মাসকাওয়াথ আহসানঃ
লালু ভাই শ্যালকের বাসায় দাওয়াতে এসেছেন। টেবিলে থরে থরে খাবার সাজানো। শ্যালক জিজ্ঞেস করে, অ দুলাভাই রোস্টের টেশ কিমুন হইছে!
–রোস্ট তো ভালোই হইছে। পোলাও রান্নাডাও ফার্স্টক্লাস। খালি একটু ইলেকশনডা হইলে জমতো।
–দুলাভাই পোলাপান চাঁদাবাজি আর দখলবাজি কইরা কিন্তু পাটির ইমেজ নষ্ট করতেছে।
–সতেরো বছর কষ্ট করছে; আর কতো! অহন নিজের ভাগডা বুইঝা নিতেছে। নিতে দেও।
শ্যালকের স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, ও দুলাভাই; আপনার লগে কে কে আইছে! কারে কারে খাওয়ার পাঠামু!
দুলাভাই বিষণ্ণ হয়ে বলে, কইলাম না ইলেকশন না হওনে; পতাকাওয়ালা গাড়িও নাই, গানম্যানও নাই; পুলিশ প্রোটোকলের গাড়িও নাই। লগে ঐ বাচ্চু-কাচ্চু আর ড্রাইভার মোতালেব আইছে অগো খাইতে দেও।
শ্যালকের স্ত্রীর ছোট ভাই মাথা নীচু করে লালুভাইয়ের পাতে একটা আস্ত কৈ মাছ তুলে দেয়।
–আরে করো কি করো কি!
শ্যালক কাঁচুমাচু চেহারা করে বলে, আমার শালা আল হুরাইরা বিন সালমান। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। এইবার বিসিএস দিছে; আন্নে যদি একটু কইয়া দেন পিএসসিতে।
–হ দ্যাশ চালাইতে তো আমগো রক্ত লাগবো; এইচ টি ইমাম তো খালি অগো রক্ত দিইয়া ভইরা থুইছে। দিও রোল নাম্বারডা দিও। কইয়া দেখমুনে। আরে ইলেকশনডা হইয়া গেলে তো এখুনি কইয়া দিতাম তুমার চাকরি হইয়া গেছে। চিন্তা কইরো না; ইলেকশনের পর তো আমার এপিএস কাম ক্যাশিয়ার লাগবো! অংক পারো তো!
সালমান লাজুক হেসে বলে, জ্বি আপনাদের দোয়ায় কিছুদিন বিদ্যুতমন্ত্রী বিপু স্যারের ক্যাশিয়ারি করছি।
–মাশাল্লাহ। বড্ড সজ্জন ব্যক্তি; আমারে জেলখানায় বিরিয়ানি আর টকদই পাঠাইতেন উনি। ব্যবসা বাঁচাইতে আমার লগে যোগাযোগ করছে। তাইলে তো ভালোই হইলো; একই ব্যবসা একই ক্যাশিয়ার।
ফেরার পথে বাচ্চু কুঁইকুঁই করে বলে, লালু ভাই আমি একটা জমি দেখছি; আন্নে কইলেই খুঁটি গাইড়া আপনা কইরা নিমু।
–বিসমিল্লাহ করো; জিগানের কি আছে!
কাচ্চু ইতস্তত করে বলে, আমি লালুভাই একটা কোল্ড স্টোরেজ দখল করছি।
–করো করো; ইলেকশন হইলেই কাগজ পাকা কইরা নিও।
রাস্তায় ভিক্ষুক দেখে লালু ভাই পরোপকারী খলিফার অভিনয়ে নেমে পড়ে, ঐ বাচ্চু ভিডিও কর।
লালু ভাই ভিক্ষুককে একশো টাকা দিয়ে বলে, কিছু খাওনাই মনে কয়; মুখটা শুকাইয়া গেছে গো!
হঠাত কাচ্চু চেঁচিয়ে ওঠে, অই হালার পুত লতিফ তুই অহনো ইন্ডিয়া পালাস নাই; ভিডিও বন্ধ কর বাচ্চু।
ভিক্ষুকবেশী লতিফ লালু ভাইয়ের পায়ে পড়ে যায়, আমারে মাফ কইরা দেন গো লালু ভাই। আমারে আন্নের পার্টিতে ঢুকাইয়া নেন; ইলেকশনে তো লুকজন লাগবো আন্নের। আমি গত তিনডা ভোটে মিনিটে ৪৭টা ব্যালটে সিল মারার রেকর্ড করছি। আমারে বাঁচান গো লালু ভাই।
লালু ভাইয়ের মায়া হয়, ঠিক আছে হইবো হইবো; অই কাচ্চু অরে ছাইড়া দে।
আবার গাড়ি চলতে শুরু করে। পুরোনো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে লাস্যময়ী কানিজ ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে; এলাকার হার্টথ্রব; তার হাসির কাছে পরাজিত সর্বদলীয় দারাশিকো পরিষদ।
-ভ্যাকসিন চৌধুরী অর পায়ের কাছে গড়াগড়ি খাইতো। বাচ্চু অভিযোগ করে, বস, ফুল দিয়া দিয়াই মাইয়াডা সারলো।
লালু ভাই ড্রাইভার কে বলে, আইজকা একটু ড্রাইভ করতে ইচ্ছা করতেছে। মোতালেব তুমি গিয়া একটু ছুটি করো। বাচ্চু-কাচ্চুর হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলে, অই তোরা যাগা-পরিবাররে সময় দে। ফেমিলি ইজ ভেরি ইমপরটেন্ট।
কানিজ গাড়িতে উঠে বসে। লালু ভাইয়ের নিজেকে স্কুল পালানো বালকের মতো লাগে। রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখে নেয় মাথার ক’টা চুল ঠিক জায়গায় আছে নাকি উড়ে গিয়ে স্টেডিয়াম বেরিয়ে গেছে।
কানিজ কিন্নর কন্ঠে লালু ভাই বলে ডাকলে লালু ভাইয়ের বুকের মধ্যে কলকল করে ওঠে। তবু অভিমান করে বলে, খোঁজ খবর তো নেওনা; মানুষটা বাঁইচা আছে নাকি মইরা গেছে। ভ্যাকসিন চৌধুরীরে পাইয়া আমারে তো ভুইলা গেছিলা!
–আমি জেলখানায় তোমারে দেখতে গেছিলাম গো লালু ভাই। এমুন সময় ভ্যাকসিন চৌধুরী ফোন কইরা কয়, বেশি তেড়িবেড়ি করলে আয়নাঘরে হান্দাইয়া দিমু। হালায় ইতর একটা।
–থাক থাক কানিজ তুমার মুখে এইসব মানায় না; তুমি তো সূর্যমুখি ফুল; তুমি হাসলে দুনিয়া হাইসা ওঠে।
কানিজ আলতো করে লালু ভাইয়ের হাতে হাত রাখে, আমরা কবে দুবাই-সিঙ্গাপুর যামু গো! এতো লুকাইয়া লুকাইয়া দেখা করতে ইচ্ছা করে না গো লালন!
লালুভাইয়ের বুকের মধ্যে কাশবনের হাওয়া হুঁই দিয়ে যায়, যামু গো কানিজ সোনা যামু। এই তো ইলেকশনডা হইলেই!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।