মাসকাওয়াথ আহসান
সবাই মাঠে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দলের ক্রিকেট খেলা দেখে। আমি ফেসবুকে এর উগ্রজাতীয়তাবাদী সহমত-শিবব্রত ও পাটোয়ারী-ইউথিয়া সমর্থকদের পড়ি। প্রেসিডেন্টশিয়াল বক্সে সোফায় মেদ-ভুঁড়ি এলিয়ে বসে থাকা দুই দেশের স্বাধীনতার সুফল কুড়ানো টোকাইদের দেখি।
আমি দেখি গোপাল ভিলেজের ছাতা সারাইয়ের নাতি আর পুঞ্জাব ভিলেজের টুপি সেলাইয়ের নাতিরা কীভাবে দেশ দুটো খেয়ে স্লামডগ বিলিওনিয়ার হয়েছে।
খেলা তো খেলাই; যেভাবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা খেলে এমনকী ঘরের কাছের শ্রীলংকা খেলে; সাগরপাড়ের ইংল্যান্ড খেলে। কিন্তু গোপাল ভিলেজ ও পুঞ্জাব ভিলেজের থাগসদের খেলার সঙ্গে রাজনীতি মেশাতে হয়; মাথায় পতাকা বেঁধে গালে পতাকা এঁকে তারপর ব্যাংক ও শেয়ারবাজার খেয়ে বেড়াতে হয়। পড়ালেখায় ক-অক্ষর গোমাংস; কিন্তু দেশলুন্ঠন করে এরা সেকেন্ড হোম গড়েছে পশ্চিমে; বৌবাচ্চা সেখানেই থাকে। আর থাগসেরা প্রতিটি ম্যাচের পর চলে যায় পাপিয়ামাণ্ডি ও হীরামাণ্ডিতে।
শিবব্রত আর ইউথিয়ার কুঁচকুঁচানিটা আরো সূক্ষ্ম; অনেকটা জায়নিস্টদের মতো। এরা সহমত ও পাটোয়ারিদের মাথায় উগ্রজাতীয়তাদের উপাদান সরবরাহ করে। ফেসবুক পোস্টে দেখবেন শিবব্রত গালে সুপোরি পুরে বিদ্বেষের গল্পটা তোলে। ইউথিয়াও গালে চেবানো চুইংগাম পুরে বিদ্বেষ চেবায়।
যতবার বাংলাদেশ ও পাকিস্তান জেতে; ঠিক ততোবার উগ্রজাতীয়তাবাদের হুক্কা-হুয়া ওঠে ধানক্ষেত ও গমক্ষেতের থকথকে কাদায়। এই ধানক্ষেত ও গমক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়া বৃটিশ রেলপথের ধারে বসে প্রাতঃক্রিয়া প্রক্ষেপণের সময়; ছাতা সারাইওয়ালা ও টুপি সেলাইওয়ালা পণ করেছিলো; তাদের উত্তরপুরুষ সাগরপাড়ের ইংলন্ডে থাকবে; তারজন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তান লণ্ডভন্ড করা ডাকাতি সংঘটন করতে হবে।
নাতিরা ঠিকই প্রকল্প ডাকাতি করে; পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিলাস সামগ্রীর সাপ্লাইয়ার হয়ে; নতুন দালানে সোনার তৈরি কমোড বানিয়েছে। সেইখানে বসে আই ফোন হাতে নিয়ে দেশপ্রেমের কন্সটিপেশন ছোটায়। বঙ্গস্থলী ও পাকস্থলীতে জায়গা কম পড়ায় এদের মস্তিষ্কে জমা হয় জাতীয়তাবাদের “গু”। তাই তো এরা “গু”জব ছড়াতে সিদ্ধহস্ত।
সহমত-শিবব্রত আর পাটোয়ারি-ইউথিয়া ক্রসফায়ার ও গুমের সমর্থক, এজেন্সির ও প্রমোদ-সাপ্লাই এজেন্সির পিম্প। এরকম হীনমানুষ নিয়ান্দারথালের ইতিহাসে বিরল। এমনকী মোদীর ভক্তগুলোও আইসিসির নির্দেশনা মেনে উগ্রজাতীয়তাবাদের চিহ্ন প্রদর্শন করেনি স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে। অথচ থাগস অফ বাংলাদেশ ও থাগস অফ পাকিস্তান হচ্ছে জঙ্গলের আইনে বেড়ে ওঠা শেয়াল। সে কেন মানবে কোন শৃংখলা। নিজের দেশে জঙ্গলের আইন বলে; এরা যেখানে যায়; সেইখানেই ছাতাসারাই ও টুপিসেলাই দাদার মতো মনের প্রাতঃক্রিয়া প্রক্ষেপণ করে।
