মাসকাওয়াথ আহসানঃ
বাংলাদেশের মানসপটে সুলতানি-মুঘল ও নবাবী আমলের সংস্কৃতি-সঙ্গীত-কাব্য-নক্সাচিত্রের কোন ছবি নেই। বৃটিশেরা উপনিবেশ স্থাপনের পর; বাংলাদেশ লুন্ঠনের প্রয়োজনে পৃথিবীর সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী মুঘল ও নবাবী শাসকদের বর্বর হিসেবে চিত্রায়িত করতে হয়েছিলো। তাই তো বৃটিশেরা জমিদারি ও সরকারি চাকরি দিয়ে; সাসপেন্ডার দিয়ে ভুঁড়ি সামলে পশ্চিমা পোশাক পরতে শিখিয়ে-ইংরেজি পড়িয়ে একটা কোলাবরেটর শ্রেণী তৈরি করেছিলো; যারা নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে দুঃশ্চরিত্র আর আওরঙ্গজেবকে কট্টর ইসলামপন্থী হিসেবে চিত্রিত করে ইতিহাস লিখবে। ১৯২৫ সালের দিকে কলকাতায় একটি সেমিনার আয়োজন করে বখতিয়ার খিলজিকে নালন্দার গ্রন্থ পুড়িয়ে দেয়ার দায় চাপিয়ে মুসলমান মানেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এমন ছবি আঁকা হয়।
যে পূর্ববঙ্গে কবি আমির খসরু এসে বসবাস করে কাব্যরচনা করেছিলেন; এর রুপে-গুনে-ঐশ্বর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন; যেখানে সমৃদ্ধ কৃষি ও শিল্প সভ্যতার বিকাশের পথ ধরে আরবীয়, ফারসী, চৈনিক, রোমান ব্যবসায়ীরা আসতেন বিশ্বের আকর্ষণীয় বানিজ্যকেন্দ্রে; যেখানে মধ্যযুগে রোসাং রাজসভার কবিরা রচনা করেছেন সৃজনশীল সাহিত্য; যেখানে পাল যুগ থেকে শুরু হওয়া পোড়ামাটির কাজে আনন্দময় জীবনের ছবি; সুলতানি-মুঘল-নবাবী আমলে ক্ষমতায়িত নারীর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করার ঐতিহ্য; বৃটিশেরা তার কলকাতার কোলাবরেটরদের সঙ্গে নিয়ে সেই জনপদের সমৃদ্ধি বিনাশের কাজে লেগে পড়ে। ১৭৭০-৭৬-এর মাঝে সৃষ্ট কৃত্রিম খাদ্য সংকটে প্রায় এক কোটি মানুষ হত্যা করে ইঙ্গ-কলকাতা গোষ্ঠী। মুঘল আমলে ব্যবসায়ীদের জন্য নির্মিত যাত্রাপথের সরাইখানা ধ্বংস করে; কর্মীদের ঠেলে দেয়া হয় অনিশ্চিত লুট তরাজের জীবনে। বৃটিশেরা তাদের নাম দিয়ে দেয় থাগস অফ বেঙ্গল।
পূর্ববঙ্গের মানুষের আত্মবিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়ে কলকাতায় নির্মিত একশো বছরের পুরোনো সংস্কৃতিকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে তুলে ধরা হয় তাদের সামনে। বৃটিশ শিক্ষক ডিরোজিও কলকাতার যুবাদের সেকুলারিজমের ধারণা দিলেও, পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্টের গল্প বললেও; ইউরোপের মতো চার্চ থেকে বিযুক্ত সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব ছিলো না তাদের পক্ষে। ফলে হিন্দুত্ববাদকেই তারা প্রগতিশীলতা হিসেবে পাঠ করে। আচ্ছা করে পুজো আর্চা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চর্চা; আর নামাজ পড়লেই তা মৌলবাদ। কলকাতার চলচ্চিত্রের মুসলমান মানেই থুতনিতে দাড়ি, চোখে সুরমা, মাথায় টুপি। কলকাতা স্টাইলে অসাম্প্রদায়িক হতে ঢাকার চলচ্চিত্রে মুসলমানদের এই স্টেরিওটাইপিং শুরু হয়। আর মুক্তিযুদ্ধের পর “রাজাকার” চরিত্র মানেই দাড়ি টুপি দিয়ে সাজাতে হয়। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের স্থিরচিত্রে ক্লিনশেভড রাজাকারদের দেখতে পাই। হাসিনা আমলে যুদ্ধাপরাধী বলে যাদের বিচার হলো; গোলাম আজম ছাড়া বাকি সবাই ১৯৭১ সালে ক্লিন শেভড ছিলো। তার মানে দাড়ি টুপির মোটিফ আরোপিত।
পূর্ববঙ্গের যে ছেলে-মেয়েরা কট্টর হিন্দুত্ববাদী বংকিমচন্দ্র পড়ে বড় হলো; শরতচন্দ্র পড়ে জানলো মুসলমান হলে আর বাঙালি হওয়া যায় না; তারা মুসলমান আত্মপরিচয় নিয়ে কুঞ্চিত হলো।
