প্রাজ্ঞ সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারী অনেকদিন পর জাতীয় সংসদে বাঙালি মনীষার আলো জ্বেলেছেন। স্বদেশ ভাবনায় দেশের সংকট ও তা অতিক্রমের রোডম্যাপ দিয়েছেন বারো মিনিটের বক্তৃতায়। এই ভাষণটি আকাশে উড়ছে আলোর ঘুড্ডি হয়ে। পুরো সংকটের যে গোড়ার কথাটি, তা তিনি একটি লাইনে বলেছেন। যেদেশের তিনটি প্রধান দলের নেত্রী গত ২১ বছরে একসঙ্গে বসে চা খাননি; সেদেশে বহিঃশক্তি তো আঘাত হানবেই; এ হচ্ছে তার বক্তব্যের নির্যাস।
এ প্রশ্নের উত্তর নিজে খুঁজেছি অনেকক্ষণ। পৃথিবীর আর কোন গণতান্ত্রিক দেশে এরকম মুখ দেখাদেখি বন্ধের নজির নেই। এটা কেবল বাংলাদেশের কালচারেই সম্ভব। জমির ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে, বোনে-বোনে সব রকম সম্পর্কের রসায়নে ‘শতবছরের কাইজ্জা’-র ইতিহাস কেবল এইখানে। এইখানে সম্পদ ও স্বার্থের বাইরে কেউ এক ইঞ্চি যেতে পারে না। এইখানে ‘লেবু চিপে তেতো’ করার সব রকম পদ্ধতি চালু আছে। এইখানে স্বার্থ ও বিষয়বুদ্ধির বাইরের মানুষেরা আউটসাইডার; তারা ঢাকায় থাকলেও নিঃসঙ্গ দ্বীপের বাসিন্দা। আর দেশান্তরী হলে সেই বুঝি দু’দণ্ড শান্তি; জীবনানন্দের দু’দণ্ড শান্তি পাওয়ার বনলতা সেন; সেই এসকেপিজম বা পালিয়ে বাঁচা।
এই যে আমরা সবাই মিলে তিনজন নারীর ওপর সব দায় চাপিয়ে ইনডেমনিটি পেতে চাইছি; এতে কী শেষ রক্ষা হবে! এই তিনজন নারী একটি রক্ষণশীল সমাজে বেড়ে ওঠা নানারকম অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতার নারী। জার্মান নেত্রী আঙ্গেলা ম্যারকেল, নিউজিল্যান্ডের জোসিন্ডা, কিংবা অতীতের মার্গারেট থ্যাচারের মতো মুক্ত শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য কোনটিই কী পেয়েছেন বাংলাদেশের এই তিন নারী। তিনজন অবরোধবাসিনীকে রাজতন্ত্রের সামন্ত দাবীতে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে; গণতন্ত্র খুঁজছি আমরা। বাংলাদেশের মানুষ জীনগতভাবে রাজা-রাণী-জমিদার শাসনে প্রস্তুত। ফলে তারা আজন্ম প্রজা। নাগরিক হবার মতো মানসিকতাই গড়ে ওঠেনি। কীকরে এখানে আমরা কল্যাণ রাষ্ট্র আশা করি, বাকস্বাধীনতায় উদ্বেল সচল সমাজ চাই। কী চারা লাগিয়েছি যে আজ শতফুল ফোটার স্বপ্ন বৃক্ষ চেয়ে কষ্ট পাই আমরা।
স্মার্টনেস ব্যাপারটা কী শিফন কিংবা জামদানিতে থাকে, নাকি কোটে থাকে, নাকি সাফারিতে থাকে! ওটা তো থাকে মস্তিষ্কে। এই মস্তিষ্ক বাড়তে হয় শৈশব থেকে। যে মেয়েটির ছবি আঁকা-কবিতা লেখা-গান গাওয়ার ক্ষমতার লালন না করে; বিশ্ববীক্ষায় শিক্ষিত না করে; কেবল বিয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে; তিনি কী করে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাবেন। সোশ্যাল কন্ডিশনিং তার মধ্যে ক্রোধ, অহংকার, প্রতিশোধ, ছোট স্বার্থ চিন্তা ছাড়া আর কী দিতে পারে! এই চোখের বদলে চোখ, ঘৃণা-বিদ্বেষের সমাজে; তিনটি অলীক বৃক্ষ চেয়েছে মানুষ। ঐ যে রক্তে জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা খুলে হেঁটে যাবার; ঝুঁকে যাওয়া, কুঁচকে যাওয়া; এই যে তেলাঞ্জলির বিনিময়ে রাণীর অনুকম্পা প্রার্থনা করার যে ডিএনএ, সে কী করে সভ্যতার দাবী নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াবে!