দেশের মানুষ দ্রব্যমূল্যের আগুনে পুড়লেও এরা ক্রিকেটের বাঁশী বাজায়। এদের বুড়ো ভাম লোলচর্ম পোষা সাংবাদিক ফেসবুকে উগ্ররজাতীয়তাবাদী পোস্ট দিয়ে গদগদ হয়। অমনি আলফাডাঙ্গা ও রাইব্যান্ডের স্কুল গ্রাজুয়েট মেয়েগুলো ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক দিয়ে এসে খলবল করে, এইজন্যিই তো আন্নের ভালু পাই ভাইজান। সাংবাদিক সুযোগ পেয়ে একটু দুষ্টুমি করে, ভাড়াডা ইট্টু বাড়ায়ে দিয়েন গো আপা।
পুলিশ আর এজেন্সির শক্তিতে ক্ষমতা ধরে রাখা এই নরভোজিগুলো ক্রিকেটের ওপিয়ামে বুঁদ করে রাখতে চায় নতুন প্রজন্মকে। যাতে স্বাধীনতার সুফল কুড়ানোর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী ধরে রাখা যায়। আমরা নয়মাসের রাজাকার কিংবা পাঁচবছরের নাতসি দেখে আঁতকে উঠি। অথচ ঠাহর করতে পারিনা; ক্ষমতার চিরস্থায়ী কোলাবরেটর এই সহমত-শিবব্রত, পাটোয়ারি-ইউথিয়ার নরভোজিতা।
এই সহমত স্বপ্ন দেখিয়েছিলো, পাকিস্তান উপনিবেশ থেকে মুক্ত করে তোমাদের হাজার বছরের শৃংখল থেকে মুক্তি দেবো। এই পাটোয়ারি স্বপ্ন দেখিয়েছিলো, বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত করে তোমাদের হাজার বছরের শৃংখল থেকে মুক্তি দেবো। কিন্তু লক্ষ্য ছিলো তাদের স্বদেশী থাগসের উপনিবেশ স্থাপন। বালি-নদী-ভূমি-পাহাড় ও মানুষ খাওয়ার। ঔপনিবেশিক বুর্জোয়া হটিয়ে ধানক্ষেত ও গমক্ষেতের অলিগার্ক তৈরিতে তারা বেশ সফল হয়েছে। যেরকম লুন্ঠন ও পাচার ঔপনিবেশিক অপশক্তি করেছে; তার চেয়ে অনেকগুন বেশি লুন্ঠন ও পাচার করেছে এই দুটি স্বদেশী ডাকাতের দল।
এরা উত্তর কোরিয়ার মতো চিরস্থায়ী ক্ষমতার স্বপ্ন দেখে; কিম জং উন যেরকম আইস-হকি খেলায় মাতিয়ে রাখতে চায় উগ্রজাতীয়তাবাদ; এরাও তেমনি ক্রিকেট খেলা দিয়ে মাতাতে চায় দেশপ্রেমের লিপ সার্ভিস আর উগ্রজাতীয়তাবাদের খেমটা নাচ।
এতো উদগ্র আত্মপ্রেমিক কী করে দেশপ্রেমিক হবে; এমন নির্লজ্জ সেকেন্ড হোমাররা কী করে জাতীয়তাবাদী হবে!
যতবার বাংলাদেশ ক্রিকেটে জিতে; ততবার হেরে যায় বাংলাদেশের নিরন্ন মানুষ। যতবার পাকিস্তান ক্রিকেটে জিতে ততবার হেরে যায় পাকিস্তানের অভুক্ত মানুষ। ক্রিকেট হচ্ছে এ যুগের গ্ল্যাডিয়েটর এই সহমত-শিবব্রত, পাটোয়ারি-ইউথিয়াদের জন্য। ক্রিকেট হচ্ছে গুম খেলার ও ভোট চুরি খেলার ফোর প্লে।
“Truth is so obscure in these times, and falsehood so established, that unless we love the truth, we cannot know it.”–Blaise Pascal
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।