মাসকাওয়াথ আহসানঃ
শুক্কুর আলী ৩৫ টাকা পকেটে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলো। কয়েকদিন গুলিস্তানে ঘোরাঘুরি করে সেকেন্ড হ্যান্ড পোশাকের দোকানে কাজ পায়। দোকানি তাকে একটা গ্যাবার্ডিনের শার্ট আর প্যান্ট দেয়। সুদূর ইংল্যান্ডে শ্যারেক ওয়ালিশ এই পোশাক পরে একটু পুরোনো হলে ফেলে দেওয়ায় তা সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের বস্তায় করে জাহাজে চড়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। সেখান থেকে ঢাকা। শুক্কুর আলী শ্যারেক-এর ড্রেস পরে বস্তির ঘরে এসে গোল আয়নায় নিজের চেহারা দেখে আর চুল আঁচড়ায়।
হঠাতই একটা বৃটিশ বুড়ো চকির ওপর বসে বলে, শ্যারেক তুমি আবার এইদেশে ফিরেছো। শুক্কুর আলী চমকে উঠে।
বুড়োটা বলে, ইংল্যান্ডে ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরতাম দেখে; একদিন কুইনের সোলজার ধরে জাহাজে তুলে দিলো। দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার পর পৌঁছালাম সুতানুটি বন্দরে। কয়েকদিন ট্রেনিং দিয়ে আমাকে বৃটিশ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। বাংলো আয়া খানসামা সবই পেলাম। জীবন বদলে গেলো। উপঢৌকন নিয়ে পৌঁছে গেলো এদেশের ভ্যাগাবণ্ডেরা। তারা তেলাঞ্জলি দিয়ে বললো, স্যার আমরা পূর্ব বঙ্গে জমিদারি চাই। ওদের পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট করে দিলাম। কৃশ-বেগুণী ভ্যাগাবণ্ডগুলো রাতারাতি জমিদার হয়ে উঠলো। গায়ে গতরে এতো চর্বি হলো যে তারা বাঈজি নাচাতে শুরু করলো। এটা সব সম্ভবের দেশ। কোলাবরেটর হলে তুমি রাতারাতি জমিদার হতে পারো।
সেই থেকে শুক্কুর আলী যখনই বস্তির ঘরে ফেরে তখনই বৃটিশ বুড়োটা এসে চকির ওপর বসে গল্প করে। ঢাকা তখন উত্তাল। পাকিস্তানের খুনে সেনারা আঘাত হেনেছে। বৃটিশ বুড়োটা শুক্কুর আলীকে বলে, সারাজীবন সেকেন্ড হ্যান্ড কাপড়ের দোকানের কর্মচারী হয়ে থাকলে কি চলবে! যাও পাকিস্তানের সোলজারদের মুরগি সাপ্লাই করো। সব সময় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকবে; ক্ষমতা হচ্ছে গড; তাকে তেলাঞ্জলি দিতে হয়।
শুক্কুর আলী ক্যান্টনমেন্টে মুরগী সাপ্লাইয়ের কাজ করে ধনাঢ্য হয়ে উঠলো। যুদ্ধের মধ্যেই বিয়ে করলো। মেয়ের বাবা নেই। মেয়ের মা নিরাপত্তার তাগিদে মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে দেয় শুক্কুর আলীর সঙ্গে। জামাই হিসেবেও শুক্কুর আলী বেশ অনুগত।
বৃটিশ বুড়োটা একদিন শুক্কুরকে বললো, হাওয়া ঘুরেছে; পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে। তুমি দেখো কোথাও থেকে একটা পরিত্যক্ত বন্দুক জোগাড় করতে পারো কিনা। গেরিলা যুদ্ধের ভঙ্গিতে একটা ছবি তুলে রাখো। তারপর মাথায় পতাকা বেঁধে বন্দুক উঁচিয়ে বিজয় মিছিল করো।
শুক্কুর আলী চালাক চতুর লোক। সে বাবর রোডে কারো ফেলে যাওয়া একটি বাড়ি দখল করে। নতুন পাওয়া বাড়ি আলো করে একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিলে; তার নাম রাখে বিপ্লব। শুক্কুর বাড়িতে নেমপ্লেট লাগায় শুক্কুর মজুমদার। কুমিল্লা থেকে কয়েক ঝাঁকা কই মাছ এনে ৩২ নম্বরের চৌবাচ্চায় ছেড়ে দিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর পা ছুয়ে সালাম করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর শুক্কুর হন্তদন্ত হয়ে বৃটিশ বুড়োকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, অহন কি করি!
