ফারদিন ফেরদৌস
বাংলাদেশ বুঝি একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে নিজেই নিজেকে শুদ্ধাচার পুরষ্কার দেয়া যায়। আমরাই একমাত্র জাতিরাষ্ট্র যারা ঘূর্ণিঝড়ের ১০ নম্বর বিপদ সংকেত উদযাপন করতে সমুদ্রে যেয়ে নর্দনকুর্দন করতে পারি। টিকটক বানিয়ে ভিউ কামাতে পারি।
আমাদের গণমাধ্যমগুলোও আরেককাঠি সরেস। দমকা হাওয়ার ধাক্কা সয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, কোমর পানিতে ডুবে ঝড় বিলাসীদের ক্যামেরার সামনে ডেকে এনে বলছে, ‘আপনার অনুভূতি কেমন হে ঝড়ের রাজা অথবা রাণী?’
ঘূর্ণিঝড়কে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ইনপুট করিয়ে দৃষ্টিনন্দন ছবি বানিয়ে বলে দিচ্ছি, ‘আহা কী সুন্দর ঘূর্ণিঝড়ের মুখচ্ছবি!’
আমরা কেমন জানি হয়ে গেছি। উপকূল প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। আর এদিকে আমরা খিচুড়ি রান্না করে সেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে বেপরোয়া রোমান্টিসিজমে মেতে উঠছি।
এই বৃষ্টি মোটেও আনন্দের না। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট নিম্নচাপের বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া মানে গজব, মহাদুর্ভোগ। খিচুড়ি খেয়ে রোমান্স করবার জন্য আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের পুরোটা পড়ে আছে। মানুষের দুঃখ না বুঝলে নিজের নাম আর মানুষ থাকে কেমনে?
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় সারাদেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট চলছে। না আছে ইন্টারনেট সেবা, না আছে মোবাইল নেটওয়ার্ক। মোটর চালিয়ে খাবার জল তোলা যাচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। দমকা হাওয়া ও ক্রমাগত বৃষ্টিতে জমির ফসল ভূমিতে মিশে গেছে। সবজি বাগান প্রায় নেই হয়ে গেছে। ছাদবাগানের গাছেরা রীতিমতো ধুকছে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠালও তাদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহর ডুবে গেছে জলে।
আর উপকূলবাসীর অবস্থা?
অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। গৃহহীন হয়েছেন শত শত মানুষ। ফসলি জমিতে লবণপানি ঢুকে বিনষ্ট হয়ে গেছে সব। ভেসে গেছে হাজারো চিংড়ির ঘের। কাঁচা ঘর ধসে পড়েছে। গবাদিপশুর দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। অনেকের বাড়িতেই গলা সমান পানি। সুন্দরবন ঢাল হয়ে প্রকৃতি বাঁচাতে গিয়ে হারিয়েছে তার মূল্যবান বৃক্ষরাজি, মায়া হরিণ বা অন্যান্য জীববৈচিত্র্য। এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে দুর্বিপাকে পড়া মানুষ ও প্রাণ প্রকৃতির প্রতি মর্মপীড়া বোধ করব না আমরা? সমব্যথী হবো না তাদের?
আমরা আর কবে বুঝব যে,
“এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তুমি চলে যেও না/
বৃষ্টির ও ছন্দে বকুলের ও গন্ধে/
আমায় তুমি ফেলে যেওনা।”
-এই লগন এমন গান শোনাবার নয়। আমরা এখন সমস্বরে গাইব…
“মানুষ মানুষের জন্যে,/
জীবন জীবনের জন্যে।/
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?/
ও বন্ধু….
আমরা তো এমন ছিলাম না। এক তিল চল্লিশ জনে ভাগ করে খাওয়ার পুরাণকথা আমাদের জানা ছিল।
রোমনগরী যখন পুড়ছিল নিষ্ঠুর রোম সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সেই নিরোর বংশধরেই কী তবে ভরে গেল বাংলার উঠোন?
মৌসুমী বৃষ্টি বন্দনায় রবিঠাকুর-জীবনানন্দ দাশ অনেক কাব্য গাঁথা নির্মাণ করেছেন। আমরাও সেসব গীতি আলেখ্য সানন্দে গ্রহণ করে বৃষ্টিবিলাসে মাতি। কিন্তু রিমালের মতো ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণিপাক নিয়ে কবিতা গান? তেমন একটা শুনিনি।
আমরা কী খাই? কী দেখি?
কোথা থেকে অর্জন করছি আমাদের আজকের উপলব্ধি। এভাবে বিবেক ও বোধ কী করে খুইয়ে বসলাম আমরা? কেমন করে এমন আত্মস্বার্থনিমগ্ন হয়ে পড়লাম সবাই? কারো ব্যথাই আমাদের মনে দাগ কাটবে না? নিজে ভালো থাকবার নাম আদৌ আনন্দে থাকা হয়? আমার সুহৃদ, স্বজন, শুভানুধ্যায়ী, পাড়া প্রতিবেশী, দেশের মানুষ যদি ভালো না থাকে কাকে দেখাবো আমার এই রঙঢং?
অন্যকে না ভালোবাসলে নিজেকে ভালোবাসতে শিখব কখন? তুল্যমূল্যের যত্ন না করলে নিজেকে মূল্যায়ন করব কার পরাকাষ্ঠায়?
আমি কি কেবলই আমার?
কখনোই নয়। কারণ আমার বিনির্মাতা তো আমি নই।
আপনভোলা নিজেকে নিজে পুরস্কৃত করবার নাম শুদ্ধাচার নয়। আপনি যখন মানুষ বুঝবেন গণনায়কোচিত শুদ্ধাচার পুরষ্কার এমনিতেই আপনার হবে। জগৎ ভালোবেসে ওটাই নিয়ে নিন না। কবি কামিনী রায়ের ‘সুখ’ আমাদের সবার হোক।
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও।
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
ফারদিন ফেরদৌস, লেখক ও সাংবাদিক।