মাসকাওয়াথ আহসান
অভিমন্যু বধে সক্রিয় অতীব ধর্মনিষ্ঠ ভীষ্ম, দীক্ষাগুরু দ্রোণাচার্য, বীর কর্ণ। উন্নয়নের এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বার বার নিমতলীর চুড়িহাট্টা, তাজরীন, গুলশানের আগ্নিগোলক থেকে বেঁচে যায় অভিমন্যু। অবশেষে বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই অগ্নিগোলক থেকে বেঁচে এসে অভিমন্যু মার্কস সেইফ ফ্রম ফায়ার।
ধর্মনিষ্ঠ ভীষ্ম বলেন, রাজউকের ফিটনেস ছিলো না কোথাও। যারা আগুনের সমালোচনা করে তাদের পিতা রেষ্টুরেন্ট মালিকেরা গ্যাস সিলিন্ডার জমা করে রাখে নির্গমন সিঁড়িতে। সব দোষ এসব লোভাতুর মালিকের। রাজউকে বসবাস সাধুদের। তারা নোটিশ দিয়ে দিয়ে পেরেশান; তবু ব্যবসায়ীদের হুঁশ হয়না। এই অনিচ্ছুক কুরুবাসীদের জিডিপি গ্রোথ আর সমৃদ্ধ মাথাপিছু আয় এনে দেয়াই আমাদের ভুল হয়েছিলো।
দীক্ষাগুরু দ্রোণাচার্য আদেশ করেন, শো মাস্ট গো অন। রঙ্গভবনে প্রতিমন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ আয়োজনে দেশপ্রেমের প্রতীক “কাচ্চি” দিয়ে আপ্যায়ন হওয়া চাই। আজকাল অভিযোগ শুনি কাচ্চিতে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাংস কম দেয়। কিন্তু এই মহতী আপ্যায়নে সর্বদলীয় সমর্থকের মাংস আছে; এই কাচ্চি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণ মূলক। বেইলিরোডের কাচ্চিতে গণতন্ত্রের পোড়া মাংসের ঝাঁঝ আছে; রঙ্গভবন মৌ মৌ করছে সেই আমিষের সুঘ্রাণে।
বীর কর্ণ বলেন, অভিমন্যু তুমি পালাবে কোথায় ! মাতৃগর্ভে থাকতে তুমি অগ্নিগোলকে প্রবেশের গল্পটা শুনেছিলে। কিন্তু ঐ গোলকধাঁধা থেকে বের হবার পথের গল্পটি অসম্পূর্ণ ছিলো। উন্নয়নের মিথ্যা গৌরবের আগুনে পুড়ে যায় প্রাণ; বেরিয়ে আসে সেই অমোঘ সত্য; এ আসলে মৃত্যুর শহর এক; মৃত জোনাকির থমথমে চোখ! অভিমন্যু তুমি আজ হোক কাল হোক ঠিকই মারা পড়বে উন্নয়নের অগ্নিগোলকধাঁধায়।
গ্রিক অগ্নি দেবি হেস্টিয়া তখন এম্ফি থিয়েটারে বসে গ্ল্যাডিয়েটর টি- টোয়েন্টির ফাইনাল দেখছেন। এ শহরের ডেভেলপমেন্ট সুইপার পল্লীর লোকেরা শোক-তাপে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়। পেটে খুশিজল পড়লেই তারা কচি শূয়োর পুড়িয়ে খায় আর উদ্দাম নৃত্য করে, জিতবে এবার নুকা, জিতবে এইবার নুকা! ব্যাংক খেকোরা মাথায় পতাকা বেঁধে এম্ফিথিয়েটারের গ্যালারিতে বসে সেলফি তোলে; থ্যাংক ইউ হেস্টিয়া।
সেই নিমতলীর ছোটখাটো মানুষের পুড়ে যাবার দিনটিতে হাজার বছরের সংস্কৃতির চন্ডালেরা বইমেলায় যেমন হেসে হেসে অটোগ্রাফ দিয়েছিলো; একইভাবে বেইলি রোডের আগুনের দিনে মাঝারি মানুষেরা পুড়ে গেলেও সেই বইমেলার শিল্পসাধনায় কোন ছেদ পড়েনা। কালচারার সুগার ড্যাডিরা; তন্বী নয়নে বহ্নি ; হৃদি সরসিজ প্রেম উদ্দাম ধন্যি হয়ে বাতাবি টিভির বুমে কামড় দেয়।
