নওশের ডন
ম্যাগাজিন ছিল গভীর আত্মার টানের একটা বিষয়। কভিডের আগেও গাদাগাদা সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক, বার্ষিক কেনা হয়েছে। নানা ব্যস্ততায় এখন আগের মত সময় পাই না, তিনটা দৈনিক রেখেও পড়া হচ্ছে না।
কিন্তু দিন দিন প্রিন্ট হারায়া যাচ্ছে। মোড়ে মোড়ে থাকা নিউসস্ট্যান্ডগুলা কবে নাই হয়ে গেল? এমনকি ঢাকা নিউমার্কেটের বিদেশী ম্যাগাজিনে ভরা পত্রিকার দোকানে এখন বেচে কসমেটিক্স। চিটাগাং রেলস্টেশনের বই দোকানে বিক্রি করছে অলটাইম বনরুটি! দোকানির আর দোষ কি, যা বিক্রি হবে, তা’ইতো বিক্রি করবে! ট্রেনে ঘাড়ে সাময়িকীর গাট্টি নিয়ে আসা লোকগুলো কী নিয়ে আছে এখন?
অথচ সেই পঞ্চাশ-ষাটের দশকের ঢাকার বর্ণনায় দেখি নিউমার্কেটের নিউজ হোমে বিশ্বের হেন কোন পত্রিকা-ম্যাগাজিন ছিল না যেটা পাওয়া যেত না। যশোর-বরিশালে নাকি স্টেটসম্যানের সার্কুলেশন এখনকার শীর্ষস্থানীয় বেশির ভাগ দৈনিকের চেয়ে বেশি ছিল। প্লেনে করে সদ্য আসা নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান এসব পড়ার লোক নাকি ঢাকায় একদম নগন্য ছিল না।
তবে ঘাঁটতে গিয়ে দেখি এতো সব পুরনো ম্যাগাজিন! সেই কয় বছর আগে শেষ সংখ্যাটা বেরিয়েছিল, অবিক্রিত থাকায় তা’ই শেলফ আলো করে বসে আছে।
যাই হোক, শেষে মনের আশ মিটিয়ে গাদাখানিক কিনে ফিরে এলাম ডেরায়। মনে পড়লো ছোটবেলার কথা।

আমাদের আধশহরের হাতে গণা ক’টা বইয়ের দোকানে কমই ম্যাগাজিন পাওয়া যেত৷ তারপরও আমি সৌভাগ্যবান— বাসায় গাদা গাদা ম্যাগাজিন রাখা হতো৷ ছোটবেলায় পুরনো ম্যাগাজিন পড়া ছিলো এক মহা আনন্দের বিষয়৷ আমাদের একটা রুম ভর্তি ছিলো ম্যাগাজিন৷ পরে জায়গা না হওয়ায় সব বিক্রি করতে হয়েছে৷
এমনো মাস গেছে বাসায় মনে গোটা ত্রিশেক ম্যাগাজিন এসেছে৷ আম্মা রাখতেন সানন্দা, দেশ, বেগম, অন্যদিন এসব৷ আব্বু বিচিত্রা, ২০০০ ইত্যাদি৷ আমাদের জন্য কিশোর তারকালোক/পত্রিকা/কথা/টইটম্বুর/ছোটদের কাগজ, শিশু, আনন্দমেলা, উন্মাদ, কমিক্স ওয়ার্ল্ড, অহরহ, সায়েন্স ওয়ার্ল্ড৷ বড়রা রহস্যপত্রিকা, টেলিভিশন, আনন্দলোক৷ বিভিন্ন লিটল ম্যাগ, সাহিত্য পত্রিকা, ওপার বাংলার কালেকশান। আনন্দের পুজো বার্ষিকীর আদলে বিচিত্রার গ্র্যান্ড ঈদ সংখ্যার কথা মনে পড়ে। পরে অন্যদিন তো ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস প্রকাশের প্রতিযোগিতা লাগায়া দিছিল হুমায়ূন, জাফর, সুনীল, সমরেশের লেখা দিয়ে।
