বিশ্বেন্দু নন্দ
এই বিষয়টা বুঝতে গেলে আমি আমার মত করে উপনিবেশ এবং উপনিবেশ-পূর্ব সময় বোঝার জন্যে একটা তুলনামূলক বয়ান খাড়া করেছি।
পলাশী উত্তর আর পলাশী পূর্ব সময় জানা-বোঝার ১৩ সূত্র
১। পলাশীপূর্ব সময়ে রাষ্ট্র পরিচালকেরা ইওরোপে বিকশিত এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক ধর্ম নির্ভর জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থার ধারণা প্রয়োগ করেন নি। গত ২৫০ বছরে বিকশিত রাষ্ট্রীয় কাঠামো নেশন স্টেট নির্ভর করে বাংলায় দুটো বড় আর বহু ছোট গণহত্যা হয়েছে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আরও বেশি কেন্দ্রিভূত হচ্ছে। ইওরোপিয় জাতিরাষ্ট্র কাঠামো অবলম্বনে ইওরোপ শাসনপূর্ব বাঙলা এবং দক্ষিণ এশিয়াকে বুঝতে এবং বিশ্লেষণ করতে চাওয়ার উদ্যম শুধু বিভ্রান্তিযোগ্যই নয়, অনৈতিহাসিকও বটে।
২। মুঘল আমলে বাংলা সুবা তৈরি হলেও বাংলার প্রাচীন বিভাগগুলোর ভৌগোলিক স্বাতন্ত্র বহুকাল বজায় ছিল। সুলতানি, মুঘল এবং নবাবি আমলে জমিদারেরা রাজস্বদায়ী হলেও কতগুলি ক্ষেত্র বাদে সমসত্ত্ব অখণ্ড বাংলা, সমসত্ত্ব বাঙালী, বাঙলা ভাষার ধারণা তৈরি হয় নি। গত ২০০ বছর ব্রিটিশ জাতিরাষ্ট্রবাদ, এককেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা, দখলদারি প্রশাসন, সমাজ, ব্যক্তি, গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্রে দখলদারি চাপিয়ে বিকেন্দ্রিভূত এলাকাগুলো বৈচিত্রপূর্ণ ভাষা, অর্থনীতি, কৃষ্টি ধ্বংস করে সমসত্ত্ব বাংলা নামক রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করে, উপনিবেশিক শাসন চালানোর জন্যে ভদ্রবিত্তীয় ইওরোপমন্য সহযোগী তৈরি করেছে। ফলে জাতিরাষ্ট্রের বাস্তবতা, তাত্ত্বিক অবস্থান অবলম্বন করে পলাশীপূর্ব সময় বুঝতে, বিশ্লেষণ করতে চাওয়া সমস্যাযোগ্য প্রকল্প।
৩। আমি যে ভাষায় ফেবুকে, বইতে, পত্রিকায় লিখি, সেই প্রমিত বাঙলা ব্রিটিশদের দান। ব্রিটিশ আমলের আগে মৌখিক কৃষ্টির তুলনায় দরবারি লেখ্য সংস্কৃতির অংশিদারি খুবই কম ছিল। দরবারি রামপ্রসাদ বা ভারতচন্দ্র যে ভাষায় গান বা কাব্য রচনা করছেন (আজকের ভাষায় লিখছেন বললাম না, কারন তারা যতটা না লিখতেন তার থেকে বেশি রচনা করতেন, কারণ লেখা আর অক্ষরের পবিত্রতার ধারণা ভদ্রবিত্তিয়, ঔপনিবেশিক। উপনিবেশপূর্ব কৃষ্টি শহর বা ভদ্রবিত্তকেন্দ্রিক ছিল না) সেই ভাষায় আলাওল কাব্য রচনা করছেন না, অথচ দুজনেই আজকের ভাষায় বাঙলা দরবারি সংস্কৃতির মানুষ। অথচ দুজনের রচনাকেই আজ বাংলা ভাষা বলা হচ্ছে।
