বিশ্ব মহামারির কবলে পড়েছে বহুবার। আর মানুষ মহামারীগুলো থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবহার করেছে লকডাউন পদ্ধতি। এটি পুরোণো ও কার্যকর একটি কৌশল। তবে এর কার্যকরিতা অনেকাংশেই নির্ভর করে এর সঠিক ব্যবস্থাপনা, স্থান ও সময়ের প্রেক্ষাপটের ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই কৌশলটি অনেক অংশেই প্রশ্নবিদ্ধ। সমালোচিত হচ্ছে লকডাউন ও এর সার্বিক ব্যবস্থাপনা। কখনো সাধারণ ছুটির মোড়কে, আবার কখনো সর্বাত্মক কিংবা কড়াভাবে বারবার লকডাউন ঘোষণা আজ ফিকে হয়ে গেছে।
মানুষ লকডাউন যেন মানতেই চাচ্ছেন না। মরলে করোনা ভাইরাসে মরবো তবুও লকডাউন মানবো না এমন ভাবাটাই যেন আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রেক্ষাপটে লকডাউন বাস্তবায়ন যে কতটা কঠিন তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসন কর্মীরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন।
জুনের শেষদিকে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় পহেলা জুলাই থেকে সাতদিনের ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ জারি করে সরকার। পরে এই মেয়াদ আরও একসপ্তাহ বাড়ানো হয়। তবে ঈদ-ঊল-আযহাকে সামনে রেখে ১৪ থেকে ২২ শে জুলাই পর্যন্ত লকডাউন শিথিল করে আবারো কঠোরতর বিধিনিষেধের ঘোষণা দেওয়া হয় ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। পূর্বের বিধিনিষেধে পোশাক কারখানা খোলা থাকলেও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর ২২ জুলাইয়ে করা মন্তব্য, ‘এবারের লকডাউনে সব ধরনের কল-কারখানা বন্ধ থাকবে’ বলছে এগুলোও বন্ধ থাকছে। অর্থাৎ বিধিনিষেধকে আরও বেশি জোরদার করার তাগিদ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সচেতন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আমাদের এই বিধিনিষেধ যথাযথ মান্য প্রয়োজন। তবে জীবনের প্রয়োজনে অনেকেই তা পারছেন না। সবমিলিয়ে ঈদ পরবর্র্তী এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে যা ভোগান্তিতেই পরিপূর্ণ বলে অনুভূত হচ্ছে।
চাকুরি বাঁচাতে অনেককেই ঢাকামুখী হতে হচ্ছে। আর কঠোর লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে জন্য ঈদের পরদিনই ঢাকায় পৌঁছানো বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিকাংশের জন্য। যারা খাদ্য, ওষুধ, গণমাধ্যম এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মের সাথে জড়িত তাদের আসতেই হচ্ছে। আরিচা, আমিনবাজার, গাবতলী, সদরঘাট, আব্দুল্লাপুর, পাটুরিয়া ঘাট থেকে সকল যানবাহনকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঢাকার অভ্যন্তরে গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় হেটে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে সবাই। রাজধানীর অন্যপ্রান্তে যার গন্তব্য সে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনার স্বীকার হচ্ছেন। না পারছেন হেটে যেতে, না পাচ্ছেন কোনো যানবাহন। সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করেও কিছু রিকশা ও সিএসজি চলতে দেখা যাচ্ছে যাদের দাবিকৃত ভাড়ার পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অত্যধিক বেশি। এমনও দেখা গেছে, এসব যানবাহনে বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে ঢাকার এক জায়গা অন্যজায়গায় যেতেই তার দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত খরচ করতে হচ্ছে। আবার প্রয়োজনীয় কারণ দেখাতে না পারলে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ঈদ-ঊল-আযহার ছুটিতে ঢাকা ছেড়ে আবার ফিরে আসা লোকসংখ্যার একটি ধারণা পাওয়া যায় মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানিয়েছেন, ১৫ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ঢাকা ছেড়ে যান প্রায় ১ কোটি ৫ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী। আবার ২২ জুলাই (বৃহস্পতিবার) বিধিনিষেধ শুরুর আগের দিনে ঢাকায় ফিরেছেন ৮ লাখ ২০ হাজারের কিছু বেশি গ্রাহক। এক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতা রয়েই যায়, তা হলো একজন গ্রাহকের একাধিক সিম থাকতে পারে। এ জন্য এই সংখ্যা দ্বারা প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন হলেও মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। মোবাইল ফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর হিসাবে, দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। এর মধ্যে ‘ইউনিক ইউজার’ বা প্রকৃত মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ দেশে প্রকৃত মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটির কিছু বেশি। সে হিসাবে ঢাকা ছেড়ে যাওয়া সিম সংখ্যার ক্ষেত্রে ইউনিক ইউজারের হারটি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছেড়েছেন প্রায় ৫৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ । ফিরেছেন প্রায় ৪ লাখ ৪৩ হাজার।
বিভিন্ন গণমাধ্যম চিত্রে উঠে আসে রাজধানীতে কিভাবে মানুষ প্রবেশ করছে। একে কোনো গণপরিবহনকে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, অন্যদিকে রাজধানীর অভ্যন্তরে গণপরিবহন চলছে না। একই সাথে পর্যাপ্ত রিকশা বা সিএনজি ও যাত্রীরা পাচ্ছে না। গুটিকয়েক রিকশা/সিএনজি থাকলেও চালকরা এতো বেশি ভাড়া দাবি করছেন যে যাত্রীরা মোটেও তার জন্য প্রস্তুত নয়। ফলে হেটেই রওনা দিচ্ছেন নিজ গন্তব্যে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এসব জায়গায় মানুষের চাপ কিছুটা কমলেও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় তারা আবারও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের স্বীকার হচ্ছেন। অনেকেই জরুরি কোনো কারণ দেখাতে পারছে না, ফলে গ্রেফতার ও জরিমানার মুখোমুখি হচ্ছেন।
