মাসকাওয়াথ আহসান
বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের ছেলে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান হয় সবার অলক্ষ্যে। শ’খানেক অতিথি, তিন চার কোর্সের খাবার, সৌম্য সংগীতে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে সব আনুষ্ঠিকতা সম্পন্ন হয়। অনেকে চার্চে বিয়ের পর এর উঠোনে সেরে ফেলে বিয়ের সাদাসিধে আপ্যায়ন। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার লোক বিয়েতে একটু হৈ চৈ করে বলে; তাদের নিয়ে কমেডি মুভি “বিগ ফ্যাট গ্রিক ওয়েডিং” তৈরি হয়েছিলো। এরপর পশ্চিমের বিয়ের অনুষ্ঠান আরো মিনিমালিস্টিক হয়েছে।
আর দক্ষিণ এশিয়ায় দেখেন টাকা হলেই সন্তানের বিয়েতে বেবি ডল এনে নাচানো, রুপি বেশি হলে বলিউডের তিন খান ছয় উর্বশী এনে নাচানো; পশ্চিম থেকে ভি আই পি অতিথি এনে পাঁচ গ্রামের লোককে তাক লাগিয়ে দেয়া। মিডিয়া বুমাররা হেড লাইনে বিয়ের খবর দিয়ে ঘ্রাণেই অর্ধভোজন করে।
অর্থসম্পদ শিক্ষাদীক্ষা যাই হোক; প্রদর্শনবাদিতার বাড়ই দেখে ঠিকই চেনা যায় এরা শ্রীখণ্ডের লোক।
এখন বুঝতে পারি সত্যজিত রায়ের মতো স্থিতধী মানুষ কেন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ব্যাকওয়ার্ড মেন্টালিটি এদের। এদের যদি সত্যজিত রায়ের “জলসাঘর” চলচ্চিত্রটা দেখা থাকতো; তাহলে বুঝতো নতুন পয়সাওয়ালাদের কীভাবে চিত্রায়িত করেছিলেন তিনি। ইউরোপের শিল্পবিপ্লব পরবর্তী নতুন পয়সাওয়ালাদের নিয়ে অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রয়েছে। ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি এদের নাম দিয়েছিলেন, ফিলিস্টাইন্স।
আম্বানির ছেলের প্রাক বিবাহ আয়োজনকে ঘিরে যেন নেচে উঠলো মিডিয়া। আম্বানির এফলুয়েন্সের শো রুম হয়ে উঠলো টিভির পর্দা। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের ক্লাবের সদস্যরা ভারতীয় এক্সটিক পোশাক পরে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এলেন। বিল গেটসকে রিসিভ করছেন নীতা আম্বানি নীলাভ নেকলেস পরে। মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ নীতার নেকলেস যা দাম তা প্রতিবেশি পাকিস্তান-শ্রীলংকার জিডিপির চেয়ে বেশি। রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামী ভারতের এই জৌলুস দেখে আহলাদে আটখানা। আম্বানির ছেলের হাতের ঘড়িটি দেখে মার্ক জুকারবার্গের চীনা বংশোদ্ভুত স্ত্রীর তো চক্ষু চড়ক গাছ; একি করলেন জুকির সহধর্মিনী; এই ঘড়ি তার চাই-ই চাই; অভিমানেই কী তিনি ফেসবুক বন্ধ করে দিলেন; পরে হয়তো “তোমায় ঘড়ি কিনে দেবো” বলে আশ্বাস দিয়ে ফেসবুক পুনরায় চালু করেন জুকি! পশ্চিমা ধনীর স্ত্রীরা ভারতের ধনীর ছেলে-স্ত্রী’র ঐর্শ্বর্য্য দেখে বিগড়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আম্বানির ছেলের বিয়ে হৈ চৈ আদার ব্যাপারিদের কল্পনা শক্তির ডালপালা মেলে দেয়। প্রাক-বিয়ের অতিথিদের জন্য ২১ জন শেফ রান্না করছেন প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মনোলোভা খাদ্যরাজি। মিডিয়ার যেন ঘ্রাণেই অর্ধভোজন হয়ে যায়।
আম্বানির সুতোর টানে বলিউডের তিন খান নৃত্য পরিবেশন করে; মিডিয়া আকুল হয়ে খবর দেয়, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেও নাচছেন দীপিকা পাডুকোন; বলিউডের অন্যসব উর্বশীরা মাতোয়ারা আজকের বিশ্বামিত্র আম্বানির ধ্যান ভাঙ্গাতে। খাবার আগে ঠাসাঠাসি করে বসে অপেক্ষা করছেন শাহরুখ খান, শচীন টেন্ডুলকার; মেঝেতে মাদুর পেতে বসে হৃত্বিক রওশন; বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন করন যুহর। বড় লোকের জিয়াফত খেতে যাবার হ্যাপাতো আছেই। অমিতাভ বচ্চনের জন্য আম্বানির বরাদ্দ মাত্র দশসেকেন্ড; বচচন কী যেন বলতে চাইলেন; কিন্তু আম্বানি চলে গেলেন আরেক ভি আইপি অতিথিকে দশসেকেন্ড মনোযোগ দিতে।
