মাসকাওয়াথ আহসান
বেশ নির্জন দুপুরবেলা হোয়াটস এপে ফোন। ধরলে ওপাশ থেকে এমনভাবে কথা বলে যেন খালাতো বোন, অনেকদিনের চেনা!
–হ্যালো পাভেল ভাই, আমি রুনা আপনাদের ডিবেট সার্কেলে ছিলাম।
মনে পড়ে না এ নামে আমাদের সময়ে কেউ বিতর্ক করতো। রোজিকে চিনি, রিচিকে চিনি, নাহরীন তাকেও চিনি। যেহেতু নারী বিতার্কিক কম ছিলো; ফলে জুরি হিসেবেও তাদেরকে চিনি। যা হোক সেসব থাক। বিতর্কের দর্শক মানেও বিতর্কে আগ্রহী। সুতরাং কথা বলা যায়।
–আপনি দেশে আসবেন কবে! আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, দেশের বাইরে যে কৃতি বাংলাদেশিরা কাজ করছেন; তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার।
–আমি তো কৃতি নই।
–কী বলেন, আপনার বাংলা ইংরেজি লেখা দুইটাই তো ভালো। আমাদের জন্য আর্টিকেল লিখবেন! রোহিঙ্গার বোঝা কীভাবে চেপেছে আমাদের ঘাড়ে। আপনি লিখলে আমরা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ায় ছাপাতে পারবো। আপনাকে ভালো সম্মানী দেবো পাভেল ভাই। প্লিজ না করবেন না!
–আমি তো কোনদিন ফরমায়েশি কাজ করিনি, আমি তাই লিখি ভাই; যখন চাহে এ মন যা।
এরপর অচেনা বিতার্কিক ছোট বোনের সঙ্গে খালাত ভাই সুলভ স্নেহের কিছু কথা বলে তারপর ফিরে যাওয়া গেলো নিজের ভুবনে।
এরপর চোখে পড়লো ঘোষণা, সরকারের পক্ষে পত্রিকায় আর্টিকেল লেখার জন্য লেখক খোঁজা হচ্ছে। বাংলায় তেলাঞ্জলি লিখে ফাটিয়ে দেয় সহমত বিদূষকেরা। কবে তার দাদার গ্রামের ঘাটে কোন মহান নেতার নৌকা ভিড়েছিলো; তারপর তা নিয়ে রীতিমত একটা আস্ত ইতিহাস গ্রন্থ। মোরগ উন্মোচন করেন শতবর্ষ কামাল।
কিন্তু পাবলিক তেলাঞ্জলিকে প্রবল সন্দেহ করে। আর হরপ্রশাদ শাস্ত্রীদের তৈলের গুনাবলীতে সবাইকে চিনে যাবার পর তারা সত্যি কথা লিখলেও কেউ বিশ্বাস করেনা। আর সহমত ভাইয়েরা যেহেতু স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত কৃতি ছাত্র; তাই তারা ইংরেজি চারটা লাইন লিখতে দাঁত পড়ে যায়। সেই দাঁত বাঁধাতে যেতে হয় ডেন্টিস্টের কাছে।
বিরক্ত হয়ে রাইটার হান্টিং প্রজেক্টের বস বলেন, আমাদের ভক্ত যারা, তারা কী সবই খারাপ ছাত্র!
ভদ্রলোক একসময় শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিমর্ষ হয়ে হেড ট্রেডিং সেন্টারের রাইটার হান্টিং ইন্টারভিউ বোর্ডে বসে থাকেন। ইন্টারভিউ দিতে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথচ ইংরেজিতে ক-অক্ষর গোমাংস। ডিপার্টমেন্টের হেডের বাজারের ব্যাগ টেনে আর ছাত্র সংগঠনের মিছিল করে শিক্ষক সমিতি লীগের ভোটার হিসেবে শিক্ষক হয়েছে। ফলে বেচারাদের দোষ কী! এরা এইরকমই ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো।
রাইটার হান্টিং প্রজেক্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড খুব চালিয়াত লোক। তার মাথায় বিজনেস বুদ্ধি। কী করে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে কইয়ের তেলে কই ভাজা যায়। সাইন বোর্ড সর্বস্ব কারখানার সাইট দেখিয়ে আরো লোন নেয়া যায়। কী করে শেয়ার বাজারে তেলেসমাতি করা যায়, সব শিখে এখন দরবেশের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে এক “বড় ভালো লোক ছিলো” পলিসি মেকার হয়ে ঘুরছে। আচার ব্যবহারে মাধুর্য, কিন্তু বুদ্ধি তার ওশান ইলেভেনস মুভির মতো।
ইন্টারভিউ বাদ দিয়ে সে হান্টিং প্রজেক্টের বসকে ওশানস ইলেভেন মুভি দেখায়। কীকরে একদল চালাক লোক একসঙ্গে হয়ে ব্লাফ দিয়ে টাকা-হীরে জহরত ভরা ভল্ট হাওয়া করে দেয়। হেলিকপ্টার দিয়ে তুলে নিয়ে যায় ক্যাসিনোর টাকা ভর্তি সিন্দুক।
মুভি দেখা শেষ হলে সে ফোন ঘুরিয়ে, ইংরেজি সংবাদপত্রে কম বেতনে চাকরি করে বিমর্ষ কিছু লোককে ডেকে আনে। মোট ২৩ জনের করিতকর্মা টিম; ওশান টোয়েন্টি থ্রি; যারা উন্নয়নের ফুল ফোটাবে টু থাউজ্যান্ড টোয়েন্টি থ্রি বছর জুড়ে; যাতে নতুন বছর আসে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়ে।
বোর্ড রুমে তাদের ব্রিফ করে সেন্টার ফর রুথলেস ইন্টেলিজেন্সের বিশিষ্ট গুজববিদ ঘোড়েল সহমত ভাইয়েরা। একজন ছোট চুল সুঠামদেহী প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ফেলো তখন বলে, উন্নয়নের নানা দিক তুলে আনতে হবে; পরী সংখ্যা দিয়ে জিডিপি -ব্যাংক রিজার্ভ-মাথা পিছু আয়- দারিদ্র্য দূরীকরণের হার দেখাতে হবে। কল্পনার মতো সুন্দর কিন্তু বাস্তবের মতো টান টান হতে হবে লেখাগুলো।
সিংহ ব্রিফ করে ঘুরে ঘুরে, জঙ্গীবাদ ইস্যুটা কিন্তু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেখাতে হবে আমরা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে নিয়ত যুদ্ধ করছি। এতে পশ্চিমে যাদের ইসলামোফোবিয়া আছে তারা খুশি হবে; আর আমরা দেশি-বিদেশি গেরুয়ারাতো আনন্দে আটখানা হবো।
টাইম মেশিন মেথড বিশারদ ধারাপাত বলে, আপনাকে ঘুরে ফিরে একাত্তরের গণহত্যা, পঁচাত্তরের ট্র্যাজেডি, একুশে অগাস্টের ট্র্যাজেডির কথা আনতে হবে। পদ্মা সেতু নিয়ে লিখলেও শুরু করবেন এভাবে, একুশে অগাস্ট সফল হলে আজ এই উন্নয়ন সাফল্য দেখতো না বাংলাদেশ। আর ইউনুস বিশ্বব্যাংকে ঋণ দিতে মানা করেছিলো ওটা দিয়ে শেষ করবেন।
ফিউচারিস্ট আইনজ্ঞ সুকান্ত বলে, আইনের পরিভাষাগুলো এঁটে দেবেন আর্টিকেলের ফাঁকে ফাঁকে। কেন কেয়ারটেকার সরকারের অপশন আর সংবিধানে নাই সেটা উল্লেখ করবেন।
টাইম মেশিন বিশারদ চট করে বলে, কী করে সংবিধান কাটা ছেঁড়া করেছিলো সেনা শাসকেরা; আর আমরা সেগুলো সেলাই করেছি টুপি সেলাইয়ের মতো।
ছোট চুল সুঠামদেহী কারেকশান করিয়ে দেয়, সেনা শাসকের জায়গায় স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি করে দেন ভাই।
প্রজেক্টের বস মাথার ভাড়াটে চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলেন, আর্টিকেল লেখা তো হলো। কিন্তু লেখকের কী হবে। ক্রেডিবল লেখক চাই, একাডেমিশিয়ান চাই। এদেশের লোক নামের আগে ডক্টর দেখতে চায়; আর পশ্চিমে এক্সপোজারওয়ালা লোক চায়।
প্রজেক্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড বলে, আমি কলামিস্টদের নাম বলি, আপনারা লিখে নিন, ৩৫ টা নাম, এরা ক্যানাডা ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো, সুইটযারল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ লুসের্নে কিংবা লুকের্নে, বানান সি দিয়ে, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুর, দিল্লি জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটির স্কলার ও একাডেমিশিয়ান! ডরিন চৌধুরী নাম দেও একজনের। চৌধুরীদের মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে দেখেছি। এইনামে ভারতীয় একজন অভিনেত্রী আছে।
প্রকল্পের সমন্বয়ক টাক চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করে, সাদা চামড়া হলে আরো ওজন বাড়ে; কিছু পশ্চিমা নাম দেন।
–লেখো, গেরার্ড ম্যাকার্থে, ইন্সটিটিউট অফ সোশাল স্টাডিজ, নেদারল্যান্ডস। পৃথ্বীরাজ চতুর্বেদী নামটাও লেখো। ইন্ডিয়ানরা তো খুব পণ্ডিত হয়। আর্টিকেলের ওপর পাণ্ডিত্যের জাফরানি রঙ ছিটাইয়া দেও।ফুমিকা ইয়ামাতো, স্পেশালিস্ট ইন বাংলাদেশ স্টাডিজ, অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ণ।
৭০০ আর্টিকেল লেখা হয় এইরকম ৩৫ জন নামের। সেগুলো ছাপা হয় দেশে বিদেশে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। চীনের সঙ্গে মিষ্টি সম্পর্ক, এমেরিকার গান ভায়োলেন্স ও মানবাধিকারের সমস্যাগুলো, রোহিঙ্গা নিয়ে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা, আর নয়ন জুড়ানো উন্নয়ন নিয়ে প্রশংসা; গণতন্ত্রের দুধের নহরের পাশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আংগুর গাছ, আইনের শাসনের আপেল গাছ; আরও কত কী!
পড়ে প্রজেক্ট বস মুচকি হেসে বলেন, আমরা একরকমের বেহেশতে আছি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া