মাসকাওয়াথ আহসানঃ
আমার নানা বাড়ির পাশেই ছিলো মাখন নন্দী নানার বাড়ি। মাখন নন্দী কাজ থেকে অবসর নেবার পর সারাদিন বাইরের বারান্দায় বসে চুকচুক করে চা খেতেন। দুপুরের খাবারের পর যেতেন সিয়েস্তায়। এসময় আমাদের দিনমান ক্রিকেট খেলার টেনিস বল উনার টিনের চালে পড়লেই চেঁচিয়ে উঠতেন, এই কে রে!
উনার মেয়ে রানু আন্টি উনাকে গিয়ে বলতেন, বাবা, আপনার জীবনে আনন্দ নাই বলে কি; এই বাচ্চাকাচ্চাদের জীবনেও আনন্দ থাকতে নেই; আপনি এতো বিরক্ত হন কেন!
ফেসবুকে এসে সারি সারি মাখন নন্দীর দেখা পেলাম। এরা যে কোন উতসব এলেই এক একটা বিবেকের গান নিয়ে হাজির হয়ে; যে কিশোর-তরুণেরা আনন্দ করে; তাদের গিলটি ফিলিংস দিতে চেষ্টা করেন।
ফেসবুকের মাখন নন্দীদের মাঝে রয়েছেন ধর্ম চিল ও প্রগতিচিল। ধর্ম চিলের কাজ হচ্ছে, জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের নববর্ষ ও বাংলা নববর্ষ এলেই; একটিকে ইহুদি-নাসারা ও অপরটিকে হিন্দুয়ানী কালচার বলে নাকচ করে দেয়া। আর পোগোতিচিল এসে আতশবাজি করলে পাখি মারা যাবে, উচ্চস্বরে গান বাজালে অসুস্থ রোগী মারা যাবে; এসব বিবেকের গান ধরে। এজ ইফ পৃথিবীর দেশে দেশে আর আতশবাজি ফুটানো হয় না। সেসব দেশে পাখি নেই। সব পাখি এসে জুটেছে ঢাকায়। যে স্পেসে একটা একতলা বা দোতলা বাড়ি থাকার কথা; সেখানে বহুতল এপার্টমেন্ট বানিয়ে শহরটাকে ইটের জঙ্গলে পরিণত করে; ইচ্ছামতো বৃক্ষনিধন করে; এখন পাখির জন্য কাঁদতে এসেছে পুরবাসী।
গতকাল রাজশাহীর একটি ভিডিও দেখলাম, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দুজন তরুণ-তরুণীকে প্রেম করার অপরাধে ধরে থানার দারোগার মতো কর্কশ ভাষায় বকাঝকা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পোষ্য কোটা না থাকলে, বিভাগীয় প্রধানের বাজারের ব্যাগ টানার প্রথা না থাকলে ভদ্রলোক হয়তো থানার দারোগাই হতেন।
কুরবানির ঈদের আগে পোগোতিচিলেরা মৌসুমী ভিগান হয়ে কান্না জুড়ে দেয়, কুরবানি দেবেন না প্লিজ। শাক-সবজির বৃহতস্বর্গ গড়ে তুলুন। ঈদুল ফিতরে কেউ কেউ এসে বলে, আমি ঈদ বিশেষ পালন করিনা; তাই ব্যাংককে চলে যাচ্ছি। নিজে কম্যুনিটির সঙ্গে বন্ধুত্বের জীবন যাপন করে না; এলিয়েনেশনে শুকিয়ে যাওয়া ফুলদানির বিবর্ণ ফুল; লোকজনকে শেখাচ্ছে পোস্ট মডার্ন লাইফ স্টাইল, ঈদের সময় পাতায়া চলে যাই।
মোটাদাগে ধর্মচিল ও পোগোতিচিলের বিবর্ণ এক জীবন; কর্কশ শৈশবে আনন্দের আয়োজন ছিলো না; ফলে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের আনন্দ করতে দেখলে, তখন একটা ধর্মীয় বিধি, বা সাংস্কৃতিক বিধি কিংবা এনজিও বিধি নিয়ে হাজির হয়।
আমরা জেনারেশন এক্স কিংবা মিলেনিয়ালরা যে কোন আনন্দে খুশি জল ও হ্যাপিনেস জয়েন্টের দিকে জোর দিতাম। জেন জি খুব সম্ভব বাপ-চাচাদের উটের মতো খুশিজল পান ও ঝোড়োকাকের মতো হ্যাপিনেস জয়েন্ট পান দেখে; সফট ড্রিংকস আর এনার্জি ড্রিংকসেই খুশি থাকে। দুর্নীতিবাজ লোকেদের ছেলেমেয়েরা কোকেন ও আইস পরিষেবা করে; সেটা নিউটনের তৃতীয় সূত্র; বাপ দেশডাকাতি করলে, ছেলে মাদকাসক্ত হবেই।