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশ আমলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উপায়হীন সমাজকে সঙ্গে নিয়ে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছে। সেখানে যুক্ত হয়েছে সমাজের স্বশিক্ষিত মানুষেরা। ফলে ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা এসেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিতরা কৃষক-শ্রমিককে সঙ্গে নিয়ে ভাষা আন্দোলন থেকে নবজাগরণের সরণি ধরে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে দিয়েছে বাংলাদেশকে। তখন তারা সামাজিক গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছে; সামাজিক সুবিচারের স্বপ্ন দেখেছে।
স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাবার পর জাতির জনক বিস্মিত হয়েছেন, চোরের খনির চাটার দল দেখে। ঔপনিবেশিক ডান্ডার ভয়ে চোরগুলো মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে ঢুকে গিয়েছিলো । এরা হচ্ছে ফিফথ কলামনিস্ট একটিভিস্ট। থাগস অফ ইস্ট বেঙ্গল। শুধু চুরি করে সুবিধা হচ্ছে না; ফ্রি স্টাইলে ডাকাতি করা যাচ্ছে না; এই আক্রোশে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমানকে হত্যা ও এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ক্ষেত্রে একই ব্যাপার। ফিফথ কলামনিস্টরা হাসিনা-খালেদাকে সামনে রেখে লুটপাট করতে চেয়েছে। এতো রক্ষণশীল সমাজে বেড়ে ওঠা দুটো মেয়ে চোর-ডাকাত চিনবে কী করে! এরপর আরেকদল রঙ্গিন চোর রওশনকে সামনে এগিয়ে দিয়ে সমানে লুটপাট করে চলেছে।যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ; এইখানে পুরুষের সামনে চোর চুরি করতে ভয় পায়। সেইভয় বঙ্গবন্ধু-জিয়া-এরশাদকে পেয়েছে। হাসিনা-খালেদা-রওশনকে চোরেরা ভয় কম পায়।
আমরা নিজেরাও শৈশবে আব্বা ট্যুরে যাচ্ছেন শুনলে আনন্দে মাথা খারাপ হয়ে যেতো। ভাবতাম, আম্মাতো আমাদের ‘লটর-পটর’ ধরতে পারবেন না। আমার প্রয়োজন না থাকলেও আম্মার ব্যাগ থেকে টাকা সরাতাম। কারণ আম্মা ছোট খাট চুরি ধরতে পারতেন না। আব্বার পকেট থেকে দশটাকা সরাতেই আব্বা বলেছিলেন, আমার তো হিসাব থাকে। তোমার আম্মার ব্যাগ থেকে নিও, ধরতেও পারবে না। এরপর সোজা হয়ে গেছি স্বভাবতই।
বঙ্গবন্ধু এক সভায় বলেছিলেন, ঐ লটর পটর করিসনা। আমার চোখের বাইরে গেলেই তো তোরা লটরপটর করিস।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে থোড়াই কেয়ার করে। দক্ষিণ এশীয় নারী সরল, মায়াময়, বিশ্বাসপ্রবণ, বাস্তব অভিজ্ঞতা বঞ্চিত। তাকে দিয়ে ফেইক জন্মদিন পালন করানো যায়, তাকে প্রতিশোধে প্রবৃত্ত করা যায়, তাকে বোকা বানানো যায়।’উনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে’-এই বাক্যটি নিয়ে আমরা হাসি। কিন্তু প্রতিদিন তিন নেত্রীর সঙ্গে যারা কথা বলেন, তারা কানভারি করতে আসেন। কানভারি করাটা বাটপারি ব্যবসার প্রধান মূলধন। শুধু কান ভারী করার ক্ষমতার কারণে কত লোক কুঁড়ে ঘর থেকে প্রাসাদ করেছে; আগে পান্তা খাইতো এখন পাস্তা খায়। আগে মাথায় সরিষার তেল দিতো, এখন জেল দেয়।
আমি বরং এই তিন নারীকে ট্র্যাজেডির নায়িকা হিসেবে দেখি। দেখতে সুন্দর, মায়াময়, আবেগপ্রবণ তিনজন নারী, নরভোজি সমাজের গ্ল্যাডিয়েটরের দর্শক হলেন, এরপর নিজেরাও নরভোজে অভ্যস্ত হলেন। সারাটা জীবন দেশের মানুষকে ভালোবেসে, এখন দেশের সব দুর্গতির জন্য দায়ী হচ্ছেন তারা। অথচ থাগস অফ বেঙ্গল তাদেরকে ব্যবহার করেছে, নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের শিখণ্ডি হিসেবে।
উনারা যাতে একসঙ্গে চা খেতে না বসেন, সেই চেষ্টায় দেখবেন ফেসবুকে প্রাণপাত করে চলেছেন, ফইন্নির ঘরের ফইন্নিরা। হাওয়া-সুচিন্তা-রাঙ্গা ভবন বানিয়ে ভিক্ষা করে রাজপ্রাসাদ গড়ার খায়েশ পূর্ণ করেছে যারা কিংবা এরকম ফইন্নি আশায় আছে যারা। এই সেই থাগস অফ বেঙ্গল যারা নিরীহ পথচারীকে রুমালের ফাঁস দিয়ে হত্যা করতো। এই সেই ডিন এন এ, যা এখন পাঁচতারকা হোটেলের সুইমিংপুলে উন্নয়নের জেলিফিশ হয়ে সাঁতার কাটে। উনারা তিনজন একসঙ্গে বসে চা খেলে যদি আবার কাছা মেরে খালে বিলে গামছা দিয়ে মলা-ঢেলা-কেঁচকি ধরে খেতে হয়! সুতরাং কানভারির সমস্ত পিঁপড়া বিদ্যা দিয়ে উনাদের চা-খাওয়া ঠেকাতে হবে। আমরা কিন্তু ঠিকই সর্বদলীয় চোর ভাইয়েরা বসে গ্লোরিয়া জিনসে ক্যাপাচুনো খাবো।