউনুস সে সমাজের কৃষক ও কারিগরদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের অধীনে এনে, অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞে নারীকে যুক্ত করে পূর্ববঙ্গের কৃষক ও কারিগরের সম্পন্ন জীবন ফেরাতে কাজ করেছেন। যে কারণে প্রান্তিক মানুষ সরকার প্রধান হিসেবে তাকে পেয়ে আনন্দিত। যারা ক্ষমতা কাঠামোর কাছে প্লট পদক পদবী উন্নয়ন প্রকল্পের কমিশন প্রত্যাশা করে না। চাঁদাবাজির লাইসেন্স চায়না; সেই অগম দুর্গমের সাদাসিধে মানুষেরা ইউনুসের প্রশংসা করে।
ড ইউনুস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। দেশের জনগণ জানে তিনি অল্প সময়ের জন্য জাতির প্রতিনিধিত্ব করবেন সরকার প্রধান হিসেবে; তারপর বাংলাদেশ আবার ফিরে যাবে আদিম জমিদারি ব্যবস্থায়; আবার কালো টাকা ও পেশীশক্তির লালু-কালু-বাচ্চু-কাচ্চু পতাকা উড়িয়ে ঘুরবে; হেলিকপ্টারে চড়বে দলীয় মাজারের খাদেম, আবার ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হবে; ক্ষমতা ঈশ্বরের অঙ্গুলি হেলনে নিয়তি নির্দিষ্ট হবে ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরদের। আমরা জানি, আমাদের দাসের জীবন; আমরা পুতুল নাচের ইতিকথার দুর্ভাগ্যপীড়িত জাতি। সমাজের সবচেয়ে অযোগ্য অশিক্ষিত দাম্ভিক ও অসত মানুষের বড় গলা শুনে ভয়ের রাজ্যে জীবন্মৃত আমরা; তাদের বংশবদ কোটালপুত্রের ভিন্নমতের আগাছা কেটে ফেলার অভিযানে আমরা যে কোন সময় প্রাণ হারাতে পারি। আমাদের জীবন মিথ অফ সিসিফাস; আমাদের সন্তানেরা বারবার রক্ত দেবে ক্ষমতা রাক্ষস তাড়াতে; আবার রাক্ষস এসে দখল করবে জনপদ।
এই যে জুলাই বিপ্লবের তরুণ তরুণীদের পছন্দে ইউনুসের মতো একজন মায়াময় সরকার প্রধান পাওয়া গেলো; আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষেরা যার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হলেন; এই যে ভয় দেখানো নেই, ভাবমূর্তি রক্ষার অজুহাতে গুম কিংবা আয়নাঘর নেই; ইউরোপের সভ্য দেশগুলোর মতো নিশ্চিন্তে অভিমত প্রকাশ করা যায়; এই অল্প সময়ের সভ্যতার আনন্দটুকুও সহ্য হচ্ছে না বিংশ শতকের ক্ষমতার চাটুকার হিংস্র মানবের। চাটুকারিতার বিনিময়ে প্লট-পদক-পদ-সম্পদ বাগানো উপমানবেরা ফেসবুকে আসে ইকুয়ালাইজিং-এর খেলা খেলতে। হাসিনার “প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি”-র স্তাবক, স্থূল সৌন্দর্য ধারক, বিদূষক এসে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নিঃস্বার্থ ইউনুস-প্রশংসাকে “চাটুকারিতা” ডেকে তাতে মালিন্য আনার চেষ্টা করে। অযোগ্য লোকের চাটুকারিতা দেখে যারা বড় হয়েছে, যোগ্য লোকের জনপ্রশংসা দেখলে তাদের কাছে চাটুকারিতাই মনে হবে। এরা নিজের চিন্তার দুই ইঞ্চি গজফিতা দিতে মাপতে চেষ্টা করে এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের পেশী বহুল মানব ও আনন্দঘন মানবীদের।
(ছবিতে ঈদের দিনে কুশল বিনিময় করছেন ড ইউনুস)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।