–আবার ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সাপ্লাই দাও। আর দাড়িটা বড় করে টুপি পরো। পাড়ার মসজিদে বড় করে ডোনেশন দাও।
ছেলে বিপ্লব মজুমদার বড় হতে থাকে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুক্কুর আলী ড্রইং রুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙ্গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট দেখিয়ে ছেলের সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে। বৃটিশ বুড়ো শুক্কুর আলীকে বলে, ব্রাভো শুক্কুর আলী। তোমার ছেলেকে এখন সবাই স্যার বলবে।
এক অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় শুক্কুর আলীর ছেলের। সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে সে তো বিরাট ব্যাপার। ছোট্ট একটা সরকারি কোয়ার্টারে বড় হয়ে সবজান্তা শামসুন নাহার সে। বিপ্লবকে উচ্চারণ শেখায়। ছ বর্ণে উচ্চারণ চাপ দিয়ে করতে বলে। বাসায় রবীন্দ্র সংগীত বাজিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের স্ত্রীর ভঙ্গিতে বসে থাকে। সরকারি গাড়িতে চড়ে আড়ং-এ শপিং-এ যায়। শুক্কুর আলীকে বলে, বাবা আপনি সবসময় টুপি পরবেন না। কেবল নামাজ পড়ার সময় টুপি পরবেন। আর আপনাকে যে আড়ং-এর ফতুয়া কিনে দিয়েছি; ওটা পরে থাকবেন। অতিথিরা এলে যেন আপনাকে বিটিভির নাটকের জমিদার সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবীর মতো দেখায়।
বৃটিশ বুড়ো এসে শুক্কুর আলীকে বলে, আমি এখন ব্রিটেনে ফিরে যাই। তোমার বাড়িতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের মেয়ে বউ হয়ে এসেছে। সে তোমাকে বাকিটা শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে।
আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে বিপ্লব মজুমদার সরকারি কর্মকর্তা লীগের হোমড়া চোমড়া হয়ে পড়ে। তাদের মেয়ে তাসনুভা অনিন্দিতা ছায়ানটে গান শেখে, বাতিঘরে গিয়ে বই হাতে ঘাড় কাত করে ছবি তোলে, ফেসবুকে লোকজনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিপে টুপে কারো চেতনার ঘাটতি দেখলে লিখে আসে, এসব দেখলেও ঘৃণা জন্মায়।
বিপ্লব মজুমদার টিভিতে বাইট দেয়, বাগানকে সুন্দর রাখতে আগাছা পরিষ্কার রাখতে হয়। তাই ক্রসফায়ারটা মাঝে মাঝে প্রয়োজন হয়। জঙ্গী বিরোধী অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বিপ্লব শুদ্ধাচার পুরস্কার পায়। গণভবনের পিঠাপুলির দাওয়াতে বৌকে নিয়ে যায়। বৌ গিয়ে ‘কি ব্যথা অন্তরে ওগো মা’ গানে ঠোঁট মেলালে শেখ হাসিনা খুশি হয়ে তাকে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ দেন।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে তাসনুভা অনিন্দিতা বলে, এসব দেখলেও ঘৃণা জন্মায়। “ঝড় বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি শেখ হাসিনার সাথে” পোস্টার শেয়ার করে।
৫ অগাস্টের পর বিপ্লব মজুমদার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে দুবাইয়ের সেকেন্ড হোমে চলে যায়। বাসায় পুলিশ এসে দেখে, শুক্কুর আলী বসে কোরআন শরিফ পড়ছে। দেয়ালে টাঙ্গানো ভাসানির ছবি।
দুবাই-এ বসে তাসনুভা অনিন্দিতা কখনো ডাকাত এলো ডাকাত এলো বলে চেঁচায়; কখনো বা সাজানো গোছানো দেশটাকে শেষ করে দিলো বলে আহাজারি করে। ইন্ডিয়ান মিডিয়ার ফেইক নিউজ শেয়ার করে। এবার ডিসেম্বর হবে না গো বলে কান্না জুড়ে দেয়। ২১ সে ফেব্রুয়ারি পালন হচ্ছে কোথায় বলে জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন তোলে। মার্চ মাস এসে গেলো তবু পত্রিকায় ক্রোড় পত্র নেই বলে আর্তনাদ করে।
ফেসবুকে মেয়ের অতিরিক্ত লীগশীলতার কারণে বিপ্লব মজুমদারের ব্যাংক একাউন্ট জব্দ হয়। বাড়িতে আবার পুলিশ আসে। শুক্কুর আলীর নামাজ শেষ হলে তাকে জিজ্ঞেস করে, ১৯৭১ সালে আপনি কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন?
শুক্কুর আলী একদিন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে আবেদনপত্র জমা দেয়; যাবতীয় মিথ্যাচারের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।