কাকন রেজা : একজন গণমাধ্যমকর্মী, বিশেষ করে যিনি রিপোর্টিংয়ে আছেন, তার বড় সাফল্য হলো খবরের পেছনের খবর বের করে আনা। এই যে, আমাদের ময়মনসিংহের ত্রিশালের সোহেল-রওশন দম্পত্তি নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। বলা হলো, প্রতিবন্ধী স্ত্রী রওশনকে কাঁধে বয়ে পনেরো বছর ধরে সংসার করছেন সোহেল। তাদের এই প্রেম রীতিমত একটি স্বর্গীয় মাত্রা পেলো। সোহেল হয়ে উঠলেন প্রায় ফেরেশতা সমান মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত এগিয়ে এলেন এই দম্পত্তিকে সহায়তা করতে। তারপর কি দেখা গেলো। অবলুপ্ত প্রায় হাটে-বাজারে চৌকোণা বাক্সের মধ্যে দেখানো বায়স্কোপের মতন বলতে হয়, ‘তারপরেতে কী আছে’। তারপরে যা আছে তাতে জানা গেলো, ফেরেশতা সোহেল সাথে একজন প্রচঞ্চকও। একই অঙ্গে দুই রূপ। যিনি তার প্রথম স্ত্রী ও চার সন্তানকে ফেলে এসেছিলেন। যারা দীর্ঘদিন স্বামী ও পিতার অভাবে থেকেছেন, বেড়ে উঠেছেন অবহেলা আর বঞ্চনায়। প্রবঞ্চনা এমন এক্সট্রিম পর্যায়ের পৌঁচেছিলো যে, সোহেল তার তার নামও পরিবর্তন করে ফেলেছিলেন।
খবরের পেছেনের খবর খুঁজতে গিয়েই সোহেলের আসল পরিচয় ও চরিত্রটা সামনে এসেছে। এই যে ভানটাকে অতিক্রম করে মূলের কাছে পৌঁছানো, এটাই মূলত সাংবাদিকতা। জানি, অর্ধশিক্ষিত যেসব ‘সাংবাদিক’রা আছেন তারা বলবেন, এটা তো ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা। তাদের জ্ঞাতার্থে ছো্ট্ট টিপস দিই। প্রথমত, একজন গণমাধ্যমকর্মীর প্রচার আর খবরের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে হবে।
একজন ডাক্তার প্রতিদিন হাসপাতালে রোগী দেখেন, এটা খবর নয় প্রচার। কারণ ডাক্তারের কাজই প্রতিদিন রোগী দেখা। এখানে খবর হলো ডাক্তার সপ্তাহে দুদিন প্রাইভেট ক্লিনিকে বসেন দেখে ওই দুদিন হাসপাতালে রোগী দেখা বন্ধ থাকে। আর এই খবরটির জন্য সামান্য হলেও অনুসন্ধান প্রয়োজন। ডাক্তার কোন কোন দিন ক্লিনিকে বসেন, কোন ক্লিনিকে বসেন সহ আরো কিছু অনুসন্ধানের পরই সেই খবর তৈরি হয়। সুতরাং খবর মানেই অনুসন্ধান, সেটা সামান্য হলেও। আর যা কিছু অনুসন্ধান করতে হয় না, তা মূলত প্রচার। আর বাড়িয়ে বলাটা কিংবা মিথ্যা বলাটা হলো প্রচারণা।
মুশকিল হলো, বেশি টিপস দিলে আবার আমাদের অনেক কর্তাব্যক্তিরা রুষ্ঠ হবেন। যারা কিনা অনেক খবরমাধ্যমের মাথায় বসে আছেন। যেখানে থেকে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কাজটাই করছেন বেশি। খবর না করে প্রচার করছেন। কখনো কর্পোরেট মালিকের প্রচার, কখনো বা রাজনৈতিক প্রভুর প্রচার। প্রচার বলাটাও ঠিক হলো না, সঠিক হবে প্রচারণা। এ শব্দ দুটির পার্থক্যও হয়তো তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তাই প্রচারের বদলে প্রচারণাই করেন, বাড়িয়ে বলেন, মিথ্যে বলেন। সুতরাং তাদের খবর কোনটা আর প্রচার কিংবা প্রচারণা কোনটা তা সঠিক অর্থে ধরিয়ে দিতে গেলে হাতে হারিকেন উঠবে। তাই বরং ‘বোকা থেকে সুখি হতে চাই’ কৌশলটা নেয়াই ভালো। বোকা এবং বোবার নাকি শত্রু নাই।
তবে হাল সময়ে এই কথাটাও আর যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না, এ প্রশ্ন করলেই ওই কথাটা চলে আসে, ‘তুমি হয় আমার লোক নয় প্রতিপক্ষের’। সুতরাং বোকা ও বোবা বনে থাকাটাও এখন রিস্কি। আপনি নিরপেক্ষ থাকতে চাইলে অবস্থা বিপদসংকুল হবে। দু’পক্ষই ভাববে সে আমার লোক নয়। পক্ষপাতিত্ব করলে অন্তত একটা পক্ষকে সাথে পাবেন, নিরপেক্ষ থাকলে দুটো পক্ষই আপনার বিপক্ষে যাবে। আর সৎ এবং সততার প্রশ্নে তো অবস্থা আরো ভয়াবহ।
আলোচিত দুদক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির ব্যাপারটি ভালোমত অনুধাবন করলেই বুঝতে পারবেন সেই ভয়াবহতার মাত্রা। যাকগে, বাদ দিই। ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় তোর অনুকূলে না’, গ্রাফিতির এই লেখাটাকে মেনে নিই। এক সময় অভিমত বা মতামত কিংবা উপসম্পাদকীয় যাই বলি না কেন, সবই ছিলো বিভিন্ন বিষয়ের অসঙ্গতি ধরিয়ে দেয়ার জন্য, যাতে সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হন। হতেনও। সমালোচনা বিষয়টিই তাই। কিন্তু এখন অবস্থা হয়েছে উল্টো। অবস্থাদৃষ্টে গুরু আযম খানের গান মনে পড়ে যায়, ‘পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না’। আর সেই আঙ্গিকে অসঙ্গতি ধরিয়ে দেয়া মানে, পাগলকে নাও ডোবানোর কথা মনে করিয়ে দেয়া। তাতেও আপত্তি ছিলো না, কিন্তু সেই নাওয়ের যাত্রী তো আমরা আমপাবলিকরাই, আপত্তিটা সেখানেই।
কাকন রেজাঃ সাংবাদিক, কলামনিস্ট