এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লকডাউন, করোনার ভয়, করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা ব্যয়ের ভয়, চাকুরীতে বেতন কমে যাওয়া, পরিবার বা পাড়াপ্রতিবেশী আক্রান্ত হলে শঙ্কা বেড়ে যাওয়া, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক- সেনিটাইজার ব্যবহার, লকডাউনে নিজেকে গৃহবন্দি করে রাখা সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মনে এক ধরনের নেতিবাচক চাপ তৈরী হচ্ছে বা হয়েছে। কোভিড-১৯ এমন একটি ভাইরাসজনিত রোগ এবং ব্যাপ্তি এতটাই বেশি যে শারীরিক স্বাস্থ্যের বিপন্নতাকে অতিক্রম করে মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। একেকটা দিন পার হচ্ছে আর এই ধরণের মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। দুশ্চিন্তা ভয়ঙ্করভাবে বাড়ছে। নানা উদ্বেগ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। ফলে একটি অসুস্থ জাতিতে পরিণত হওয়ায় দিকেই আমরা ধাবিত হচ্ছি।
মানসিক চাপ, দুশ্চিতা বা উৎকণ্ঠা কি এবং কেন হয়?
বিজ্ঞান বলে মানুষের মস্তিষ্ক কখনোও চিন্তা করা থেকে বিরত থাকেনা। হয় সে ঘুমিয়ে থাক কিংবা জেগে। তবে সাধারণ চিন্তা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে একটু ফারাক বর্তমান। আমরা যখন বলি কেউ দুশ্চিন্তা করছে তবে এটা বোঝায় যে সেই মানুষটি সাধারণ চিন্তা-ভাবনার চেয়ে বেশি চিন্তা করছে। আমরা কম বেশি সবাই কোনো না কোনো চিন্তায় সবসময় থাকি। যেগুলো একজন স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু একজন সারাক্ষণ কোনো বিষয়ে চিন্তা করলে সেটা রীতিমতো ভীতিকর হয়ে ওঠে। এবং যা থেকে আর মুক্তি পাওয়া যায় না তখন সেটা মানসিক উৎকণ্ঠা বা দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়ায়।
মানসিক দুশ্চিন্তা এমন একটি বিষয় যার মাধ্যমে একজন মানুষের পুরো জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। নিত্যদিনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটে। এর জন্য একজন সারাক্ষণ চিন্তায় ডুবে থাকেন। ক্লান্তিতে ভোগেন এবং কোনো কাজে মন দিতে পারেন না। তাই এর ফলস্বরুপ ঘুম হয় না। ব্যক্তি বিষন্ন বোধ করতে থাকেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে বিশ্বের সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময় দুশ্চিন্তায় ভোগেন। এর হার প্রতি দশ জনে একজন। দুশ্চিতায় ভুগলে কিছু লক্ষণ চোখে পড়ে যেমন: শরীর শুকিয়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক মাত্রায় হওয়া, ঘন ঘন নিশ্বাস নেওয়া, শরীর কাঁপা, ঘাম হওয়া, মাথা ঘামা, ডায়রিয়া বা অসুস্থ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। মানসিক দুশ্চিন্তার রকমফেরও আছে। ব্যক্তিভেদে এর তারতম্যও ঘটে। কারও ক্ষেত্রে মৃদ্যু আবার কারো ক্ষেত্রে তীব্র হয়ে উঠতে পারে।
করোনা মহামারীতে মানুষের জীবনের গতিময় অবস্থার পরিবর্তন হয়ে শ্লথ অবস্থা ধারণ করেছে। সাথে ঘটেছে জীবনের নানা রকম নাটকীয় পরিবর্তন। যার ফলে অভাব ও নানা রকম সংকটে আমাদের মানসিক দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে অভিভাবকরা বেশি মাত্রায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাদের সন্তানকে ঘিরে।
মানসিক চাপের শুরু যেভাবে
স্বাস্থ্য, অর্থাভাব থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে বা স্কুলে কোনো পরিবর্তন যে কোনো কারণেই মানসিক চাট সৃষ্টি হতে পারে। আবার কারও সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনও মানিসক চাপের মুখ্য একটি বিষয়। আর এই করোনমহামারীতে প্রাথমিকভাবে মানসিক চাপ আসার কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভাইরাস নিয়ে ভয়, নিজে বা অন্যকে সংক্রমিত করার ভয় অথবা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার শঙ্কা। আর দ্বিতীয়ত, করোনামহামারী কবে নাগাদ স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে আর স্বাভাবিকভাবে সবকিছু চলতে পারবে। একই সাথে প্রত্যেকেই নিজের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত এই মহামারীর জন্য। তাই ভবিষ্যতে কি হবে এই নিয়ে অধিকাংশের মানসিক চাপ বেড়ে গেছে। এসব মানসিক চাপকে করোনা-অ্যাংজাইটি নাম দিয়েছে দাবত্য সংস্থা অ্যাংজাইটি ইউকে।
শিশু বা তরুণদের মানসিক চাপ
