মাসকাওয়াথ আহসানঃ
ভারতে শিশুরা ছোটবেলা থেকে মহাভারতের গল্পে অপরিমেয় শক্তিমত্তার কল্পনা শুনে বড় হয়। ভারতের সরকারি টিভিতে মহাভারত ও রামায়ণের কাহিনী যেভাবে চিত্রিত করা হয়; তাতে শিশুরা নিশ্চিত হয়ে যায়, পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এক অগ্রসর সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিলো। এই ফিকশন দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে দারিদ্র্য বিশীর্ণ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। ফলে ভারত রাষ্ট্র প্রকল্পটি পাঁচ হাজার বছর আগের গল্প মহাভারতের বীরত্বগাথার ওপর দাঁড়িয়ে।
ভারতের সাধারণ মানুষের কল্প-কাহিনীতে আস্থা রাখার প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে বলিউড তৈরি করে দ্বিতীয় ইলিউশনের জগত। বলিউডের এফলুয়েন্স-গ্ল্যামার দেখে দুই থেকে তিন ঘন্টার জন্য বুঁদ হয়ে থাকে দারিদ্র্য সীমার নীচের মানুষ। নিম্ন মধ্যবিত্তের মাঝে বলিউড ফ্যাশান অনুকরণ তাদেরকে সেই ইলিউশনের জগতে হামাগুড়ি দেয়ায়। দেশটা বলিউডের মতো জাঁকজমকপূর্ণ এমন একটি কল্পনা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে শিশুরা।
বলিউডের স্পাই মুভিগুলোতে শত্রু খতমের অসম সাহসিকতা দেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে “আমরাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ” এমন একটি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপিত হয়।
ঠাকুরমা যেরকম চমতকার স্টোরি টেলিং-এর মাঝ দিয়ে শিশুদের বড় করেন; আর বলিউড যেরকম সমৃদ্ধির গল্প তুলে ধরে, তাতে শিশুরা মনের মাধুরী মিশিয়ে সাফল্যের গল্প বলতে শেখে, নিজের ও দেশের।
বিজ্ঞাপন শেখায় একটি মিথ্যাকে কত নান্দনিক ও জীবন ঘনিষ্ট করে তুলে ধরা যায়।
এইভাবে পৌরাণিক গল্প, ঠাকুর মা’র ঝুলি, বলিউড, টিভি বিজ্ঞাপন একটি ইউটোপিয়ান জীবন ও রাষ্ট্রকল্পনা দেয়।
ভারতে যতদিন ড মনমোহন সিং-এর মতো নেতা ছিলেন; ততদিন পর্যন্ত একে একচুয়ালাইজেশনে ফিরিয়ে এনে অনাহারী কৃষক, আত্মহত্যাপ্রবণ যুবসমাজ, নিপীড়িত দলিত ও সংখ্যালঘু মানুষের ট্র্যাজেডি, নিম্ন গড় আয়, স্যানিটেশন ব্যবস্থার দুর্বলতা, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, ধর্ষণ ও খুনোখুনি সম্পর্কে ভারতবাসীকে সচেতন করার লোক ছিলো।
গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা করে; স্বপ্নে বাবরি মসজিদের নীচে মন্দির দেখে; পাঁচ হাজার বছর আগের মহাভারত ফিরিয়ে আনার অলীক কল্পনা নিয়ে হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির অশ্বমেধযজ্ঞ শুরু হয়। সভ্য ভারত পরিকল্পনা থেকে পরী ডানা মেলে উড়ে চলে যায়। কট্টর ইসলামপন্থা নিয়ে তালিবান জঙ্গীরা যেভাবে আফঘানিস্তান চালাচ্ছে; একইভাবে কট্টর হিন্দুত্ববাদ নিয়ে বিজেপি ছাব্বারা ভারত চালাচ্ছে।
নেহেরু-আজাদের বহুত্ববাদ, অক্সফোর্ড শিক্ষিত ইন্দিরার স্মার্টনেস, কবি বাজপেয়ীর পরিশীলিত আচরণ, ড মনমোহনের সৌম্য স্থিতধী এনলাইটেনমেন্ট; এসবই ছিলো সেকুলারিজমের লিপ সার্ভিসে ঢেকে রাখা কট্টর হিন্দুত্ববাদী ভারতের ক্ষত। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত শিক্ষা-সংস্কৃতির উতকর্ষ দাবি করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয় আলোচনাটা প্রণব মুখার্জির ভঙ্গিতে করতে থাকে। অথচ প্রণব গিয়ে সবশেষে বিজেপির ফুলমাল্য গ্রহণ করে বলেন, মিশন একোমপ্লিশড।
ভারতের ক্ষতি করেছে চাণক্যের পশ্চাদপদ সব কূটনীতি ও সমরনীতি। চাণক্যের নীতি ছিলো শঠতা, চোখের বদলে চোখ, স্বার্থপর পরিকল্পনা। গ্রামের একজন কুটিল পঞ্চায়েত প্রধানের মতো চিন্তাভাবনা তার। আধুনিক বিশ্বে এতো আউটডেটেড রাজনীতি ও পররাজ্য নীতি সফল হবার কোন কারণ নেই।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট বাংলাদেশে পরাজিত হয় ভারতের চাণক্যনীতি। এরপর নয়মাস ধরে ভারতের ক্ষমতা কাঠামো, সেনা প্রধান ও মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে যে আকাশ কুসুম কুটিল প্রচার চালিয়েছে যে; বাংলাদেশের স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা ওসব গ্রাম্য আলাপ শুনে হেসেছে। পশ্চিমা বিশ্বে তো ভারতীয় মিডিয়া একটা ইন্টারন্যাশনাল এমব্যারাসমেন্ট। দিল্লির বাংলাদেশ সম্পর্কে চাওয়াগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে টিভিতে প্রচার করতে গিয়ে একেবারেই ভাঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে সেসব। আমরা ভাবতেও পারিনি, ভারতে এতো দুর্বল ছাত্রেরা সাংবাদিকতা করে। এ কিরকম সাংবাদিকতা যেখানে পাঁচ শতাংশ সত্যেরও উপস্থিতি নেই।
ভারত মোটামুটি পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই (বালুচিস্তান যখনই পাকিস্তানে যুক্ত হয়েছে) বালুচিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন উস্কে দিতে শুরু করেছে। সে কারণ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের দামামা বাজতেই গদি মিডিয়া ফেক নিউজ দিয়েছে, বালুচিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এভাবেই বালুচিস্তানের স্বাধীনতা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। অথচ ভারতের প্রত্যাশা, এর প্রেক্ষিতে পাকিস্তান ফুল এগিয়ে দিয়ে বলবে, অনেক ধন্যবাদ ভারত, ভালোই দিয়ে গেলেন।
ভারতের অলীক আকাংক্ষা, সে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্নদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদি ও সন্ত্রাসবাদিদের মদত দেবে; এই বিপরীতে পুরো দক্ষিণ এশিয়া ভারতকে এসে চুম্বন দেবে।
ভারতের ক্ষমতা-কাঠামো, মিডিয়া ও ম্যাগালোম্যানিয়ায় আক্রান্ত কিছু মানুষের নিজেকে শ্রেষ্ঠ- সেরা- প্রথম- অপ্রতিদ্বন্দ্বী কল্পনা করা দেখে শেষ পর্যন্ত দুঃখই লাগে। মহাভারত-বলিউড-বিজ্ঞাপন যে ভ্রান্ত অধ্যাস তৈরি করেছে; যে ইলিউশনের মধ্যে বসবাস করছে মোদি সমর্থকেরা; এই মানসিক বিভ্রান্তি থেকে সম্ভবত ফেরার পথ নেই।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।