মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ঈদ মোবারক। এবার ঈদে আপনাদের কাছে একটা খোলা চিঠি লেখার ইচ্ছা হলো। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আপনারা যে বীরোচিত ভূমিকা পালন করেছেন; সেজন্য অভিনন্দন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাদ্রাসা শিক্ষিত ছাত্রদের মাঝে যে দার্শনিক চিন্তার উদ্ভাস লক্ষ্য করেছি; তাতে বাংলাদেশে একটি মুসলিম দার্শনিক প্রজন্মের আগমনী শুনতে পাই। দার্শনিক যে, সে সংলাপে আগ্রহী; তাই এই চিঠি লেখা।
আপনাদের মাঝে যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত; তাদের সঙ্গে জার্মানির ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টির অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই। এই দলের সফল নেত্রী ছিলেন আঙ্গেলা মেরকেল। মেরকেলের পিতা ছিলেন একজন খ্রিস্টিয় ধর্মযাজক। মেরকেল ছিলেন পদার্থবিদ্যার মেধাবী ছাত্রী; যিনি তাঁর মেধা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে জার্মানিকে ইউরোপের অর্থনীতির দুরন্ত সহিস করে তুলেছিলেন। এই খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেট পার্টি গণতন্ত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সাফল্যের উজ্জ্বল উদাহরণ। আর ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় গিয়েও ব্যর্থ হবার দৃষ্টান্ত ভারতের নরেন্দ্র মোদি ও তার রাজনৈতিক দল বিজেপি। কাজেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উদাহরণ হিসেবে খ্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টির কর্মপন্থা সামনে রাখলে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। এই দলটি সিরিয়ার মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিলো। অন্যধর্মের কম সংখ্যার মানুষের প্রতি ইনসাফের উজ্জ্বল উদাহরণ রেখেছে দলটি।
ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল মানেই সাম্যচিন্তার দল। কারণ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কায় ধনী-গরীবের বৈষম্য দেখে বেদনার্ত হয়ে একটি নতুন পথের সন্ধান করেছিলেন। মক্কার তরুণদের নিয়ে তিনি একটি সাম্যবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে প্রতিষ্ঠিত বিজনেস ম্যানেজার ছিলেন। মক্কা থেকে দামেস্ক তার সততা ও ব্যবসা কুশলতার সুনাম ছিলো। কিন্তু তিনি নিজের সাফল্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি সবার জন্য মানবিক মর্যাদার জীবন চেয়েছিলেন। তাই তো কখনো বিলাসী জীবন যাপন না করে সাম্যবাদের সাধনা করেছেন।
ইসলামের বাইরে অন্যধর্মের মানুষ সম্পর্কে মহানবীর মনোভাব বুঝতে তাঁর প্রণীত মদিনা সনদ পাঠ করেছি। এই সনদ মদিনায় বসবাস করা ইহুদিদের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলো।
নারী সম্পর্কে মহানবীর দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে লক্ষ্য করেছি, তাঁর স্ত্রী বিবি খাদিজা (রাঃ)-এর সেই সময়ে নারী ব্যবসায়ী হিসেবে স্বাধীনভাবে কাজ করা; জীবনসঙ্গী বেছে নেবার ইচ্ছার স্বাধীনতা ও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ইসলাম দর্শনকে বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা থেকে সমর্থনের সক্ষমতা; সব মিলিয়ে একজন সার্বভৌম ও আত্মনির্ভর জ্ঞানী নারী খাদিজা (রাঃ)-ই প্রথম মুসলিম নারী।
আপনি যদি আপনার শৈশবের কথা চিন্তা করেন; তাহলে দেখবেন আপনার এই যে জীবন; এর পুরোটাই আপনার মায়ের অবদান। মা’ই একটি সংসারকে সার্বিক পরিচালনা করেন; পিতার অবদান সহযোগিতামূলক। আপনি যদি আপনার মেয়েটিকে দেখেন, বুঝবেন সে একজন সুশৃংখল, নিয়মাবর্তী, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। সেই তুলনায় ছেলেটি অনেক উদাসীন। ঠিক এ কারণেই বাংলাদেশে নারী শিক্ষা এতো বিকশিত হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দিতে গিয়ে দেখেছি প্রত্যেক কোর্সে অবধারিতভাবে একজন ছাত্রী প্রথম হয়। কারণ ছাত্রীরা অত্যন্ত মনোযোগী ও আন্তরিক।