শিশু বা তরুণরাও মানসিক চাপে ভুগতে পারেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্টাল ক্লিনিক্যাল সাইকোলোজি বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথি ক্রেসওয়াল বলেন, ‘স্কুলের চাপ এখন যেহেতু নেই, তাই তাদের অনেকেই এখন তাদের জীবন নিয়ে হতাশাচ্ছন্ন হচ্ছে। আবার অনেকেই ভালোও আছে।’ তাঁর পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, নিরানন্দ, ও মন খারাপের বিষয়গুলো মুখ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে তুলনায় মাধ্যমিক স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তেমন কোনো মন খারাপের দিকগুলো ফুটে উঠছে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে গত অক্টোবরে ১৩-১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে যতটা মানসিক চাপ কাজ করছিল লকডাউনের মধ্যে সে রকম কোনো চাপ তাদের মাঝে অনুভূত হয়নি। সুতরাং বয়সভেদে মানসিক তারতম্যের ব্যাপারটি দেখা যায়।
স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য
দ্য জার্নাল অফ সাইক্রিয়াটিক রিসার্চের একটি গবেষণায় করোনায় চিকিৎসা সেবায় যারা নিয়োজিত তাদের নমুনায়নের মাধ্যমে একটি ফলাফল প্রকাশ করা হয় যার মূল উদ্দেশ্য ছিল করোনায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক অবস্থার সার্বিক অবলোকন। এ গবেষণায় দেখা যায়, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে যারা করোনা রোগীর সাথে সামনের সারিতে এই রোগ মোকাবেলায় কাজ করেছেন তাদের মানসিক ক্ষতির দিকটি প্রকট। তারা সামনের দিনগুলোতে অধিকতর মাত্রায় মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া বা অ্যাংজাইটি, অবসাদ ইত্যাদির স্বীকার হওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি রয়েছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, অবসাদ, হতাশা, ইনসোমনিয়া, ট্রমাটিক স্ট্রেসের মতো প্রতিকূলতা হওয়ার আশঙ্ক রয়েছে। শতকরা ৫৬ ভাগ স্বাস্থ্যকর্মীর মাঝে এই ধরণের মানসিক সম্যস্যা পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে কেই হয়তো অনিদ্রায় ভূগছেন এছাড়া অবসাদ বা উদ্বেগের মতো সমস্যাতো আছেই।
করোনায় প্রাপ্ত বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে গবেষণা যা বলছে
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির হিসাবে এক কোটিরও বেশি মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় ঢুকেছে যারা গত এক দশকে নিম্ন আয়ের শ্রেণি থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। করোনার কারণে অনেকেই চাররি হারিয়েছেন। অনেকের আয় কমে এসেছে। অনেকে নিজের ব্যবসা হরিয়ে হতাশায় ভুগছেন। এ কারণে বিষণ্নতা ও মানসিক চাপ তৈরী হচ্ছে। আবার অন্যদিকে রোগী বাড়লেও চিকিৎসার বাইরে থাকছেন অনেকে। করোনায় মানসিক স্বাস্থ্যে তৈরী হয়েছে ভয়াবহ বিপর্যয়। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপে বলছে, দেশের অর্ধেক মানুষ এখন বিষন্ন।
ড. রিচার্ড হর্টন পরিচালিত ল্যানসেটের একটি গবেষণা করোনাকে প্যানডেমিক না বলে সিনডেমিক বলছে। কেননা দুই ধরণের রোগ সমস্যা যদি মহামারি হিসেবে আবির্ভুত হয়ে একসাথে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যে অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তাকে সিনডেমিক বলা হয়। আবার বলা হচ্ছে মহামারির কারণে আর্থ-সামাজিক বড় ধরনের পরিবর্তনও সিনডেমিক হতে পারে।
একাধিক গবেষণায় পাওয়া ফলাফল বলছে, করোনা সংক্রমণের আতঙ্ক, চিকিৎসা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা, মৃত্যুর আশঙ্কা, অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা, বেকারত্ব, এমন করোনা নিয়ে ভ্রান্ত নেতিবাচক সামাজিক বৈষম্যের কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট। আর করোনা চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে স্ট্রেস বার্নআউট হচ্ছে যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এমনকি করোনাকালে বিশ্বজুড়ে বেড়ে গেছে পারিবারিক সহিংসতা ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা।
কোভিড মহামারীর সময়ে পরিচালিত কিছু গবেষণায় দেখা যায়, বিষণ্নতার হার করোনাপূর্ব সময়ে ৭ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশ। আর উদ্বিগ্নতা ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৩ শতাংশ। এপ্রিল ২০২১ এ ল্যানসেটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ১৭-১৯ শতাংশের মধ্যে অতি উদ্বেগ, ১৪ শতাংশের মধ্যে মুড ডিসওর্ডার এবং ১.৫-২.