মাসকাওয়াথ আহসানঃ
পশ্চিমের কোন একটি শহরের রাস্তায় ওভার কোট পরে একটি প্রোপিক। একটি তরুণী দাঁড়িয়ে। সে ফেসবুকে সবাইকে বুদ্ধি দিচ্ছে, বিদেশে “বাঙ্গু” মুসলমানদের যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কিংবা চাকরি করে তাদের কতৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়ে তাদের ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট দিতে যেখানে তারা প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলি গণহত্যার মতো বিষয়ের সমালোচনা করছে। সে নিজেও এমন অনেক ইমেইল বা চিঠি পাঠায় বলে গর্ব প্রকাশ করেছে।
সে এমন করে বাঙ্গু শব্দ ব্যবহার করছে যেন নিজে ষোড়শ লুই কিংবা পঞ্চম জর্জের বংশধর। এই তরুণী মাশাল্লাহ হাসিনাতসির দোসর হিসেবে ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটির উপাদান ফেসবুকে স্তরে স্তরে সাজিয়ে রেখেছে। এর ফলে রিপাবলিক বাংলার ময়ূখরঞ্জন আর তার বাঙ্গু মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ একইভাবে প্রকাশিত।
এরকম ছেলে-মেয়ের সঙ্গে কদাচিত দেখা হয়েছে। ইউরোপে একবার এরকম ছেলেমেয়েরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, শ্রমিকদের সঙ্গে এতো সখ্য কেন আপনার! আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম এরকম পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট প্রশ্ন শুনে।
ফেসবুকে এই মেয়েটির বিদ্বেষমূলক পোস্ট দেখে সে কথাই মনে পড়লো। কেউ কোথাও মানুষকে ছোট বা তুচ্ছ করলে আমি তার শব্দ ও বাক্যের আয়নায় ডিএনএ এক্সরে রিপোর্ট দেখতে পাই।
গ্রামাঞ্চলে কেউ সামান্য শিক্ষিত হলে যে মামা তাকে শিক্ষিত হতে সাহায্য করেছে; তার জমি দখল করে তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দেয়। আর নিজে একটি কেরানির চাকরি করে। কেরানিটি তার ছেলেকে ঢাকায় পড়তে পাঠালে ছেলেটির আওয়ামী কালচারাল উইং-এ ব্যাপ্টিজম হয়। এই ব্যাপ্টিজম হচ্ছে নিজ সমাজের মানুষকে বাঙ্গু মুসলমান বলে ডাকতে শেখা। ঐ যে বেঙ্গল রেনেসাঁর বংকিমচন্দ্র কিংবা শরতচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গি এটি। নক্সী পাঞ্জাবি পরে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ছবি তুলে, অটোগ্রাফ নিয়ে, রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দোলাতে শেখে কেরানিপুত্র। হিন্দু ধর্মে কোন এক কাল্পনিক কারণে যেমন কাস্ট সিস্টেম রয়েছে; আওয়ামী ধর্মেও সেই উৎকট শ্রেণী প্রথা রয়েছে। আওয়ামী ধর্মে দীক্ষা না নেয়া মানেই বাঙ্গু মুসলমান হয়ে যাওয়া। কেরানির ছেলে আওয়ামী ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সমকালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর জমিদারি পেয়ে যায়। ধানমন্ডি কিংবা গুলশানে শত্রু সম্পত্তি দখল করে বিরাট এলিট সেজে ঘুরে। মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দেয়। কেরানি দাদার মুখে ক’গাছা দাড়ি দেখে নাতনি বিরক্ত হয়। কারণ কালচারাল এক্টিভিটিজ মানেই সে শিখেছে দাড়ি টুপি নিয়ে হাসাহাসি করা।
ঢাকায় প্রগতিশীল হওয়ার জন্য দুই বেলা ইসলাম নিয়ে হাসাহাসি করতে হয়; তবেই বংকিম প্রগতিশীল পালের গোদাদের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, হ্যা তুমি আমাদের লোক। সুতরাং কেরানির নাতনি আওয়ামী লীগের লোক হয়ে নিজেকে কল্পনায় আর্য ভাবতে শুরু করে। চেহারা ও শারীরিক গঠনে আর্য কল্পনা না কুলালেও ওয়েস্টার্ন আউটফিট পরে বাপের দেশ লুন্ঠনের টাকায় এমেরিকায় পড়তে যায়। ক্লাসের সবাই যখন ইজরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে যায়, সে তখন নয়া জায়নিস্ট হতে ফেসবুকে বাঙ্গু মুসলমানদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে। দক্ষিণ এশিয়ার ভাষায় পশ্চিমা পোশাক পরে বৃথা আর্য হতে চেষ্টা করা লোকেদের “কারেন্টি” বলে।
কেরানি দাদার যেহেতু মামলাবাজির অভ্যাস ছিলো, আওয়ামী মাসলম্যান বাপের ছিলো ঢাকায় পশ্চিমা দূতাবাসে বিএনপির বিরুদ্ধে চিঠি দেবার অভ্যাস। আওয়ামী কোটায় পুলিশ মামার ছিলো, ফেইক জঙ্গীবিরোধী অভিযানের অভিজ্ঞতা; তাই সে কারেন্টি তরুণী বসে বসে পশ্চিমে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েদের ইউনিভার্সিটি ও চাকরিস্থলের কতৃপক্ষের কাছে ইমেইল করতে থাকে। ডিএনএ কথা বলবেই। ছাপড়ি ডিএনএ-কে আপনি যতই ওভার কোট পরান, কফি খাওয়ান, ইউভাল নোয়াহ পড়ান; সে শেষ পর্যন্ত ছাপড়ি লীগের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজির হবে।
দেশ লুন্ঠনের বাই প্রডাক্ট এসব ছাপড়ি এলিটকে দেখে নতুন প্রজন্মের কিছু শেখার নেই। পশ্চিমের সমসাময়িক মানুষেরা দক্ষিণ এশিয়ার ঘষেটি বেগমদের খুব পছন্দ করে; যারা নিজ দেশ ও নিজ দেশের মানুষকে তুচ্ছ করে পশ্চিমা সমাজে ইন্টিগ্রেটেড হতে চেষ্টা করে। সময় একেবারেই বদলে গেছে। ইজরায়েল ও ভারতের ইসলামোফোবিয়ার খদ্দের পশ্চিমা বিশ্বে অন্তত নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে ও পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভের মাঝ দিয়ে জায়নিজম ও হিন্দুইজমের ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি ধরা পড়ে গেছে বিশ্ব জনপরিসরে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।