মাসকাওয়াথ আহসান
আমাদের সাম্প্রতিকতম অভিজ্ঞতায় দেখেছি; ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি’র গুজরাট গণহত্যাকালীন ভূমিকা নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রচার করে মোদি সরকারের রুদ্ররোষের সম্মুখীন হয়েছে বিবিসির মতো একটি আন্তর্জাতিক খ্যাত মিডিয়া।
একই প্যাটার্ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। এলিট ফোর্সের ক্রসফায়ার ও গুমের মত মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ে ডকুমেন্টারি প্রচার করে হাসিনা সরকারের রুদ্র রোষে পড়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাত মিডিয়া হাউজ ডয়চেভেলে।
এর আগে বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল আজিজের হাঙ্গেরিতে অবস্থানরত ভাইয়ের সাক্ষাতকার সম্বলিত একটি প্রামাণ্য প্রতিবেদন একই রকম রুদ্ররোষের স্বীকার হয় আন্তর্জাতিক মিডিয়া আল-জাযিরা।
কেন মোদি ও তার অনুসারীরা এবং শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীরা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নৈর্ব্যক্তিক ও পেশাদারী প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হন!
এর কারণ হচ্ছে; এদের মধ্যে গণতান্ত্রিক বোধ না থাকায়; এরা স্বদেশে কিছু মিডিয়া প্রতিপালন করে অভ্যস্ত। ফলে মিডিয়াকে তারা হিজ বা হার মাস্টার্স ভয়েস হিসেবেই পেতে চান। তারা প্রত্যাশা করেন মিডিয়া হবে সহমত সংগীত বা ভক্তিমূলক গানের আসর।
বিবিসি বা ডয়চেভেলের মতো মিডিয়া পৃথিবীর যে সব দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রেস ফ্রিডম নেই; সেসব দেশের ওপরে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রচার করে থাকে।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, যেহেতু বৃটেন ও জার্মানিতে গণতন্ত্র রয়েছে, জনগণ ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও প্রেসফ্রিডম রয়েছে; সামাজিক সুবিচার রয়েছে; যত্রতত্র ক্রসফায়ার বা এথনিক ক্লেনসিং চলেনা; তাই তারা সে গণতান্ত্রিক সভ্যতার তুলাদণ্ডে; গোটা পৃথিবীর গণতন্ত্র নামধারী দেশগুলোকে মাপে। আর মিডিয়া কোড অফ এথিকস মেনেই কাজটি করা হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দুর্বল গণতন্ত্রের দেশগুলোর নীতিনির্ধারকদের ন্যুনতম লজ্জা বোধ রয়েছে। তারা জানে যে তারা সভ্য পৃথিবীতে অসভ্য আচরণ করেছে; ফলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এর সমালোচনা হবেই।
কিন্তু মোদি ও হাসিনা প্রশাসনের ধারণা তারা পৃথিবী গ্রহের বাইরে এমন এক ফুল’স প্যারাডাইস গড়েছে; যেখানে যা খুশি তা করার লাইসেন্স তারা পেয়েছে। আর তাদের প্রস্তরযুগীয় শাসন পদ্ধতির সমালোচনা করলেই তা হয়ে যায়, যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র।
উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের বুদ্ধাংকের সঙ্গে শ্রীখণ্ডের ক্ষমতাসীন নেতাদের বুদ্ধাংক তুলনীয়; লজ্জা-ঘৃণা-ভয়; সব করেছে যারা জয়।
ইদানিংকালে মোদিভক্ত ও হাসিনাভক্তরা “অপতথ্য” নামে নতুন শব্দবন্ধ জোগাড় করেছে। অর্থাৎ কেউ চোখে আঙ্গুল দিয়ে কোন ত্রুটি দেখিয়ে দিলেই তা অপতথ্য ও দেশের বিরুদ্ধে কথিত ষড়যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক স্বৈরাচারি শাসক বুশের কাছ থেকে এরা “আইদার ইউ আর উইদ আস অর এগেইন্সট আস” শিখেছে। কথায় কথায় “এন্টি স্টেট”, “জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি”-র মতো বহুব্যবহারে জীর্ণ স্বৈরশব্দের ছল আজকাল আমরা দেখতে পাই ভারতের রাম রাজত্বে ও বাংলাদেশের একদলীয় আরাফাতের ময়দানে।
হোয়াটস এপে “অপতথ্য” ছড়ানোর ওস্তাদ হচ্ছে মোদিভক্তরা। হাসিনাভক্তরা “অপতথ্য” ছড়িয়ে আজ জনগ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। নিজেরা খারাপ ছাত্র বলেই; পৃথিবীর সবাইকে খারাপ ছাত্র বলে মনে হয় তাদের। খারাপ ছাত্রটি যার দুনিয়ার কোথাও কোন কাজ করে খাওয়ার যোগ্যতা নেই; সে-ই গদি মিডিয়া ও বাতাবি মিডিয়ার সেলিব্রেটি “সাংবাদিক” হয়। এদের পক্ষে বিবিসি ও ডয়চেভেলের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণাই করা সম্ভব নয়। তাই ইরাকের স্বৈরশাসক সাদ্দামের মুখপাত্র কেমিকেল আলীর মতো অনর্গল মিথ্যা বলে, বিবিসি ও ডয়চেভেলেকে আক্রমণ করে ভারত-বাংলাদেশের সরকারি মুখপাত্ররা।
কিশোর বয়সে অনেক সময় দূরের “সুইপারপট্টি” থেকে বচসার খোয়ারির শব্দ ভেসে আসতে শুনেছি। লোকজন ভয় পেয়ে বলতো দূরে সরে থাকি বাবা; নয়তো আবার মলভান্ড ঢেলে দেবে দরোজায়। তারুণ্যে শিক্ষকেরা নিষেধ করতেন, কলেজের প্রাচীরের ঐপাশে যেওনা; ঐখানে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দেয় “ছাপড়ি”-রা। আমি খুবই সুনিশ্চিত, সুইপার, ছাপড়ি, গদি কিংবা বাতাবি কালচারের লোকেদের তেতো শৈশব; ভাগ্যহত জীবনে বেড়ে ওঠায় তারা আজ অজ্ঞাত প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্যানিবাল হয়ে উঠেছে।
কিন্তু ফ্যাসিজম ও তার সাপোর্ট সিস্টেমের অশালীন-হিংস্র-কামড়া-কামড়ির কালচার চিত্রণ করতে কিছু আপাত পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট চিত্রকল্পের সাহায্য নিতে হয়েছে।
আমার প্রত্যাশা সাম্যভিত্তিক সুষম সমাজ; সামাজিক সুবিচার, সবার জন্য শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। যাতে এমন ভিখিরির মতো সরকারের দ্বারে দ্বারে মাধুকরী করে বাঁচতে না হয় আগামীর সন্তানদের। যুক্তিবোধ আর মানবিক সচেতনতা নিয়ে বিকশিত হোক আগামীর তারুণ্য; যেন সরকারের ফুটসোলজার হয়ে; গ্ল্যাডিয়েটরের বলিবর্দ ষাঁড় না হতে হয়। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার ক্যানিবাল খেলায় নরমুণ্ডু নিয়ে উল্লাসের এই অন্ধকার সময়ের অবসানে আলোকসম্ভবা একটি ভারত ও বাংলাদেশকে দেখতে চাই।
(লেখক ডয়চেভেলের সাবেক সাংবাদিক)