৪। মৌখিক কৃষ্টিই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে উজ্জীবিত রাখত, আজও রাখে। দরবারি সাহিত্য মৌখিক কৃষ্টিরও অংশ ছিল। আজও বাংলা নামে ভৌগোলিক অঞ্চললে দুদশটা গ্রাম পেরোলে ভাষা পালাটে যায় দরবারি সুনীল, শীর্ষেন্দু, জসিমুদ্দিন, আহমদ ছফার বাংলা সাহিত্য-প্রাধান্য সত্ত্বেও। ব্রিটিশ উপনিবেশের আগে বাংলাজুড়ে যে মৌখিক কৃষ্টি চালু ছিল, সেগুলিকেকে ভদ্রবিত্তরা প্রান্তিক, লুপ্তপ্রায় অভিহিত করে লোক নাটক, লোক সঙ্গীত গীতিকা ইত্যাদি লব্জে দেগে দিলেন। ঠাকুমার ঝুলির প্রথম সংস্করণের ভাষা কলকাতা ঢাকার বাবুরা বুঝতে পারেন নি। সেটি নতুন করে লেখা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের যে প্রকাশভঙ্গীগুলোকে ইওরোপিয় ব্যালাডের অনুকরণে গীতিকা বলা হচ্ছে, সেগুলির ভাষা যথেষ্ট আলাদা, শিখা মাহিতি যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন, লীলা-কঙ্ক বা মলুয়া বা মাধব-মালঞ্চি সেই ভাষায় রচিত, গীত হয় না। কলকাতা বা ঢাকার ভাষা প্রমিত, এটাই কৃষ্টির চূড়ান্ত, এটাই একমাত্র অনুসরণযোগ্য বাংলা, এই নিদান ইওরোরোপিয়, এককেন্দ্রিক, সাম্রাজ্যবাদী। উপনিবেশিক ইতিহাসে বলা হয়েছে সুলতানি, মুঘল আমলে ফারসি ছিল রাজভাষা। অড্রে ট্রুস্কে, এলিসন বশ, সঞ্জয় সুব্রহ্মণিয়ম, মুনিস ফারুখি, প্রসন্নন পার্থসারথী, সুপ্রিয়া চৌধুরীরা বলছেন ফারসিকে মুঘলেরা পছন্দ করত, কিন্তু সুবায় ফারসি এবং অঞ্চলের ভাষাতেই তথ্য রাখা হত। রাষ্ট্র-প্রধান নির্দিষ্ট ধর্ম অনুগামী হলেও রাষ্ট্রধর্মের ধারণা ছিল না। বিপুল পরিমান অমুসলমান প্রশাসনে চাকরি করতেন। বাংলায় রাষ্ট্রের পক্ষে মুসলমানদের সঙ্গে অসংখ্য অমুসলমানকে রাজস্বহীন ভূদান করা হয়েছে।
৫। বিকেন্দ্রিভূত ভিন্নতার যে ভৌগোলিক এলাকা ছিল বহুকাল ধরে, যার একক গ্রাম, প্রতি গ্রামঅঞ্চলের কৃ্ষ্টি আলাদা ছিল এবং এগুলিকে সমসত্ত্ব বাংলা ভাষী অঞ্চল বলার ধারণা তৈরি হয় নি। ব্রিটিশপূর্ব সময়ের রাষ্ট্র ভাষা বা রাষ্ট্রীয় কৃষ্টি চাপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে বা দক্ষতা বা ধারণাটা কোনওটাই ছিল না। ব্রিটিশকে এটা তৈরি করতে হল কারণ, উপনিবেশিক রাষ্ট্র শুধু শাসন করে না, পলাশি পরবর্তী সময়ে যে যেহেতু ব্যবসা আর শাসন করার নামে লুঠ করছে, সেই লুঠের পরিধি বাড়াবার জন্যে ভাষা, কৃষ্টি, রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমসত্ত্বতার ধারণা তৈরি করছে। এই রোগের উপসর্গটি হল বাংলা জোড়া নবজাগরণ নামক একটা অভদ্রলোকবিদ্বেষী, ইসলামবিদ্বষী, মহিলাবিদ্বেষী, বৈচিত্রবিদ্বেষী জাতিরাষ্ট্রবাদ। উপনিবেশ কৃষ্টি চাপায় কারণ সমসত্ত্ব সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে সে রাষ্ট্রীয় লুঠ জায়েজ করে, প্রগতিশীল দেখায়, কোলাবরেটরেদের লুঠেরা সংস্কৃতিতে আত্মীভূত করে।