ঐ যে আম্বানির রাজপ্রাসাদ, ঝাড়বাতি; উঁচু খিলান; সঙ্গীতের প্রাচুর্য, আলোকসজ্জা, বুফেতে উন্মুক্ত খাদ্য রাশি রাশি; সেখান থেকে সিংহ দুয়ার পেরিয়ে বড় বড় গাড়ি পার্ক করে রাখা; ভ্যালেদের সন্ত্রস্ত আর্তনাদ; ভি আইপি অতিথিদের কে আসছেন, কে যাচ্ছেন; সবকিছু ঠিক ঠাক হতে হবে; তারপর ফুটপাথে নিয়ন বাতির নীচে সারি সারি মানুষের রাতের ঘুমের আয়োজন; উন্নয়নের জন্য নদীতে বাঁধ দিতে হলে; তাতে খরা নেমে এলে; কৃষক ফসলহারা হলে অথবা জিডিপি বাড়াতে বনভূমি উজাড় করে শিল্প কারখানা হলে; ভূমিখেকোদের কামড়ে গ্রামগুলো শহর হলে; ডেভেলপারের বুলডোজারের নীচে চাপা পড়ে যায় ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরেরা। আত্মহত্যা করা কৃষকের মৃত্যুবেদনা বুকে নিয়ে স্বজনেরা শহরে এলে; ফুটপাথে তাদের স্বপ্নের ভারত রচিত হয়।
পশ্চিমে ধনীরা কেবল নিজের সন্তানের কথা ভাবে না; তাইতো তারা ক্ষুধার্তদের জন্য ফিলানথ্রপি করে; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৃত্তি দেয়, অনাথাশ্রমে খরচ করে। এ এবল লোক দেখানো কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নয়। ধনীরা এমন কোন সম্পদ প্রদর্শনী করে না; যা দরিদ্রদের মনে হতাশা সঞ্চার করে; মধ্যবিত্তকে লোভী করে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার ধনীরা সেই লাখপতি হবার যুগে লক্ষ বাতি জ্বেলে জানান দিতো; চেয়ে দেখো আমার সম্পদ উপচে পড়ছে। আর এখন মিডিয়ার বাতি জ্বেলে ধনীরা তাদের এফলুয়েন্সের ঢাক-ঢোল বাজায়। সে কারণেই ইউরোপের দেশগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মাত্র দশবছরে গ্রাউন্ড জিরোর অবশেষ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার জন্য কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে। আর ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর; বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধ শতক পরে কী বৈষম্যের আঁচল বিছায়েছে; ভালো বাসার শহরগুলো ক্রমে ক্রমে অভিশপ্ত মৃত্যুর শহরে পরিণত হয়েছে যেন।
২০০০ সালে মৃত্যুর শহর নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। সেইখানে ধনিকপুত্র শুভ ব্যারিস্টার হয়ে ফেরায় তার বাবা একটি পার্টি থ্রো করে। নৌবিহার; ওয়াইজঘাটে রাজহাঁসের মতো প্রমোদ তরী ভিড়ে আছে। অসংখ্য গাড়ি এসে ঘাটে রীতিমত কুরুক্ষেত্রের সৃষ্টি করেছে। পাজেরো, নিশান প্যাটরল, ল্যান্ড রোভার, মার্সেডিজ, টয়োটা ক্রাউন। জাস-সাস-দূত-পতাকা ওড়া-পতাকা গোটানো। স্যুট টাই, সাফারি স্যুট, পাঞ্জাবি,-বারো রকম সফল মানুষের ভীড়। বণিক পুত্রের অভিষেকে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের কর্মকর্তা, আইএমএফ, ইউনিসেফ, ইউএনডিপির কর্মকর্তা, ইউএস এ আইডি, ইউকে ওডিএ, যে আই সিএ কর্মকর্তা, বায়ার, আমলা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, এমপি, মন্ত্রী, শিল্পী, সেলিব্রেটি কে নেই? আনন্দবিহার শেষে রাজহাঁসটি এই উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট মুকিতের ভালোবাসার শহরের দিকে যখন ফিরতে থাকে; আশংকায় মুকিতের বুক শুকিয়ে যায়। মুকিত চিতকার করে তার প্রিয় পুরবাসীকে জাগাতে চায়।
“মৃত্যু দানবেরা ধেয়ে আসছে-গলিত লাভার মতো ধেয়ে আসছে-একটু পরেই তারা সাঁজোয়া বহর নিয়ে প্রবেশ করবে স্বপ্নের শহরে-তার নিচে প্রাণ দেবে কবি, পরাজিত মেঘদল, অসহায় কালোমানুষ। ঐ দেখো, মাত্র ক’জন মৃত্যুদানব কত সহজে আনতে পারে মৃত্যুর মড়ক।” মুকিত হু হু করে কাঁদতে থাকে। তার স্ত্রী সিনডেরেলা কাঁধে হাত রেখে বলে, চলো ঘরে ফিরতে হবে।” মুকিত অস্ফুট বিড় বিড় স্বরে বলে, ঘর কোথায়? সমস্ত শহর এখন মৃত জোনাকির থমথমে চোখ।”
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।