বেইলি রোডের আগুনের পরে পোড়া লাশেরা প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকলে; উন্নয়নের মৃগয়ার বিরুদ্ধে লোহিত পোস্টার হয়ে উঠতে থাকলে; বিদূষক ও সহমত লিলিপুটেরা সে বিজয়কে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করতে থাকে, তাদের চর্বির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য। এমনকী মৃতদেহকেও জিতে যেতে দেয় না। নেমে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়া কুরুক্ষেত্রে। নীরোর বাঁশিতে মাতোয়ারা চারপাশ।
–লন্ডনে, সুইযারল্যান্ডেও এমন আগুন লাগতে পারে।
–আপনারা পাকিস্তান নিবাসী নাকি যে আগুন লাগার মধ্যে রাজনীতি আনতেছেন। ভারত নিবাসীরা তো দুর্ঘটনাকে উন্নয়নের সঙ্গে মিশায় না!
কেরানিগঞ্জে নৌকায় চড়ে কাচ্চি খাওয়া ফুড ব্লগার ও দোয়েল খাদক ইনফ্লুয়েন্সাররা নেমে পড়ে, অগ্নিকান্ডের দোষ দালান মালিক ও সাধারণ মানুষের কাঁধে চাপাতে; কারণ রাজউক সাধুসন্ত! উন্নয়নের সরকার, বারবার দরকার শ্লোগানে ফুড ভ্লগারেরা লেটস টক চালু করে; এক একজন ফায়ার ড্রিল স্পেশালিস্ট হয়ে পড়ে রাতারাতি।
সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মেশে, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে ছারখার তবু টনক নড়বার নয়!
হেস্টিয়া বার্ন ইউনিটে একটি অগ্নিদগ্ধ মৃতদেহের আত্মপরিচয় নিয়ে কট্টর প্রগতিশীল বনাম কট্টর ইসলামপন্থীর বচসা শুরু হয়। লাশটি শাস্ত্রী নাকি খাতুন! ফেসবুকে তার পূজা- অর্চনার ছবি ছিলো। সুতরাং হিন্দুত্ববাদীরা তাকে শ্মশানে সতকার করতে চায়। আর ইসলামপন্থীরা তাকে কবরে সমাহিত করতে চায়। গল্পের শাখা-প্রশাখা হয়। তার পিতা-মাতা খোকসা গ্রামের মুসলমান; নাকি বারাণসীর ব্রাহ্মণ। কোনটা তার ঘর ওয়াপাসি, মুসলমান থেকে হিন্দু; নাকি হিন্দু থেকে মুসলমান। লাভ জিহাদ নাকি সেকুলার বিপ্লব! সেই টিডিয়াস আর্গুমেন্ট।
হেস্টিয়া ও অগ্নিদেবী! প্রণতি তোমায়; টিটানকুলহত্যার প্রতিশোধ নিতে আর কত পোড়াবে ছোট খাট মানুষের ঈশ্বরকে। আর কত লাশ বলি দিলে শুদ্ধ হবে চেতনার বেদি। কত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার ডানা হলে; কত কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ঝলক হলে মৃত্যুতৃষ্ণা মিটবে।
অভিমন্যু দৌড়াতে থাকে; দৌড়াতে থাকে মৃত্যুর শহর এফোঁড় ওফোঁড় করে; কোথায় আগুন নেই; কোথায় গেলে ঠিকঠাক মার্ক করা যাবে- “সেইফ ফ্রম রিভেঞ্জ ফায়ার”!
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।