আমাদের বাড়িঘরের বিন্যাস, পরিবারের সদস্য অনুযায়ী ঘরের কাঠামো, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কোনোটাই লকডাউন সফল করার অনুকূলে নয়। লকডাউনে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠিকে বিছিন্ন করে রাখা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে লকডাউনে আটকে পড়া মানুষদের খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু দেশের করোনা পরিস্থিতির আজ প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি সময়েও এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা মোটেও সম্ভব হয় নি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অধিকাংশ মানুষ যেহেতু দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত তাই তাদের খাদ্যাভাব হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর তারা খাদ্যের তাগিদে লকডাউন উপক্ষো করে বাইরে আসাটাও অসম্ভব কিছু নয়। সুতরাং লকডাউন পুরোপুরি কার্যকরের ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এদিকে করোনা ভাইরাস তার তান্ডব যেন দিন দিন বাড়িয়েই দিচ্ছে। লকডাউন, কঠোর লকডাউন বা শাটডাউন দিয়েও মৃত্যু ও সংক্রমণ হার কমানো যাচ্ছে না। আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন এক সাক্ষাৎকারে জানান, গত কয়েকদিরেন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে করোনায় কম বয়সীদের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি নারীদের মৃত্যুঝুঁকি কম এ বিষয়টিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আবার এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, কঠোর থেকে কঠোরোতর লকডাউনেও মৃত্যু কমছে না। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, মৃত্যু কমানোর লক্ষ্য নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিলে কিছু মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। গত ১৫ দিন নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এ সময়ে অধিকাংশ দিন মৃত্যু হয়েছে দুই শ বা তার বেশি।
করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ কিছুটা উন্নতি হওয়ার ফলে মৃত্যু কিছুটা কম বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন। তবে ঈদ পরবর্তী ঝুৃঁকি মোকাবেলার জন্য অক্সিজেন ঘাটতির আশঙ্কা প্রকাশ করেন। অনেকটা স্বস্তির বিষয় হলো, ভারত থেকে ২৫ জুলাই ২০০ মেট্রিক টন অক্সিজেন দেশে এসেছে, ব্যবস্থাপনা ঠিকঠাক হলে এই অক্সিজেন দিয়ে বিপুল সংখ্যাক রোগীর প্রাণ বাঁচানো যাবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা জরুরি রোগীর চিকিৎসা সেবায় দ্রুততা আনতে হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকার পরামর্শ প্রদান করছেন। তারা মনে করছেন, এক্ষেত্রে জনস্বল্পতা দূরীকরণ, দক্ষতার ঘাটতির নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দরকার।
দেশে এ পর্যন্ত এক কোটির বেশি টিকা সংগ্রহ করা আছে। কিন্তু গত ২৫ জুলাইয়ের পর এখনো টিকা প্রদান কর্মসূচি এক কোটিতে পৌঁছাতে পারে নি। এদিকে আগামী বছরের শুরুর আগেই ২১ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহের নিশ্চয়তা দিয়েছেন স্বাস্থমন্ত্রী। এছাড়াও তিনি সংক্রমণ ঊধ্বগতি প্রতিরোধ, অক্সিজেন সংকট, হাসপাতালের সুযোগ-সুবিধা ও শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়েও নির্দেশনা দেন। দেশ আবার নিজ গতিতে চলবে এমন আশায় বসে আসে সবাই। এক্ষেত্রে এই সকল পদক্ষেপ সবার মনেই আশারই সঞ্চার করে। এসব অঙ্গীকারেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবায়ন হবে তার আশঙ্কায় দিন গুণছেন জনসাধারণ। শিক্ষার্থীদের অপেক্ষার প্রহরগোণা শেষ হবে টিকা কর্মসূচি সফল হওয়ার পর। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, এটি শেষ হতে অনেক সময় বাকি। এদিকে শিক্ষার্থীরা অলসতা ও হতাশায় নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ ও নেতিবাচক কাজে ঢুকে পড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি গত দেড় বছরে একবারের জন্য সত্যিকার কঠোর লকডাউন দেওয়া যেত, করোনাকে মুঠোবন্দী রাখা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শুরু থেকেই সমন্বয়হীনতা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি ঘাটতি, আমাদের শুধু মৃত্যু আলিঙ্গনের দিইে নিয়ে গেছে। আর আমাদের যে অবস্থা তাতে, করোনা নিজে থেকে যতদিনে দুর না হবে ততদিনে একে শক্তিপ্রয়োগ করে দূর করা যাবে না। কর্তৃপক্ষ বলছে, মাঝে মাঝে লকডাউন শিথিল করা হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা থেকে দূরে থাকতে। সে হিসেবে ভরসা রাখার মত টিকা কর্মসূচিতেই আশ্বাস রাখছেন আলোচকরা। ফরাসি উপদেষ্টা দেলফ্রেসি বলছেন, আগামী কয়েক বছরে পৃথিবীটা দু’দলে ভাগ হয়ে যাবে। এক দল হবে যারা টিকা পেয়েছে আরেকদল হবে যারা টিকা পান নি। এই দুই দলের মধ্যে সমন্বয় রেখে চলাই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এমন এক ভয়াবহ ঝুঁকির দিকে আমরা ধাবিত হচ্ছি যে, লড়াই করে টিকে থাকবো যারা, শুধু বেঁচে থাকবো তারা। হেরে যাবে অনেকেই।
লেখক: ডা. শামীম তালুকদার, জনস্বাস্থ্য গবেষক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট।