মাসকাওয়াথ আহসানঃ
জবা-কুসুম-রোকন-দুলাল দৌড়ে আসে গোলাপের কাছে, ও গোলাপ ভাই, ঢাকায় এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে; কিন্তু রাক্ষসের গালে দাড়ি আর মাথায় টুপির মোটিফ থাকবে না মনে হচ্ছে।
গোলাপ হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু একটা করা দরকার। জুয়েল অধিকারী সোফায় একটা হাফ প্যান্ট পরে বসে ঈষব গুলের ভুষি আর চিরতার পানি পান করছিলো। কলকাতার ভাজা পোড়া আর সুতলি কাবাব খেয়ে স্টমাক বেশ গোলমাল করছে। সে আশ্বাস দেয়, কলকাতায় তো বৈশাখি মিছিল হয়। সেজে গুজে দেখতে যেও। আপাতত ঢাকাকে ছাড়ো তো।
জবা-কুসুম-রোকন-দুলাল কোরাসে বলে, হাজার বছরের বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির ঐ একটি দিন; একটু শাড়ি-টাড়ি পরে, নক্সী পাঞ্জাবি জড়িয়ে পান্তা-ইলিশ খাবো; সেটাও কি হবে না।
জুয়েল অধিকারী বিরক্ত হয়ে বলে, দাঁড়াও দেখি শৈলেশদাকে ফোন করি, উনি তো একটু সংস্কৃতি টংস্কৃতি করেন।
–হ্যালো শৈলেশদা, আছেন কেমন; আপনাদের এখানে পয়লা বৈশাখ কি ঢাকার মতো জমে!
–জমে মানে জমে ক্ষীর; দুপাত্তর মেরে রকে বসে তিন পাত্তি খেলি ওদিন।
–আপনাদের এখানে মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়না!
–কি বলেন! মুঘল শোভাযাত্রা করলে তো পার্টির লোকেরা খাপ্পা হবে। জানেন না এখন ছাব্বার যুগ চলছে।
–মুঘল না মুঘল না মঙ্গল।
–আরে মশয়; মঙ্গল ডাকতে ডাকতেই ওটা মুঘল হয়েছে; ইতিহাস তো কিছুই জানেন না দেখি!
–আমাদের ইতিহাসের সিলেবাস তো ১৯৫২ সাল শুরু হয়ে ১৯৭১ সালে শেষ হয়েছে। টেনে বড় জোর ১৯৭৫-এ আনা যায়; কিন্তু ৫২-র ওপাশে আর ৭৫-এর এপাশে আসা বুবুর বারণ আছে।
–বাপরে বাপ; ইতিহাসের সিলেবাস; পারেনও দাদা আপনারা আওয়ামী লীগের লোকেরা।
–শৈলেশদা, কলকাতায় একটা মঙ্গলশোভাযাত্রা কি করা যায়! খরচাপাতি যা লাগে; আমরা দেবো।
–তা হয়ে যাবে ক্ষণ। তবে বিজেপির এলাকায় মুঘল শোভাযাত্রা করা যাবে না। যা করার তৃণমূলের এলাকায় করতে হবে।
–ইউনুসের একটা কুশপুত্তলিকা চাই। একটু দাড়ি লাগিয়ে মাথায় টুপি দিয়ে দেবেন।
–উনি তো ক্লিন শেভড লোক; মাথায় টুপিও পরেন না; লোকে কি চিনতে পারবে!