৬। কেন্দ্রিভূত শিক্ষাদান ব্যবস্থা ছিল না। রাষ্ট্র কর্পোরেট চাহিদায় সাম্রাজ্যজুড়ে এক ধরণের পাঠ্যক্রম চাপিয়ে দিত না। বৌদ্ধ আমলেও মঠে শিক্ষার্থীদের বেছে নেওয়া হলেও বিহারগুলোয় আলাদা আলাদা পাঠ্যক্রম ছিল। ইওরোপিয় লুঠ কার্যকর করার জন্যে একই রকম পাঠ্যক্রম, শিক্ষা কাঠামোর প্রচলনের দরকার হল। ব্রিটিশপূর্ব রাষ্ট্র ব্যবস্থা লুঠেরা ছিল না, শোষক ছিল, তাই সে শিক্ষা, কৃষ্টি, ভাষা – কোনও কিছুই কেন্দ্রিভূত করে নি।
৭। উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল বিকেন্দ্রিক। এই ব্যবস্থা মাথাউঁচু করে নিয়ন্ত্রণ করত একধারে অজস্র কারিগর, হকার, চাষী, ছোট ব্যবসায়ী অন্যদিকে রাজধানী নির্ভর মস্ত শ্রেষ্ঠীরা। কাঠামো বিকাশ, শুল্ক আদায় ছাড়া ছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে, উৎপাদনের কাঠামো পরিবর্তনের কাজে মাথা গলাত না। উৎপাদন ব্যবস্থায়, কারিগর, চাষী, হকারের বড় ভূমিকা ছিল। খুব ছোট করে হলেও ইওরোপিয় কোম্পানিগুলো এবং রাষ্ট্রও কারখানা ব্যবস্থা চালালেও কেন্দ্রিভূত কারখানা বা কর্পোরেট ব্যবস্থা, বিকেন্দ্রিভূত কারিগর ব্যবস্থা ভাঙার চেষ্টা করে নি।
৮। বিকেন্দ্রিভূত ব্যক্তি এবং সমষ্টি কারিগর-হকার-চাষী উদ্ভুত সমস্যা নিরসন করতেন। নতুন নতুন নকশা, নতুন আঙ্গিকের কাপড়ের চাহিদা এলে, নতুন পণ্য উৎপাদনে নতুন কারিগরি প্রয়োজন হলে সেটার জন্যে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করতে হত না। বিভিন্ন কোম্পানি কারিগরদের সঙ্গে বা আড়ংএর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় নতুন নকশা, আঙ্গিক ইত্যাদি নমুনা দিত, সেটা স্থানীয় স্তরেই সমাধান করা হয়েছে। আবার ১৬০০ থেকে ১৬৯০এর মধ্যে বাংলায় কাপড়ের বিপুল চাহিদা বাড়লে বাংলায় শাহী কারখানা কাঠামো থাকা সত্ত্বেও নতুন চাষের জমি, নতুন দক্ষ কারিগর, নতুন উৎপাদন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে এবং যন্ত্রের উতপাদকতাকেও বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের হাতে যায় নি। এতে সামাজিকভাবে বহু মানুষ কাজ পেয়েছেন, বিশাল সামাজিক কাঠামো তৈরি হয়েছে।
প্রাচ্যবাদী, বামীয় ভাষায় অনড় অচল গ্রাম ব্যবস্থার ধারণা দুই মলাটের মধ্যেই থাকত। পলাশীপূর্ব বাংলার গ্রাম বিশ্ববাজারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার ছিল, নিজের স্থানিক চরিত্র বিসর্জন না দিয়েই।
৯। বাংলা, ভারতবর্ষ, এশিয় এবং অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রীয় উপনিবেশিক অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়ে ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক, বিশ্বের ৮৩ শতাংশ জিডিপিওয়ালা এশিয় দেশগুলো মূলত বিদেশী বাজারের জন্যে উৎপাদন করত। বাস্তব ছিল উল্টো। পণ্য উৎপাদন মূলত স্থানীয় বাজারের জন্যে হত; কয়েকটা ব্যতিক্রমী পণ্য ছাড়া, উৎপাদন-উদ্বৃত্ত যেত আঞ্চলিক অর্থনীতির বাইরে। এই ধারণাটা পড়ে অনেকেরই জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থা