জেন জি’র সুবিধা হলো, যে ধর্মীয় অনুভূতি ও জাতীয়তাবাদী অনুভূতি দিয়ে এতোদিন সমাজকে বিভাজিত করে দেশ লুটের সিস্টেম চালু রেখেছে প্রৌঢ়-জাঢ্য-জরদগবেরা; সেটাকে তারা রিলেট করতে পারে না। ফলে কে স্কার্ট পরলো আর কে হিজাব পরলো, তা নিয়ে প্রৌঢ় ধর্ম মোল্লা ও প্রগতিমোল্লার যে কচকচানি; ওগুলোকে পাগলের প্রলাপ মনে হয় তাদের কাছে। কলকাতার বাসের মাজন বিক্রেতার পরিপাটি পোশাককে তারা প্রগতিশীল মনে করে না; আবার ধর্মীয় পোশাককে তারা জঙ্গীবাদ বলে তকমা দেয়না। এইসব ক্ষুদ্রত্বের কুঁচকুঁচানিকে তারা অতিক্রম করেছে।
এই যে শেখ হাসিনার ফ্যাসিজম; একে ধর্মচিলেরা খাসজমিতে আর পোগোতিচিলেরা প্লট-পদবী-পদকে উপভোগ করেছে। এরাই দেড় দশক চুপ চুপ চুপ অনামিকা চুপ বলে, ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলতে নিষেধ করেছে। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের আবার ফ্যাসিজমে সমস্যা কি! এদের ফেসবুকের হিতোপদেশ, “পোস্ট মুছে দিন, নইলে অসুবিধা হবে” প্রত্যাখ্যান করেই জেন জি বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে ভারতীয় ধনুক ব্যবসার আওয়ামী ফ্যাসিজম থেকে।
একটু মনে করে দেখুন, আগে বৌদ্ধ ধর্মের মানুষেরা প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস ওড়াতেন। আমরা তা দেখে খুশি হতাম। আমাদের নিও এসথেটিকসের সর্দার পোগোতিচিলেরাই যেখানে সেখানে ফানুস উড়িয়ে ব্যাপারটাকে জনপদের জন্য ঝুঁকি পূর্ণ করে তোলে। বিদ্যুৎ উতপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার আলোর নাচন নাচতে ফায়ার ওয়ার্কস ব্যাপারটাকে ডালভাত করে ফেলে উন্নয়নের সেবাদাস পোগোতিচিলেরা।
আত্মকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে; বেইলি রোডের রেস্টুরেন্টে আগুন লাগলে; হাপুস নয়নে কাঁদে। আর নিমতলী, মিরপুর ও কড়াইল বস্তির আগুনে অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় অভিমত দেয়, বস্তিগুলো উঠে গেলেই ভালো। দুর্নীতি বিপ্লব, এনজিও বিপ্লব, কর্পোরেট বিপ্লবে নতুন ধনী ফিলিস্টাইন্সেরা নিজের সন্তান ছাড়া আর কারো ভালো মন্দের খবর রাখে না। ড্রাইভার, গৃহকর্মীর জন্য পৃথক লিফট রাখে বহুতল ভবনে। অধিকার বঞ্চিত শ্রেণীর সঙ্গে এতো কর্কশ ব্যবহার এই নির্দয় শহর ছাড়া আর কোথাও এই আদিম চেহারায় নেই।
তাহলে অধিকার বঞ্চিত শিশু-কিশোরেরা কোন আনন্দের উপলক্ষে পটকা ফুটানোর সময় কেন মনে রাখবে, দুর্নীতিবাজ অসুস্থ বৃদ্ধেরা আর তাদের রাজকুমার-কুমারির কানে তালা লেগে যাবে। হাই প্রোটিন খেয়ে কোলেস্টেরল, প্রেশার ও ডায়াবেটিস বাড়ানো ইঁদুর দৌড়ের ধেড়ে ইঁদুরদের কিসে সুখ কিসে অসুখ; সে সমানুভূতি হ্যাভস নট শিশু কিশোরের থাকবে কেন! তারা কি কথিত নয়া উচ্চ সমাজের কাছে কোন সমানুভূতি পেয়েছে।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।