এক: ধানগ্রাম রাজ্য এখন সুনসান। পাহারাদারের বাঁশি শোনা যায় কি যায় না। চাঁদ আর মশাল মিলেমিশে চারদিকে ভূতের নাচন। আসি আসি করে বৃষ্টি আসছে না বলে হাওয়াও বন্ধ।
তবুও প্রাচীন বৃক্ষের নিচে একে একে জড়ো হচ্ছে রাজ্যের সবাই। পাল্লাপাড়া থেকে অবশ্য এখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। বছর কয়েক আগে পাল্লাপাড়া রাজ্যের কয়েকজনকে আশ্রয় দিয়ে রাজ্যের শক্তি বাড়িয়েছিলেন রানি। পাল্লাপাড়া সঙ্গে থাকলে নৌকানগরের সঙ্গে যুদ্ধে সহজেই জেতা যায়।
বছর দশেক আগে এমনই এক যুদ্ধে জিতেছিলও ধানগ্রাম; পাল্লাকে সঙ্গে নিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছিল নৌকাকে। তার পরের ইতিহাস নিয়ে কবির লড়াই, লেটো আর পুতুলনাচ যে কত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সহকারী কোতোয়ালকে সঙ্গে নিয়ে পাল্লাপাথর দিয়ে মেপে রাজপুত্র আসলেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কত ধানে কত চাল। ধানগ্রামের তরুণেরা তখন দারুণ খুশি। এই না হলে রাজপুত্র-যেমন চেহারা তেমন দাপট। রাজপুত্রের ছিল বাতাসঘর। ধানগ্রামসহ আশপাশের আরও দুই-দশ রাজ্যের ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হতো সেখান থেকে। ধানগ্রামের বুড়ো লোকেরা গোপনে কানাকানি করেছেন, এত বাড় বেড়ো না বাবা। সামনে অবশ্য রাজপুত্রের প্রশংসায় ছিলেন আঠারোমুখ।
একদিন হঠাৎ এ অঞ্চলের সব কটি রাজ্য দখল করে নেন সেনাপতি। সাবেক একজন নায়েব নেন সব রাজ্যের দায়িত্ব। দখলদার ওই নায়েবকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান নৌকানগরের রানি। এ অঞ্চলে সুখের বাতাস বয়ে যায়।
কিন্তু এর কদিন পরই ভিনগ্রহের কয়েকজনের উৎসাহে কবিয়ালেরা বলতে শুরু করেন, দুই রানির আর দরকার নেই। আসুক নতুন রাজন্য। নৌকানগরের রানি দ্বীপান্তর থেকে গায়ের জোরে ফিরে আসেন। দুই রানিকে অন্ধকার কুঠুরিতে নেওয়া হয়। ধানগ্রামের রাজপুত্রদের বন্দী করা হয় ভয়ংকর কারাগারে।
পরে অবশ্য নায়েবমশাই বুঝতে পারেন, রাজ্যচালনা তার কাজ নয়, সেনাপতিও মানে মানে কেটে পড়তে চান। আঞ্চলিক প্রাধান্য নির্ধারণে যুদ্ধের তারিখ ঘোষিত হয়। লাঙল, মশাল সঙ্গে নিয়ে নৌকানগরের যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খায় ধান আর পাল্লা। নৌকানগরের রানিই সাম্রাজ্যের প্রধান পদ পান।
ওই মহাযুদ্ধের পর আবারও একটা ছোট যুদ্ধ হয়ে গেল সেদিন। রানির সহযোগীর একদা তল্পিবাহক এক তরুণের নেতৃত্বে জিতেছে নৌকানগর, নায়েবমশাইয়ের আমলে রানির বিরুদ্ধাচরণ করা একদা সৈনিকের নেতৃত্বে পাত্তাই পায়নি ধানগ্রাম। যদিও ধানগ্রামের প্রৌঢ় বারবারই বলেছেন, এ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুসারে যুদ্ধ কমিশনের উচিত ছিল নিরপেক্ষ থাকা। কিন্তু তারা নৌকানগরের আজ্ঞাই পালন করে গেছে। এমনকি এ অঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যের প্রত্যেক