এরপর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, কিশোর আলো, বিজ্ঞান বার্তা, মহাকাশ বার্তা। বিভিন্ন দৈনিকের সাপ্লিমেন্ট্রি ম্যাগাজিনের জন্য ওই ওই দিন পত্রিকা রাখা। সেন্ট্রাল মসজিদের সামনের ফুটপাথ থেকে টাইম-নিউজউইক-ইকনমিস্ট কেনা। বিভিন্ন লাইব্রেরি ঘেঁটে জার্নাল আর্টিকেল বের করা। ব্রিটিশ কাউন্সিলের এম্পায়ার, গার্ডিয়ান সাপ্লিমেন্ট্রি, ইন্ডিটু। আমেরিকান সেন্টারে ই ডাবলিও, এফপি। গ্যাটে, আলিয়ঁস, ইরানিয়ান কালচারাল সেন্টারের এক্সপেরিয়েন্স। রাশিয়ান ও আর ইন্ডিয়ানে দুর্দান্ত ম্যাগাজিন ফ্রি দিত! বিশ্বসাহিত্য, সংস্কৃতি বিকাশ, ব্যান্সডক সহ ঢাকার যত লাইব্রেরি। ক্যাম্পাসের সেন্ট্রালের ভেতরে নিরিবিলিতে পুরো এক বছরের ম্যাগাজিন কালো চামড়ার বাঁধাই করা মোটা মোটা ভলিউম পড়ে পড়ে কত দুপুর কেটে গেছে! নীলক্ষেত চষে রিডার্স ডাইজেস্ট, ন্যাট জিও সহ বিদেশী হিডেন জেম বের করা। আরো কত কী যে বাদ পড়ে গেছে কে জানে!
এইটিজে নাকি ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্ট, সিনেব্লিটজ এসব ম্যাগাজিনের সাথে ক্যাসেট দিতো ফ্রি। একসময় তারকালোক, ক্রীড়ালোকের সেন্টারফোল্ডে পোস্টার থাকতো। মাঝে কমপিউটার টুমরো/ টাইমস/ জগৎ/ ই-বিজ এসবের সাথে ইন্টার্যাকটিভ সিডি দিত। সিডিতে ডিজিটাল ম্যাগাজিন বেরিয়েছিল আইটি-কম, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। অনলাইন ম্যাগাজিনের মধ্যে মনে পড়ছে বিডি আর্টস, বাংলানিউজ২৪ এর গুলোর কথা। এ ছাড়া এক সময় ব্লগ নামধারী ফোরাম খুব জনপ্রিয় ছিল। বেশ কিছু ফেসবুক গ্রুপ, পেজে আর্টিকেল, ফিচার টাইপ লেখা পড়েছি।
খেলা নিয়ে ঝোঁকের সময় ক্রীড়ালোক, ক্রীড়াজগৎ৷ পিসি নিয়ে ঝোঁকের সময় কমপিউটার টুমরো/টাইমস/বিচিত্রা/বার্তা, ই-বিজ, সি-নিউজ ইত্যাদি৷ কার্টুন, গাড়ি, মিউজিক, ফ্যাশন, আর্ট, লাইফস্টাইল, সিনেমা, ফটোগ্রাফ আরো কতকিছু নিয়ে কত কিছু যে ছিলো, সব হারায়ে গেছে!
তবে এখন এক্সেস বেড়েছে। আগে পড়েছি শ’য়ে শ’য়ে, এখন ডিজিটাল এসে এক্সেস দিয়েছে হাজার হাজারের। আমেরিকান একটা পাবলিক লাইব্রেরির এক্সেসে পড়ি ফ্লিপস্টারে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাবস্ক্রিপশন দিয়ে আর বি ডিজিটাল, প্রেস রিডার আর মাই লফটে। মাঝে কিছু বন্ধুর হৃদ্যতায় প্রাইম রিডিং। খুঁজছি কেউ শেয়ার করবে কি না Magzter, Apple News+, Kindle Unlimited, Scribd এসব। কিন্তু ভয় লাগে যখন শুনি বন্ধ হয়ে গেছে ন্যাট জিও প্রো, রিডার্স ডাইজেস্ট ইউকে। অদ্ভুত একটা দ্বান্দ্বিক ব্যাপার, যে নেটের জন্য এত লেখার এক্সেস পাচ্ছি, সেই নেটই অন্য এন্টারটেইনমেন্ট মিডিয়াম এনে পড়ার অভ্যাস আর আউটলেট দুইটাই গায়েব করে দিচ্ছে!
নওশের ডন, লেখক ও সিভিল সার্ভিসের সদস্য।