আশির দশকে সমাজতন্ত্রকে শায়েস্তা করতে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি সৌদি আরবকে কট্টর ইসলাম প্রচারে প্রণোদিত করলো। এসময় বাংলাদেশের বৈষম্য বিধুর সমাজ থেকে পালিয়ে দরিদ্র যুবকেরা সৌদি আরবে গেলো কাজের সন্ধানে। সমাজের শ্রম ঘন অংশের লোক হওয়ায়; তারা আরব বিশ্বের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সংস্কৃতি; কিংবা আবহমান আরব সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলো না। আরব দুনিয়ার কবিতা-সংগীত-চিত্রকলা-নৃত্য-ভাস্কর্য আর ঐতিহ্যবাহী উতসবের যে রুপ রস গন্ধ তা সম্পর্কে কিছুই না জেনে; বাংলাদেশে ফিরে তারা দেড় ইটের মসজিদ গড়ে কট্টর ইসলামপন্থী হয়ে পড়লো। অমনি কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা প্রগতিশীলতার ফতুয়া পরে আঙ্গুল তুললো, ঐ দ্যাখো ইসলাম মানেই মৌলবাদ। ভারত তো প্রতিবেশীদের কট্টর ইসলামপন্থার গপ্পো নিয়ে দিনমান একাকার করে দিলো; কোনফাঁকে কট্টর হিন্দুত্ববাদ যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে বসে আছে তা খেয়াল করার সময়ই পায়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশে কট্টর ইসলামপন্থার সমর্থক সংখ্যায় নগন্য; রাষ্ট্রক্ষমতা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
আমরা বাংলাদেশে এই ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ প্রভাবিত মোদি প্রগতিশীল আর সৌদি ইসলামপন্থা প্রভাবিত ধর্মশীলের কালচারাল ওয়ারের যন্ত্রণায় আছি। ঈদের কাফেলা বা শোভাযাত্রা আয়োজন করলে; মোদি প্রগতিশীল সারাদিন হোজ্জার মোটিফ নিয়ে রগড় করে; আর ইসলাম ধর্মশীল ওতে পৌত্তলিকতা খুঁজে কুঁচ কুঁচ করে। বৈশাখের শোভাযাত্রায় হাসিনাৎসির মোটিফ দেখে গোস্বা হয় মোদি প্রগতিশীল। আর ইসলাম ধর্মশীল তা নিয়ে পৌত্তলিকতা বলে কুঁচ কুঁচ করে। মিশর, তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইরানের উতসবের রঙ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে তো এটা হবেই। খোদ সৌদি আরবেই কট্টর ইসলামকে কোমল ও শান্তির ইসলামের ঐতিহ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যে সংস্কার কার্যক্রম চলছে; সে সম্পর্কে না জেনে হোলিয়ার দ্যান দাউ সেজে বসে থাকা আর কি।
বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী উৎসবে আশির দশকে নবতর সংযোজন আনন্দ শোভাযাত্রা। নব্বুই-এর দশকের মাঝামাঝিতে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক এর নাম দেন মঙ্গল শোভাযাত্রা। বিংশ শতক পর্যন্ত এই শোভাযাত্রা আনন্দময় ছিলো। ২০০৯ সালে ভারতের রাজনীতিক প্রণব মুখার্জির হস্তক্ষেপে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের দেওয়ানি লাভ করলে ক্রমেই মঙ্গল শোভাযাত্রা আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষায় “অষ্টমীর এক ডালিয়া”-তে রুপান্তর হয়। চারুকলার মতো সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান হিন্দুত্ববাদী আওয়ামী লীগের মঙ্গলসাধনকলায় পরিণত হয়।
সেই দলীয় প্রভাব মুক্ত করতে সব ধর্ম-গোত্র-নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের জন্য এবার নববর্ষের আনন্দ শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়েছে। বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে কৃষক ও কারিগরের দেশ; পহেলা বৈশাখ তাদের আনন্দের দিন। কর্মই যাদের ধর্ম সেই মেহনতী মানুষের এই সম্মিলনে সর্ব ধর্মবাদের চর্চা হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু অষ্টমীর একডালিয়া করে না রেখে একে মানুষের জীবন উৎসবে রুপান্তরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি চানরাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ঈদের শোভাযাত্রায় সে জীবনের উপস্থিতি ছিলো। আগামীতে পুজো-বুদ্ধ পূর্ণিমা- ক্রিসমাস ও অন্যান্য বিশ্বাসের মানুষের উতসব সামনে রেখে এমন জীবন মিছিল আয়োজিত হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের সম্মিলন ঘটানো। আমরা সেই সব মানুষের রাষ্ট্র সৃজনের স্বপ্ন দেখি।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।