মাসকাওয়াথ আহসানঃ নেদারল্যান্ডসে অপরাধীর সংখ্যা শূণ্যের কোঠায় চলে যাওয়ায়; সেখানে কারাগারগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এশিয়ার বৃহত্তম কারাগার নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশে; অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে।
নেদারল্যান্ডসের এই মানবিক সাফল্যের কারণ; সেখানে অপরাধকে ঘৃণা করা হয়; কিন্তু অপরাধীকে ঘৃণা করা হয়না। আর কারাগারকে দেখা হয় সংশোধন কেন্দ্র হিসেবে। সেখানে রাষ্ট্র ও সমাজ মানুষকে নীচ-নিকৃষ্ট বলে মনে করেনা; বরং মানুষকে দেখে অসীম সম্ভাবনাময় হিসেবে; কারণ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মন্দ থেকে ভালো হবার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। আর রাষ্ট্রে একটি সতত মুক্তভাবনার পরিবেশ থাকলে তা রাষ্ট্রটিকে কখনোই কারাগার রাষ্ট্রে পরিণত করেনা; বরং কারাগারগুলোকে সংশোধন কেন্দ্রে পরিণত করে একসময় অপরাধী শূণ্য করে ফেলতে পারে পুরো সমাজকেই।
অথচ নেদারল্যান্ডসের মানুষই অতীতে জলদস্যু ছিলো; অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে তাদের দুর্নামও ছিলো। ঠিক সেরকম একটি দুর্নাম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর বর্তমানে রয়েছে। কাজেই নেদারল্যান্ডস যেভাবে তার সমাজকে অপরাধশূণ্য করে ফেলতে পেরেছে; তা অনুসরণ করা খুবই জরুরী।
বাংলাদেশের কারাগারগুলোর নাম বদলে সংশোধন কেন্দ্র করা প্রয়োজন। নতুন প্রজন্মের পুলিশ সদস্যরা এই সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে সেখানকার বাসিন্দাদের মন্দ মানুষ থেকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে পারেন। মানুষের জীবন বদলে দেয়ার চেয়ে বড় আনন্দের বিষয় আর কিছুই হতে পারে না।
কারাগারে আটক অপরাধীর সঙ্গে পাশবিক আচরণের যে আদিম রেওয়াজ চালু আছে; সেসবে যে সমাধান নেই তা এরি মাঝে সমাজ ও রাষ্ট্রের বোঝার কথা। এতো বছর ধরে কারাগারে এতো অসংখ্য অপরাধীর সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে সংশোধনের কোন দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়নি; বরং সমাজ হারিয়ে গেছে অপরাধের গোলক ধাঁধায়; ক্রমে ক্রমে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রই যেন কারাগার হয়ে পড়েছে।
অপরাধ ও অপরাধী সম্পর্কে মান্ধাতার আমলের ধারণা পোষণ করে মানুষকে সংশোধনের কোন উদ্যোগ রাষ্ট্র কিংবা সমাজ কেউই নেয়নি। মিডিয়ায় কারো বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ উত্থাপিত হওয়া মাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল শকুন নেমে আসে অভিযুক্ত ব্যক্তির শব-ব্যবচ্ছেদ করতে। এসময় পুরো সমাজ সাধু-সন্তের মত আচরণ করে। অথচ এসব উন্মত্ত মবের প্রত্যেকের মধ্যেই অপরাধী হয়ে ওঠার মতো সব লক্ষণই উপস্থিত রয়েছে।
অপরাধকে ঘৃণা করো অপরাধীকে নয়; এই উপদেশ বাণীর আলোয় নেদারল্যান্ডস কাজ করেছে; অথচ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার পশ্চাদপদ সমাজে অপরাধীর মাংসভোজনের মাঝ দিয়ে বিনোদনহীন সমাজে ছদ্ম উত্তেজনা; কিছু খিস্তি, কিছু রগড়; কলতলা মাতানো অট্টহাসির কলরোল উঠেছে; অথচ অপরাধ নিয়ে আলোচনার ফুসরত একেবারেই মেলেনি। ফলে অপরাধ বোধ সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে।
কলকাতার “মুক্তধারা” নামের একটি চলচ্চিত্রে একটি কারাগারকে সংশোধন কেন্দ্র করে তোলার; মন্দ মানুষকে ভালো মানুষে প্রত্যাবর্তনের একটি স্বপ্ন জারিত করা হয়েছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা আইজি প্রিজন হিসেবে দায়িত্ব পাবার পর কুখ্যাত অপরাধীরা বসবাস করে এমন একটি কারাগারের অন্ধকার সরিয়ে সেখানে সংশোধনের আলো নিয়ে আসেন। তাকে গতানুগতিক চিন্তার পুলিশেরা গান্ধীজী বলে হাসাহাসি করে; তার কাজে নানাভাবে বাধা দেয়।
কিন্তু ঐ আইজি প্রিজন আশা ছাড়েন না কিছুতেই। তিনি মনে করেন মানুষের মাঝে মুক্তধারার আলোকায়ন তার অপরাধ প্রবণতা সরিয়ে সু-প্রবৃত্তিকে ফিরিয়ে আনতে পারে। তিনি সংশোধন কেন্দ্রের কুখ্যাত অপরাধীদের পড়াশোনার, ছবি আঁকার, ভাস্কর্য তৈরীর সুযোগ করে দেন। তাদের নিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনাট্য “বাল্মীকি প্রতিভা” মঞ্চায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। দস্যু থেকে মুনি হয়ে ওঠার প্রতীকী চরিত্র বাল্মীকি। বাল্মীকির চরিত্রে যে অভিনয় করে সেই কুখ্যাত অপরাধী এই নাটকের মহড়ার ফাঁকে ফাঁকে কারাগার থেকে পালিয়ে যাবার সুড়ঙ্গ তৈরি করতে থাকে। গীতিনাট্যটি মঞ্চায়নের মাঝেই অপরাধীটি তার কয়েকজন সঙ্গীসহ পালিয়ে যায় ঐ সুড়ঙ্গ পথে।
কিন্তু মুক্ত হবার পরই এই বাল্মীকি গীতিনাট্যের মহড়ার সময় একটু একটু বদলে যাওয়া অপরাধী মন অনুতপ্ত হয়। আইজি প্রিজন কয়েকজন অপরাধীর পালিয়ে যাবার খবর পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবছিলেন তার এই অন্ধকারে আলো আনার স্বপ্নটা বুঝি ভুল প্রমাণিত হলো।
অথচ আবার সংশোধন কেন্দ্রে ফিরে এসে যথাসময়ে বাল্মীকির চরিত্রে অভিনয়ের শেষ দৃশ্যে অংশ নেয় সেই একদা কুখ্যাত অপরাধী; আইজি প্রিজন বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয়ের মাঝ দিয়ে আরেকজন মন্দ মানুষের মাঝে আরেক বাল্মীকির উদ্ভাস যেন দেখতে পান।
ডেস্ক রিপোর্ট : সাম্প্রতিক ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে কোথায় আছেন তা সরকার নিশ্চিত...