পৃথিবীর যেসব দেশ অর্থনীতি, শিক্ষা, সমাজ উন্নয়ন, আইনের শাসন ও মানবিক মর্যাদায় এগিয়ে; সেসব সমাজের এইসব সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের জনসংখ্যার অর্ধেক নারীর অংশগ্রহণ। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে একটি ভালো জায়গায় ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ কিছু এলাকায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ না থাকা। কৃষি ও গার্মেন্টস সেক্টরে বাংলাদেশের সাকসেস স্টোরির নির্মাতা এদেশের নারীরা। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে মডেল ধরে পাকিস্তানে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ বাড়ছে।
আমি অনুরোধ করবো, আপনারা সুযোগ পেলে তুরস্কের সমাজটা একটু দেখে আসুন। সেখানে নারীরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালায়। সেখানে ট্রামে হিজাব পরা নারী ও স্কার্ট পরা নারী পাশাপাশি বসে গল্প করতে করতে যায়। জুলাই বিপ্লবে যেমন হিজাব পরা ছাত্রী ও জিনস ও টপস পরা ছাত্রী হাতে হাত রেখে হাসিনাতসির বিরুদ্ধে লড়েছে। পোশাক মানুষের ব্যক্তিগত অভিরুচি। আর পৃথিবীর যেসব দেশে পুরুষেরা নারী কি পরবে, কি বলবে, কিভাবে চলবে এগুলো ভেবে সময় নষ্ট করেনি; তারাই কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে পেরেছে।
আপনারা সবাই জালালউদ্দীন রুমির কবিতা পড়েছেন; অথবা তার সম্পর্কে জানেন। রুমীর কবিতা পশ্চিমা বিশ্বে বেস্ট সেলার। প্রতিদিন পশ্চিমের অসংখ্য ভক্ত তুরস্কের কনিয়েতে আসেন, রুমির মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে। এই রুমি আল্লাহকে পেতে চেয়েছেন গীতি কবিতার মাঝ দিয়ে। রুমীর দরবেশ নৃত্য হচ্ছে পৃথিবীর সাধারণ চিন্তা ভুলে অনন্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে খোদার সঙ্গে মিলিত হবার আকাংক্ষায়; আল্লাহ;র প্রেমে দিওয়ানা হওয়া। সেটাকেই সুফি ইসলাম বলে অনেকে। ইসলামের গৌরব গাথার দেশ সেই অটোমান সাম্রাজ্যের হৃদয় বিন্দু তুরস্ক থেকে সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ইরান হয়ে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে আধ্যাত্মিক গীতিকবিতার মাঝ দিয়ে আল্লাহ’র প্রতি প্রেম নিবেদনের এই ধারাটি বয়ে নিয়ে আসেন ইসলামের কবি ও শিক্ষকেরা। এই কবি ও শিক্ষকদের গৃহটিই মাজার বলে পরিচিত। আল্লাহকে কে কিভাবে ভালোবাসবেন, কিভাবে তার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন; সেটা ইচ্ছার স্বাধীনতা। আল্লাহ আর বান্দার মাঝে তৃতীয় পক্ষের নাক গলানোর অধিকার না থাকাটাই ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য্য। আর পবিত্র কুরান তো আল্লাহর প্রেরিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ। যে কাব্য ভালোবাসেনা সে কুরানের গভীর দর্শন বোঝার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।
আমি আপনাদের ইউটিউব বক্তৃতাগুলো শুনি। ধর্ম ও দর্শন নিয়ে আপনাদের আলোচনা আমাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু ব্যতিক্রমী কেউ কেউ আছেন; এরা যখন ধমক দেন; তখন আওয়ামী লীগের ধমক দেয়া লোকগুলোর কথা মনে পড়ে। আমার ব্যক্তিগত দর্শন হচ্ছে; বাংলাদেশ আমার মাতৃভূমি; আমি একে কিভাবে ভালোবাসবো; তা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। ইসলাম আমার ধর্ম, একে আমি কিভাবে ভালোবাসবো, তা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। তাই আপনাদের প্রতি অনুরোধ আপনাদের মাঝে যারা ইসলামের মালিকানা দাবী করেন; ঠিক যেভাবে বাংলাদেশের মালিকানা দাবী করেছিলো আওয়ামী লীগের লোকেরা; সেইসব লোককে বোঝান; তারা এভাবে যেন ইসলামের সুনাম নষ্ট না করেন। কারণ দেশটা যেমন কারো বাপের না, ইসলামও তেমনি কারো বাপের না।
আমি আপনাদের লেখা পড়ি, আশা করছি আপনারাও আমার লেখা পড়বেন। এরকম চিন্তা বিনিময়ের মাঝ দিয়ে আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সমাজ গড়ে তুলতে পারবো। আপনাদের সবার জীবনে ঈদ অনেক আনন্দ আর আল্লাহ’র অনুগ্রহ নিয়ে আসুক; এই প্রত্যাশা রেখে আজকের চিঠি এখানেই শেষ করছি।
(ছবিতে তুরস্কের স্বৈরাচার ও বৈষম্যবিরোধী বিক্ষোভে রুমীর পোশাক পরা একজন)
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।