মাসকাওয়াথ আহসান
চট্টগ্রামের একে খান মোড়ে ট্রাক থেকে পড়ে যাওয়া গম পলিথিনে ভরছিলো এক অনাম্নী নারী। আলোকচিত্রী আকমল হাসান এই দৃশ্যটি ক্যামেরায় তুললে দেশ রূপান্তর পত্রিকায় ছবিটি ছাপা হয়।
দুদিন আগে কর্ণফুলী নদীতে টানেল খুলে দেয়া হয়েছে; কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন চালু হয়েছে; সুষ্ঠু নির্বাচনে ভোট দিতে রাশিয়ার জাহাজ এসে নোঙ্গর করেছে। এইরকম মাহেন্দ্রক্ষণে এই ছবিটি মেনে নিতে কষ্ট হয় সহমত ভাই ও শিবব্রত দাদার।
সহমত ভাই রেগে টং হয়ে বলে, কিছু মানুষের অভ্যাসই হচ্ছে ভিক্ষা করা; দরকার না থাকলেও তারা ভিক্ষা করে। গোলাভরা গম, পুকুর ভরা ইলিশ, গোয়াল ভরা গরু-ছাগল, দরকার কী ট্রাক থেকে পড়া গম কুড়িয়ে সিনক্রিয়েট করার!
শিবব্রত দাদা গালে সুপোরি পুরে বলে, আজকাল বাসা বাড়িতে কাজের লোক পাওয়া যায় না। সবারই অবস্থা ভালো করে দিয়েছে উন্নয়নের সুবাতাস। এই মহিলা অযথা এরকম একটা আলোচনার জন্ম দিলো।
বানিজ্য বিশেষজ্ঞ টুপি মরিচ বলে, মহিলার বোরখার কারণে ঠোঁট দেখা যাচ্ছে না; আমি নিশ্চিত সে লিপস্টিক দিয়েছে; আর সে এখন যে স্যান্ডেলটা পরে আছে; সেটা বদলে নতুন এক জোড়া পরবে।
একজন প্রবীণ অভিনেত্রী টিভি বাইটে বলে, এই ব্লাউজ, লিপস্টিক, স্যান্ডেল তোমাদেরকে কে দিয়েছে!
এক শিশু শিল্পী বলে, আমি তো প্রথমে গম কুড়ানোর ছবি দেখে কেন্দে দিয়েছিলাম; পরে বুঝলাম; সে রাস্তা পরিষ্কার করছে; যাতে এটা প্যারিসের রাস্তার মতো দেখায়।
গান গাইতে গাইতে গীতি আপা বলে, এই মহিলা সৌদি সংস্কৃতির প্রচারক; বোরখা আর হিজাবে ছেয়ে গেলো দেশটা; আমরা কী এই দেশ চেয়েছিলাম!
কন্সপিরেসি থিওরিস্ট জাফর ভাই বলে, এই ছবিটা আসলে বাসন্তী টু পয়েন্ট ও। ১৯৭৪ সালে যখন গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা কৈ, গোয়াল ভরা ষাঁড়; তখন যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র করে বাসন্তীকে জাল পরিয়ে দারিদ্র্যের ছবি তুলেছিলো কুচক্রীরা! এই ছবিতে বাসন্তীর অবশ্য অনেক কাপড় চোপড় আছে; অযথা সে গম কুড়িয়ে উন্নয়নের সঙ্গে শত্রুতা করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, মহিলার ভাইয়ের শ্যালিকার জামাইয়ের ভাগ্নে জামায়াত করে।
সাড়ে চুয়াত্তর টিভির প্লাটিনাম আপা তার টিম বাজনদার নিয়ে পৌঁছে যায় চট্টগ্রামে। বোরখা পরে থাকার কারণে চেহারা দেখা না যাওয়ায়, গম কুড়ানিকে খুঁজে বের করতে অসুবিধা হয়। কোন বোরখা পরা মহিলাকে দেখলেই বাজনদার খুক খুক করে কেশে জিজ্ঞেস করে, এই যে আপা আপনি কী গম কুড়াতে গিয়েছিলেন! এই প্রশ্ন শুনে এক মহিলা রেগে চড় কষে দেয়।
চড় খেয়েই ফেসবুক লাইভ করে বাজনদার, আপনারা গম কুড়াতে দেখে যে মহিলাকে নিয়ে কেন্দে জারে জার হলেন, তার গায়ে যে শক্তি; যত জোরে সে চড় দিতে পারে; আমার তো ধারণা সে প্রতিদিন ডিম-দুধ-মাংস এসব পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে।
প্লাটিনাম আপা কঁকিয়ে কঁকিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে। এক বোরখা পরা মহিলাকে জিজ্ঞেস করে, ঐ যে মহিলা চড় দিয়ে গেলো; সে কী খেতে পায়না?
–খাইতে পাইবো না ক্যান, একটা কাঁঠাল, একটা খাসি সে একাই খাইয়া সাবাড় কইরা দেয়।
–আচ্ছা ঐ মহিলার দুলাভাইয়ের ভাগ্নির চাচাশ্বশুরের মামাতো ভাই কী বিএনপি করে!
–আমরা কেউ বিএনপি-আওয়ামী লীগের গুষ্টি কিলাই না!
কাট কাট বলে প্লাটিনাম আপা ঝুম ঝুম বাজনদারকে নিয়ে চট্টগ্রামের খাবার হোটেলের ভিড় দেখিয়ে বলে, দেখছেন তো উন্নয়নের জাদুতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতো ভালো হয়েছে যে তারা হোটেলে খায়। তাইতো হোটেলে তিল ধারনের জায়গা নেই।
টিভিতে এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখে কীটি পার্টিতে জুলেখা, সিলভিয়া, নেইলি, খাদিজা সমস্বরে বলে ওঠে, আমরা আগেই বলেছিলাম, গম কুড়ানোর মতো অভাব কারো নাই; সেই কোন কালে আমাদের নানী-দাদী গম কুড়াতো; আর আমরা তো এখন কলকাতা-ব্যাংককে গিয়ে পার্ল কুড়াই। আমাদের স্বামী জিডিপি কুড়ায়।
কীটি পার্টি থেকে ফেরার পথে সিলভিয়ার পোর্শে গাড়ি ট্রাফিক লাইটে দাঁড়ালে সে চেয়ে দেখে, ভিক্ষুকেরা রিক্সা, স্কুটার, ট্যাক্সি, ছোট গাড়ির আরোহীদের কাছে ভিক্ষা চাইছে! কিন্তু তার কাছে কেউ ভিক্ষা চাইছে না।
সিলভিয়া এক ভিক্ষুককে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার আমার কাছে ভিক্ষা চাইলেন না কেন!
ভিক্ষুক হেসে বলে, আমরা দূর থিকা দেইখা ভাবি চাইনিজগো চেহারা একই রকম। কিন্তু চাইনিজরা শুনছি নিজেগো চেহারার ডিফারেন্স ঠিকই বুঝে!
–চাইনিজদের সঙ্গে আমার কাছে ভিক্ষা না চাওয়ার সম্পর্ক কী!
–আপনারে দেখলে আমরা ঠিকই চিনতে পারি; এই কয়বছর হইলো আপনার টেকাটুকা হইছে; তার আগে আপনি ভিক্ষুক ছিলেন। যারা ভিক্ষুক থিকা নতুন গাড়িওয়ালা হয়; তারা ভিক্ষুকরে সন্দেহ করে বেশি; ধমক ধামক বেশি দেয়; তাই আপনারে আর বিরক্ত করি নাই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।