উদ্ভুত – ম্যক্সিমাম গভর্নেন্স, মিনিমাম গভর্নমেন্ট নামক ফ্যাসিস্ট অর্থনীতিবাদের কথা মনে হতে পারে। এই দুটি ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য হল, পলাশীপূর্ব সরকার কর্পোরেট/শ্রেষ্ঠী আর সাধারণ উতপাদক/ব্যবসায়ীর শ্রেণীবিন্যাসগত পার্থক্য করলেও, তাদের ব্যবসা প্রক্রিয়ায় সাধারণত পক্ষ নিত না। আজ যেমন ফ্যাসিস্টরা প্রত্যক্ষভাবে কর্পোরেট অনুগামী, পুঁজির নির্দেশ মেনে অকর্পোরেটিয় সমস্ত উৎপাদন ব্যবসার কর্পোরেটিকরণ চায়, ‘পলাশীর পূর্ব বাংলার বাণিজ্যে’ বইতে দেখয়েছি কীভাবে ছোট ব্যবসায়ীদের সনদী কোম্পানির আক্রমন থেকে দরবার এবং দরবারি অভিজাতরা নিরাপত্তা প্রদান করছে।
৯। কারিগরেরা ছিল তুলনামূলকভাবে স্বাধীন। যতক্ষণনা কারিগর চাষী পণ্য হাত বদল করছে, পণ্য কারিগরের নিয়ন্ত্রণে থাকত। সুশীল চৌধুরী, ওম প্রকাশ পলাশীপূর্ব সময়ের দুই ইওরোপিয় একচেটিয়া সনদী কোম্পানির বাণিজ্য ইতিহাস আলোচনায় বলছেন মধ্যস্থর মাধ্যমে কোম্পানির সঙ্গে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের চুক্তি থেকে কারিগরেরা পণ্য সরবরাহ না করে বেরিয়ে আসতে পারতেন। বহু তাঁতি সুতোর দাম বেড়ে যাওয়ার যুক্তিতে চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসছেন। কারিগরকে বাধ্য করা যায় নি সম্পাদিত চুক্তির বাহানায় পণ্য হাত বদল করতে।
১০। জাতিরাষ্ট্রীয় নাগরিকেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্পোরেট প্রণোদনায় তৈরি নবজাগরণের নানান লুঠেরা উপসর্গ আজও দেহে, মনে বয়ে বেড়াচ্ছি। উপনিবেশিক লুঠের নাটবল্টুরা চট্টগ্রামে যে ভাষা চান, সেই ভাষা পুরুলিয়াতেও চান, তাতে লুঠ চালানোর, বৃহত্তর জনসমষ্টির ওপর ঔপনিবেশিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ হয়। উপনিবেশিক কাঠামোর বাইরে যা কিছু গ্রামীন তাকে লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক হিসেবে কৃষ্টি দাগিয়ে দিয়ে বিকেন্দ্রিত কৃষ্টিকে মেরে ফেলার উদ্যম নেওয়া হয়।
১১। শশাঙ্ক, গোপাল, সুলতানি, মুঘল, নবাবি আমলের শাসকেরা ছিলেন মূলত গোষ্ঠীপতি। যৌথ পরিবারের প্রধান হিসেবে তাদের কাজ ছিল সেই সমবায়িক বৈচিত্রপূর্ণ অঞ্চলকে সুরক্ষা দেওয়া, ব্যবসা বিকাশে সহায়তা করা, যেটা তারা করে এসেছেন ১৭৫৭ অবদি। রাষ্ট্রীয় কৃষ্টি, ধর্ম, ভাষা বলে কিছুই ছিল না। তাই প্রগতির বাহানায় কৃষ্টি, ভাষা, আইন ইত্যাদি বৃহত্তর সমাজে চাপিয়ে দিতে চান নি।
১২। সার সত্যটা বুঝতেন এই ভৌগোলিক এলাকার জনগণও খুব ভালভাবে। যে জন্যে তারা পলাশীর ৫ বছর পর লুঠের রাজত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাস্তায় নেমে আসেন, যে জন্যে শাঁখের করাত থেকে মসলিন উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ হয় পলাশীর আগে। কারিগরি উতপাদন ব্যবস্থার চূড়ান্ত দেখি পলাশীর আগে, এতই চূড়ান্ত ব্যবস্থায় পৌঁছে যায় যে এই ভৌগোলিক এলাকায় স্থানীয় এবং বিদেশিয়দের দামি ধাতু দিয়েই ব্যবসা করতে হয়েছে। বাংলাকে সোনার বাংলা বানিয়েছে এই বিকেন্দ্রিত ব্যবস্থা।