–আজতক, রিপাবলিক বাংলায় একটু কাভারেজের ব্যবস্থা করলে বাংলাদেশের লোক ঠিকই চিনতে পারবে।
–সে হয়ে যাবে ক্ষণ। এখন তবে রাখি দাদা; হাতে অনেক কাজ।
গোলাপ বলে, পয়লা বৈশাখের ইতিহাস বর্ণনার জন্য একটা বুদ্ধিজীবী প্রয়োজন। ঢাকা থেকে যুবলীগের চেয়ারম্যান হতে চাওয়া সেই বুদ্ধিজীবী বোধহয় কলকাতা এসেছে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে।
আলাউদ্দিনের ইফতার পার্টিতে কঁকাতে কঁকাতে ওকা আসে, নওফেল আসে; দাড়ি বড় হয়ে জাওয়াহিরির মতো চেহারা হয়েছে; আসাদুজ্জামান কামাল আসে লাঠিতে ভর দিয়ে। হারুনের ভাতের হোটেল কলকাতা শাখা পেয়েছে ইফতারি তৈরির দায়িত্ব। সে জিলাপি ভেজে তুলছে। বিপ্লব ভাজছে পেয়াজু। শসা কাটছে মনিরুল। মাথায় একটা পাগড়ি পরে শামীম ওসমান আসে খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
অতিরঞ্জনবাজার পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি না হওয়ায় অপু উকিলের মুখমণ্ডল বিষণ্ণতায় ঝুলে গেছে।
জুয়েল অধিকারী মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের কথাটা সবাইকে জানায়। ওকা কঁকাতে কঁকাতে বলে, আমি কি পারবো শোভাযাত্রায় হাঁটতে!
আসাদুজ্জামান কামাল বলে, আপনার জন্য গান্ধীজীর মতো দুজন হন্টনসঙ্গী যোগাড় করা যাবে; চিন্তা নেই।
যুবলীগের প্রধান হতে চাওয়া বুদ্ধিজীবীকে পেয়ে গোলাপ তাকে বৈশাখি প্রবন্ধ পাঠের আমন্ত্রণ জানায়। বুদ্ধিজীবী চশমার ফাঁক দিয়ে গোল গোল করে হেসে বলে, বৈশাখের প্রথম দিনটিকে কৃষি ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর। তিনি এটা করেছিলেন, যাতে কৃষকেরা হিসাব রাখতে পারে জমা-খরচের। যাতে বেহিসাবি খরচ করে ফসলহীন মাসে অনাহারে না মরে। সেই থেকে এই বৈশাখি উতসবের শুরু।
সুভাষ সিংহ টেবিলে থাবা দিয়ে বলে, এই ইতিহাস ভ্রান্ত। বৈশাখি উতসব চালু করেছিলেন রাজা শশাংক। একে শশাংকাব্দ বলে। টেবিলের ওপর রাখা চারটে ইটের মতো বই খুলে রেফারেন্স খুঁজতে থাকে সিংহ।
শামীম ওসমান বলে , ঠিক আছে ঠিক আছে যুবলীগের অধ্যাপক ও টিভি লীগের পকপক দুজনেই প্রবন্ধ পাঠ করবেন।
কলকাতার পয়লা বৈশাখ একদিন পরে হলেও ঢাকার সঙ্গে মিলিয়ে ১৪ এপ্রিলে কলকাতার নন্দনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করে শৈলেশদা। মুঘল শোভাযাত্রা হচ্ছে শুনে আকবরের ছবি এঁকে প্ল্যাকার্ড বানিয়ে চলে আসে জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। কেউ কেউ আকবর ও যোধা সেজে বাদ্যের তালে নাচছে।
জবা-কুসুম-রোকন দুলাল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো সেজে এসে দেখে খোদ কলকাতার মেয়েরা রঙ্গিন ফতুয়া ও জিনস পরে চলে এসেছে। শুধু যোধা সেজেছে অলংকারে। ইউনুসের পুত্তলিকার মাথায় মুঘল মুকুট পরিয়ে সেলিব্রেট করছে তরুণ-তরুণীরা।
জুয়েল অধিকারী শৈলেশদাকে জিজ্ঞেস করে, ও দাদা এমন মুঘল আবহ কেন!
–ওমা মুঘল শোভাযাত্রা করতে বলেছেন; সেই অনুযায়ী ছেলেমেয়েরা সেজে এসেছে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।