৭ শতাংশের মধ্যে মানসিক রোগ দেখা গেছে। করোনা সংক্রমিতদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মানসিক সমস্যা দেখা যায়। আবার করোনায় আক্রান্ত নন এমন ব্যক্তি ও চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যে মানসিক চাপ, উব্দিগ্নতা, বিষণ্নতা, আতঙ্কের হার সাধারণ সময়ের তুলনায় অনেকগুন বেশি। আবার করোনা থেকে যারা সেরে উঠেছেন তাদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্টে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, করোনার মনোসামাজিক প্রভাব এতো বেশি যে এটি প্যানডেমিককে অতিক্রম করে সিনডেমিক হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগটির হার ১৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে ৬.৭ শতাংশ বিষণ্নতা এবং ৪.৭ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করে। সাধারণ সময়ের তুলনায় কোভিডকালে মানসিক সমস্যা বাংলাদেশে বেড়েছে এবং এটি সময় অতিক্রম করার সাথে সাথে ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিগত এক বছরে ১৪ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যা বিগত বছরগুলোতে ১০ হাজারের বেশি ছিল না। কোভিড ভিতি নিয়ে কুসংস্কার, স্টিগমা ও কোভিড ভীতিতেও ৫ জনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এ বছরের ১৬ এপ্রিল রাতে মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল ভবন থেকে লাফ দিয়ে আফিসফ ইকবাল নামের একজন আত্মহত্যা করে। সুইসাইড নোটে একাকিত্বের যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, একবছরের ৬-৭ টি এমন আত্মহত্যার কেস তিনি পেয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যুক্তরাজ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের ৩২ শতাংশ জানিয়েছেন, মহামারির কারণে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বিপর্যস্ত হয়েছে। ইতালি ও স্পেনে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েছে। কানাডায় ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২০ শতাংশ বেড়েছে মদ্যপান। মহামারির আগের অবস্থার তুলনায় এপ্রিলে ইথিওপিয়ার মানুষের মধ্যে বিষন্নতা তিনগুণ বেড়েছে।
রোগ সম্পর্কে অজ্ঞাত আতঙ্ক, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধি, বেকারত্ব, ব্যবসায় ক্ষতিসহ নানা সামাজিক সংকটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় করোনাকালে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপে দেশে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। মৃত্যুভয়, আর্থিক সংকট, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে প্রায় সব মানুষই চিন্তিত। বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, করোনা মহামারীর পর বিশ্বে আরেকটি মহামারী দেখা দেবে- সেটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুজনিত, যোগাযোগ ব্যবস্থার রুদ্ধতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্থবিরতা ইত্যাদি কারণে এ সংকট সৃষ্টি হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের এক অনলাইন গবেষণায় দেখা গেছে, এ সময়ে ৭১ শতাংশ মানুষের মধ্যে ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ বেড়েছে। প্রায় ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, করোনা পরিস্থিতির আগের চেয়ে পরে মানসিক সমস্যা চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা আর্ক ফাউন্ডেশর পরিচালিত অপর এক অনলাইন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাকালে অন্য স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি মানুষ বিষণ্ন্নতাজনিত রোগে এবং ১০ গুণ বেশি মানুষ উৎকণ্ঠাজনিত রোগে ভুগছে।
প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে করণীয়
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভীতি থেকে অবসাদে ভোগা, মনের উপর বাড়তি চাপ তৈরী হওয়া, হতাশ হয়ে পড়া বা আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস এর নিদের্শনা অনুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ঘরবন্দি এই সময়টায় দৈনন্দিন রুটিনে পরিবর্তন না করে বরং সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে। ঘুম, গোসল, খাওয়া, ব্যায়াম ও একাডেমিক পড়াশোনা ইত্যাদি সবকিছুই সঠিক সময়ে করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সীমার মধ্যে রাখতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অবসর সময়ে একটু সময় ব্যয় মানসিক চাপ কমায় বটে কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহার শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে।
সারা দিন যদি শিক্ষার্থীরা কেবল করোনা নিয়েই পড়ে থাকে এবং টিভি ও সংবাদমাধ্যমে তারা সংবাদ শুনতে ব্যস্ত থাকে, তবে সত্যিকারের ভাইরাসের আক্রমণের আগেই এক ধরনের তথ্য-ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে, যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই করোনার সংবাদে কোনোভাবেই আতঙ্কিত না হয়ে অন্যান্য কাজে মনোনিবেশ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অলস সময় অনেকটাই কাটে করোনা নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা করে। এ অবস্থায় তারা বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিলে মানসিকভাবে চাঙা থাকবে। তাই এ সময় শিক্ষার্থীদের কবিতা আবৃত্তি, ছবি আঁকা, বই পড়া ইত্যাদি কাজে উৎসাহ দিতে হবে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না থাকলেও অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। অনলাইন ক্লাস এবং ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট নিয়মিত করে পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।
আতঙ্কিত না হয়ে বরং স্বাস্থ্য সচেতনতা অবলম্বন করে মনোবল শক্ত রাখতে হবে। করোনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে মানসিক দিক থেকে সচেতন থাকতে হবে। তা ছাড়া মানসিকভাবে দুর্বল থাকলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই মানসিকভাবে চাঙা থাকার চেষ্টা করতে হবে।
দীর্ঘসময় বাইরের পরিবেশ থেকে আলাদা থাকার কারণে একাকিত্ব বোধ হতে পারে, যা মনের ওপর প্রভাব ফেলে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সময় দিতে হবে। পরিবারের সবার সান্নিধ্য একাকিত্ব দূর হওয়ার অন্যতম উপায়।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্ব অপরিসীম। পরিবারের বাইরে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবরাই আমাদের মানসিক আশ্রয়। সরাসরি দেখা করা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই ফোন, ইমেইল, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা ভিন্ন কোনো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে।
শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানসিক চাপ মুক্ত থাকতে করণীয়
যে কোনো মানসিক চাপে শিশু কিশোররা বড়দের চেয়ে ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। শিশুরা মাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়, উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে, নিজেকে গুটিয়ে রাখে, রাগ করে, অস্থির হয়ে। তাদের জন্য কিছু কিছু করণীয়।
তাদের জীবনের সাথে যুক্ত থাকুন: তাদের ব্যাপারে এবং যেসব বিষয় তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আগ্রহ দেখান।
নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দূরে রাখতে একটি ইতিবাচক রুটিন মানার উৎসাহ দিন: তাদের জন্য ইতিবাচক রোল মডেল হয়ে উঠুন। নিদির্ষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া, স্বাস্থ্য সম্মত খাবার খাওয়া এবং শরীরচর্চা, খেলাধুনায় অংশ নেয়ায় উৎসাহ দিন।
তাদের আগ্রহে উৎসাহ দিন: তারা যাতে সক্রিয় থাকে, সৃষ্টিশীল থাকে এবং নতুন নতুন জিনিস শেখে এবং একটি টিমের সাথে মিলে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে, সেটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওদের কথায় গুরুত্ব দিতে হবে: যা বলে, সেটাকে মূল্য দিন এবং কঠিন আবেগজড়িত বিষয় যাতে তারা মোকাবেলা করতে পারে সে দিকে উৎসাহ প্রদান করা জরুরি।
যতদূর সম্ভব করোনা সংক্রমণের সকল পর্যায়ে শিশু-কিশোরকে তাদের মা-বাবার সাথেই রাখুন। পরিবার বা যত্নপ্রদানকারীদের নিকট থেকে তাদের কোনো ক্রমেই আলাদা করে রাখা যাবে না। তাদের প্রতিনিয়ত আশ্বস্ত করলে মানসিক শক্তি যোগতে সাহায্য করবে।
প্রতিদিনের নিয়মিত কাজগুলোকে যতদূর সম্ভব আগের মতোই বজায় রাখার চেষ্টা করুন। প্রয়োজন হলে নতুন পরিবেশ তৈরী করে তাদের মানসিকভাবে চাপমুক্ত রাখুন।
যা হচ্ছে বা ঘটছে সে বিষয়ে বয়স উপযোগী করে তাকে সঠিক তথ্য দিন। তাদের প্রতিকূল পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিন এবং কিভাবে সে নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পারবে এবং সংক্রমণ থেকে দুরে থাকবে সে সম্পর্কে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিন। তাকে আশ্বাস দিন যে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে স্বাস্থ্যখাতে যে বরাদ্দ থাকে তার মাত্র ২ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্তিশালী না থাকলে সে কখনোই শারীরিক অসুস্থতাকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। তাই প্রত্যেক দেশেরই মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
লেখক: ডা. শামীম তালুকদার, জনস্বাস্থ্য গবেষক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট।