মাসকাওয়াথ আহসানঃ
গাড়ির প্রতি লোকজনের যে আগ্রহ; আমি তা কখনো রিলেট করতে পারিনা। কেন গাড়ি লাগে, তিন চারটা গাড়ি প্রয়োজন হয়; তা বুঝতে আমার খুব কষ্ট হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রিক্সা ও স্কুটারে ঘুরতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাসে চড়েছি। আমার আব্বা বাসে চড়তে উপদেশ দিতেন। উনি বলতেন, সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বাসে ওঠা প্রয়োজন।
একটা ক্লিশে গল্প প্রচলিত আছে যে, বান্ধবীরা স্পোর্টসকারে চড়তে চায়। বাস্তবে দেখেছি বান্ধবীরা রিক্সা ও স্কুটারে ঘুরতেই বেশি পছন্দ করে।
সিভিল সার্ভিসে গাড়ি সুবিধা ছিলো; কিন্তু রিক্সা-স্কুটার-ট্যাক্সির নেশা ছাড়েনি কখনো। সিনিয়র কর্মকর্তারা অনেকসময় বলতেন, গাড়ি ব্যবহার করো না কেন! আমার মনে হতো থাক না।
ভারতে কিছুকাল ঘুরে ফিরে দেখেছি, সবাই বাসে-ট্রামে-ট্যাক্সিতে চড়ে। সরকারি কর্মকর্তারা দায়িত্বপালনকালে গাড়ি ব্যবহার করে। কিন্তু ভারতে যেহেতু রাতের ভোট হয়না; তাই রিটার্নিং অফিসারদের দামী গাড়ি উপহার দেবার চল নেই।
লন্ডনে কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনে কিছুকাল কাটিয়ে দেখলাম; বৃটিশ ও কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটে কর্মকর্তাদের জন্য কেবল পুলের গাড়ি রয়েছে। সরকারি কাজে সেগুলো ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মত গাড়ির নেশা সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের নেই। সবাই বাসে-ট্রামে চড়ে। কর্মকর্তাদের স্ত্রী সন্তানেরাও বাসে-ট্রামে চড়ে। এই যে আমরা কথায় কথায় বলি, বৃটিশেরা আমাদের সিস্টেমটা শেষ করে দিয়ে গেছে; ঐ গল্পটা মনে হয় আর না করাই শ্রেয়।
জার্মানিতে দীর্ঘকাল কাটিয়ে দেখলাম, সবাই ট্রাম-বাস-ট্যাক্সিতে চড়ে। ট্রামে ও বাসে চড়া সেখানে আনন্দময় অভিজ্ঞতা। রাতে খুশিজল সেবা করে ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হওয়ায় আমি ট্যাক্সিতে অফিসে যেতাম। ট্যাক্সিচালকেরা এতো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো যে, মাঝে মাঝে আমাকে জয়েন্ট উপহার দিতো। ইউরোপের রাস্তায় ঢাকার মতো দামি গাড়ির দেখা মেলে না। কারো দামি গাড়ি দেখলে লোকে বলতো, এ নিশ্চয়ই আরব বিশ্বের লোক। কারণ আধুনিক কোন মানুষের জবরজঙ্গ গাড়ির প্রয়োজন পড়ে না। যে ডিএনএ কমপক্ষে তিন প্রজন্ম ধরে শিক্ষিত, যার জীবনে মাসলোর হায়ারার্কি অফ নিড পূরণ হয়েছে নিয়মিতভাবে; সে পয়সা আছে বলেই দামি গাড়ি, দামি ঘড়ি কিনবে না। এ কারণে ইদানিং ভারত ও পাকিস্তানে দামি গাড়ি, রোলেক্স ঘড়ি ও গলায় স্বর্ণালংকারের প্রচলন হয়েছে।
পরবর্তী আলোচনায় যাবার আগে বলে নেয়া প্রয়োজন, মুঘল ও নবাবী আমলে পূর্ব বঙ্গে সর্বোচ্চ জিডিপি ছিলো। ফলে সম্পন্ন কৃষক-কারিগরের জনপদ ছিলো এটি। সুলতানি আমলে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশের কারণে অন্তর্গত আলোকায়নে দেদীপ্যমান ছিলো এই ব-দ্বীপ।
নবাবী আমলের অবসানে কোলাবরেটরেরা জমিদার হতে শুরু করে। সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরকে ছিন্নমূলে পরিণত করা হয়। ফলে সম্পন্ন মানসের ফইন্নি মানসে রুপান্তর ঘটে। ঐ জমিদারেরাও মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে হঠাত টাকা পয়সার মুখ দেখার কারণে আলিশান বাড়ি, জুড়ি গাড়ি, বাবু কালচারের বুলবুলি আখড়াই-এর প্রমোদে ঢালিয়া দেয় মন। সেই থেকে পূর্ব বঙ্গে বড় লোকের একটা মডেল তৈরি হয়। এরপর রাজনীতি ও সরকারি চাকরি করে দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ ধনী হলেই ঐ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার বাবুর মতো হয়ে ওঠে। আচার আচরণ কর্কশ, গালে সুপোরি পুরে গম্ভীর, পিয়ন-গৃহকর্মীদের সঙ্গে রুক্ষ্ম আচরণ, বিলাস-ব্যাসন; এসবই ফইন্নি এলিটের বৈশিষ্ট্য। ফইন্নি শব্দটি এখানে মনের দারিদ্র্য অর্থে ব্যবহৃত।
কাজেই কেউ যখন পদাধিকার বলে তিন-চারটি গাড়ি ব্যবহার করে, দর্শনার্থীর সঙ্গে কর্কশ আচরণ করে, সেই লোকটির ব্যাপারে বরং করুণা হওয়া উচিত। সে তার ডিএনএ-এর এক্সরে রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে সবার সামনে। যখনই সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং-এর কার্টিয়াস কোন লোক দেখবেন; তার ভদ্রতাকে দুর্বলতা হিসেবে না দেখে বরং একে এভলভড ডিএনএ রিপোর্ট হিসেবে দেখুন।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।