মানুষের খাজনার পয়সায় বেতন পাওয়া কোটাল-পাহারাদার-চৌকিদারেরা পর্যন্ত নৌকানগরের পক্ষ নিয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে আসতে বাধা দিতে পথে কাঁটা বিছিয়েছে কোটালের লোকেরা, চৌকিদারেরা গর্ত খুঁড়েছে, ধানগ্রামের যোদ্ধাদের ভেলা ডুবিয়েছে। চুক্তি অনুসারে নৌকানগরের যেসব নাগরিক যুদ্ধ করতে তালিকাবদ্ধ নন, তারাও যুদ্ধ করেছেন। একেকজন তিনটে-চারটে করে গোলাও মেরেছেন। আর এর সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখেছে যুদ্ধ কমিশন। যুদ্ধ কমিশনের প্রধান পুরোহিত আবার এ রকম একটি যুদ্ধকেই সঠিক লড়াইয়ের সনদ দিয়েছেন। নৌকানগরের অর্বাচীন তরুণের গলায় দিয়েছেন বিজয়মালা।
ছোট যুদ্ধের কথা বাদ দিলেও অনেক অত্যাচার করছে নৌকানগর। মহাযুদ্ধের আগে নিজ দলে লোক টানতে নৌকারানি বলেছিলেন, আলো, জল আর জ্বালানির কোনো সমস্যাই এ অঞ্চলে থাকবে না। পণ্য মিলবে কম দামে। গাঁয়ের বেকার তরুণদেরও কিছু একটা কাজ জুটিয়ে দেওয়া হবে। ধানগ্রামের বেশ কিছু লোকও এসব প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে নৌকাবাহিনীতে নাম লেখায়। লাঙল আর মশাল রাজ্যের মানুষও প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেয় নৌকার বশ্যতা। দুই রাজপুত্র নিয়ে ধানগ্রামের রানি একা হয়ে পড়েন। চিকিৎসার জন্য দুই রাজপুত্রকেই সাগরের ওই পাড়ে পাঠাতে হয়। বিশ্বস্ত সহচরেরাও আলাদা হয়ে গেলে রাজ্যের শক্তি আরও কমে যায়। নৌকানগরের বিজয় হয়ে দাঁড়ায় কেবল সময়ের ব্যাপার।
ধানগ্রামের কিছু মানুষ এখনই এর বিচার চায়। চায় রানির কাছে শুনতে যে নৌকানগরের সঙ্গে অস্তিত্বের সংগ্রাম এখনই শুরু হবে কি না। এখনই শুনতে চায় যুদ্ধের ঘোষণা। আবার ধানগ্রামেরই অনেকে মনে করে, কী দরকার এখন অকারণে শক্তি ক্ষয় করে। যেমন চলছে চলুক না। আর তো মাত্র সাড়ে তিন বছর। আবার হবে মহারণ। ওই যুদ্ধে নৌকারানি নিজের পাশে খুব কম সৈনিককেই পাবেন। ভেতরে ভেতরে এ অঞ্চলের মানুষ খুব বিরক্ত। সামান্য আলো-বাতাস-পানির ব্যবস্থাই করতে পারেন না যে রানি, তার মুখে কোনো কথাই শোভা পায় না।
প্রিয় প্রজাগণ, ধানগ্রামের রানি এসে দাঁড়ালেন। নৌকানগরের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এখনো আসেনি। তবে আমরা ওদের ভয় দেখাতে ছাড়ব না। আমরা কামান নিয়ে প্রস্তুত আছি। ভোলা নামের একটি গোলাও ছুড়ব তাদের দিকে। তবে তা হবে কেবলই আওয়াজ। আসল যুদ্ধ হবে যুবরাজ ফিরে আসার পর। ধানগ্রাম জিন্দাবাদ, যুবরাজ জিন্দাবাদ। দশ দিক থেকে এক শব্দ আসে।
দুই
নৌকানগরের উৎসবে আজ উল্লাস নেই। সূর্য ছাড়া অন্য কিছুর আলো অনেক দিনই হয়েছে দেখে না এ অঞ্চলের মানুষ। কার পাপে যেন বাতাস বন্ধ। জ্বালানি দিতে পারেন না রানি। শুধু দূরে রানির মহল আর তার চারপাশের তাঁবুগুলোতে আলো জ্বলে। জ্বালানির অভাবে বণিকেরা ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন, চারটি ভাত ফুটিয়ে খাওয়াই এখন কঠিন। প্রিয়তমার কাছে গিয়েও গন্ধে মুখ লুকায় তরুণ, জলের অভাবে ্লানের পাট চুকে গেছে সেই কবে। এমন বিভীষিকার মধ্যে আনেন্দের খবর হলো একটি ছোট যুদ্ধ জিতেছে নৌকানগর। কিন্তু সেই উল্লাসে শামিল হতে সায় দিচ্ছে না নৌকাবাসীদের মন। কারণ বিজয়ের মানে জানতে চায় আজ নৌকাবাসীরা। এখনো যদি উপযুক্ত কোনো আশ্বাস বা দিক-নির্দেশনা না মেলে, আগামী মহারণে ধানের হয়েই লড়বে এদের অনেকে। তাই কিছু একটা শুনতে চায় নৌকাবাসীরা। রানি কোনো একটা উপায় বার করবেন রানির বিদুষক আর ভাঁড়ের মাধ্যমে-এ তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুরো নৌকানগরে।
নতুন করে বানানো নৌকাভবনের বারান্দায় এখন অনেক মানুষ। কেউ কেউ বলছেন, এ অঞ্চলের সম্রাটকে ষড়যন্ত্র করে মেরে যারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, নৌকারানির আমলে তাদের তো ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। ভিনগ্রহের অত্যাচারী এক সম্রাটের কাছে যারা বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল এ অঞ্চলের মানুষের ভবিষ্যৎ, যারা শিক্ষকদের তালিকা করে করে মেরেছিল আর নির্যাতন করেছিল এ অঞ্চলের নারীদের, আগুন লাগিয়ে মেরেছিল বৃদ্ধ, শিশু আর জরাগ্রস্তদের; নৌকারানি তো তাদেরও শাস্তি দেবেন। কয়েকজন কাজিকে এর দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। আবার কারও কথা হলো, ভাই, সবই দরকার। কিন্তু সামনে যে আলো দেখি না। তার কী হবে? আলো না থাকলে যে দুনিয়া অন্ধকার-এ সহজ কথাটা না বুঝলে চলবে কেমনে?
মহাযুদ্ধের পর দুই-চারটে ধানের গোলা লুট হবে বা দুই-চারটে নৌকা ডুববে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নৌকারানির তরুণ সহচরেরা যা শুরু করেছে, তাতে তো দুই-দশ রাজ্যে মুখ দেখানোই মুশকিল। প্রতিটি ঘাটেই কড়ি বসিয়েছে তারা। খেতের ফসল, দুধের গাভি আর জলের মাছ-কোনোটাই ছাড়ছে না তারা। নৌকারানির আমলে দুধের শিশু থেকে মেজো কোটাল-নিরাপদ নয় কেউ। এ অঞ্চলে কিছু একটা শুরু করলেই তরুণ মাঝিরা খবর পেয়ে যায়; তারপর দুধের মাছির মতো হামলে পড়ে; কখনো হুল ফোটায় মৌমাছির মতো, কখনো বা কালনাগিনী হয়ে দংশন করে। কয়েক দিন আগের এই ছোট যুদ্ধে আঞ্চলিক চৌকিদার আর আড়কাঠিদের না লাগালে কী-ই বা এমন ক্ষতি হতো। বড়জোর হেরে যেত নৌকানগর। কিন্তু অন্যের সহযোগিতার এ জয় যে পরাজয়ের চেয়েও কালিমাময়। এ রকম অনুভূতি নিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন কয়েকজন।
কারও ভাবনায় অবশ্য ঠিক পথেই এগোচ্ছে নৌকানগর। ধানগ্রামকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে শক্তি প্রয়োজন, আর কে না জানে, অর্থের চেয়ে বড় শক্তি আর কিছু হতে পারে না। এই অর্থ দিয়েই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বেয়াড়া বণিক আর সেয়ানা সেনাপতিকে বশে রাখতে টাকার বড় দাওয়াই নেই। আর টাকা রোজগার করতে গেলে একটু ডান-বাম করতেই হয়।
খবর পাওয়া গেল, নৌকারানি আসছেন। চাঙা হয়ে উঠলেন সবাই। জয়ধ্বনিও দিলেন কয়েকজন। প্রিয় প্রজাগণ, নৌকারানি খুশিয়াল গলায় বলেন-পানি ঘোলা করা ধানগ্রামের চিরকালের অভ্যাস। বড় যুদ্ধে হেরেও করতে চেয়েছিল। আমরা সতর্ক ছিলাম বলে পারেনি। এবারেও পারবে না। শুনেছি, তারা নাকি ভোলা নামের এক কামানের গোলা এনেছে। আমার কাছে পাকা খবর আছে যে, ওটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। কিন্তু এই খবর আমরা ধানগ্রামকে জানতে দেব না। গোলা দেখানোর শাস্তি হিসেবেই প্রচণ্ড মার দেওয়া হবে ধানগ্রামকে। নৌকানগরের জয় হোক।
গল্পের শেষ
গল্পের শেষটুক আমরা জানি না। হয়তো আমাদের জানাও আছে বটে। কিন্তু অনেকবার আর অনেকভাবে বলা ওই গল্পের মধ্যে নতুনের আর নুন নেই। গল্প না বলে কোনো খবর দিতে পারলে আমরা আনন্দিত হতাম। এ মুহূর্তে পারছি না বলে আপনাদের অন্য তিনটি গল্প শোনানো যাক। গল্পগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পেলে আমাদের জানাবেন।
১. কথিত আছে, বিখ্যাত নাট্যকার বার্নার্ড শ একবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে তার রচিত নাটকের দুটো টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রাপ্তি স্বীকার করে চার্চিল লেখেন, দ্বিতীয় শোয়ের টিকিট পাঠাও, কারণ প্রথম রাতের শোতে আমি যেতে পারব না। পুনশ্চ দিয়ে চার্চিল লেখেন, অবশ্য যদি তোমার নাটকের দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়! শ ফিরতি চিঠিতে লেখেন, এটা দ্বিতীয় প্রদর্শনীরই টিকিট। তোমাকে দুটো পাঠানো হলো, ইচ্ছে করলে তুমি তোমার কোনো বন্ধু নিয়ে আসতে পারো। পুনশ্চ দিয়ে তিনি লেখেন, অবশ্য তোমার যদি কোনো বন্ধু থাকে!
২. বাবা, সব রূপকথার গল্পই এভাবে শুরু হয় কেন যে, একদা এক দেশ ছিল। ছোট্ট মেয়ে জানতে চায়। বাবা জবাব দেন, নাহ্ মা, অন্য রকম রূপকথাও আছে। কোনো কোনো রূপকথা শুরু হয় ‘যদি আমি নির্বাচিত হই’ একথা বলেও।
৩. সরকারি দলের একজন সংসদ সদস্যের কাছে হঠাৎ আশ্চর্য প্রদীপটি এসে পড়ল। ঘষা দিতেই যথারীতি বেরিয়ে এল একটি দৈত্য। আপনি আমার কাছে তিনটি ইচ্ছা জানাতে পারেন, তবে এখনকার নিয়ম এই যে বিরোধী দলের একজন সদস্য আপনার ইচ্ছার দ্বিগুণ পাবেন-এক নিঃশ্বাসে দৈত্য জানিয়ে দেয়। সরকারি এমপি একটি ফোর হুইলার চাইলেন। বিরোধী দলের একজন এমপি এইমাত্র দুটি ফোর হুইলার গাড়ি পেলেন-দৈত্য জানায়। আমার এক শ কোটি টাকা চাই। বিরোধী দলের একজন এমপি এইমাত্র দুই শ কোটি টাকা পেলেন-দৈত্য জানায়। আমি সব সময়ই আমার একটি কিডনি দান করে দিতে চেয়েছি। বাকরুদ্ধ দৈত্যের সামনে শেষ আবদার জানান সরকারি দলের এমপি।
(ভোলা উপনির্বাচনের পর ২০১০ সালে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাগজের কভার স্টোরি)
খালেদ মুহিউদ্দীন, সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক, প্রধান, ডয়চেভেলে বাংলা বিভাগ।