১৩। সিরাজউদৌলা, মুর্শিদকুলি খান, আলিবর্দি খান বাঙালি ছিলেন কী ছিলেন না এই তথ্যটা কারিগর ব্যবস্থার কাছে বিন্দুমাত্রও জরুরি নয় – আগেই বলেছি ব্রিটিশপূর্ব সময়ে সমসত্ত্ব বাঙ্গালিত্বের, বাঙলা ভাষার ধারণা তরল ছিল। তারা ভৌগোলিক বাংলা প্রদেশের সুরক্ষা আর জনগণের সমৃদ্ধির জন্যে জীবন দিয়েছিলেন। মুর্শিদকুলি খান, আলিবর্দি খান না থাকলে বাংলার বিকশিত কাঠামোগুলো যতটুকু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর স্বাধীন এবং মাথা উঁচু করে টিকে ছিল, সেটা হয় ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদ বা কচুকাটা করা মারাঠা লুঠেরাদের হাতে পড়ত। সিরাজ লড়েছিলেন বাংলার স্বার্থে ব্রিটিশ কর্পোরেট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তিনি যে ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছিলেন, তাতে কারিগরেরা উতপাদনের মূল্যের ৩৩% অর্জন করত শ্রমের মূল্য হিসেবে। সেটা ১৭৭০এ ৬% দাঁড়াল। শাসক হিসেবে সিরাজ অবদি রাষ্ট্র প্রধানেরা যে ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন সেখানে ব্যাঙ্কার, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্র কারোরই একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হত না, বরং সাধারণ মানুষ হকার কারিগর চাষীদের হাতে অর্থ আসত। এই তুচ্ছ কোটি উৎপাদক কোটি বিক্রেতা প্রাকৃতিক উপাদানের মালিক ছিল, সে মালিকানা রাষ্ট্র বা কর্পোরেটের ছিল না। মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজ বারবার ইংরেজদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। আকবর, সিরাজ বাঙালি ছিল কীনা বড় কথা নয়, তাঁরা বাংলার বাঙ্গালির স্বার্থ দেখেছেন, যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধারণ করেছিলেন সেটি কারিগর-হকার-চাষীদের উতপাদন ব্যবস্থা ধরে রাখার পক্ষে ছিল। আকবর বা আওরঙ্গজেব প্যন মুঘলিকা বাংলার ওপর চাপান নি – বরং বলেছিলেন, তিনি বাঙালির প্রথার ওপর হস্তক্ষেপ করবেন না, এবং তাঁর মুসলমান নামধারী প্রজা সেই প্রথা বিরোধী কাজকরায় মুসলমান নামধারী শাসক আকবরের প্রশাসনের থাকবন্দীর নিচুতলার আমলা, শিকদার সেই মুসলমান নামধারী প্রজাকে শাস্তি দেন। তারা শোষক ছিলেন, লুঠেরা দখলদার ছিলেন না – কারিগর অর্থনীতিকে ধ্বংস করার উদ্যমে সামিল ছিলেন না। শশাঙ্ক থেকে সিরাজ এই বিকেন্দ্রিভূত ব্যবস্থাকে ধারণ করে এছেন। তাঁরা আজ নমস্য এই কারণেই।
বিশ্বেন্দু নন্দ, লেখক, ইতিহাস গবেষক, সংগঠক।