মাসকাওয়াথ আহসান
প্রত্যেক ঈদের আগে কতিপয় প্রগতিশীলন্মন্য লোক মুসলমানদের ঈদ উতসবের কোন কোন দিক মন্দ; তা নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করে। এরা বলে, ইসলাম ধর্মে আসলে আনন্দের কোন উপলক্ষ নেই। এ হচ্ছে বিশুষ্ক মরুর ধর্ম। শুধু খাওয়া-দাওয়া কী কোন ধর্ম হতে পারে! না আছে গান; না আছে নৃত্য।
আমার ধারণা বিশুষ্ক শৈশব থেকে বেরিয়ে আসা মানুষেরা; অল্প বয়সে যাদের আমসিপারা শেখানোর হুজুরের বেত্রাঘাতের খারাপ স্মৃতি আছে; অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে সংস্কৃতি মামাদের একই গান বিভিন্ন দিবসে গাইতে দেখে, সংস্কৃতি খালাদের সব ঋতুতে একই নাচতে দেখে; সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা মায়োপিক ভিউ পেয়েছেন তারা। আর হঠাত প্রগতিশীল হয়ে বাবু বা সাহেব কালচারে ঢুকে পড়ায় গরিব মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা ভুলে গেছেন। প্রান্তিক মানুষের জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা ট্রেনের জানালা দিয়ে গ্রাম দেখার মতো।
ঈদের আগের দিন রাতে কৃষক ও শ্রমিক তার সন্তানকে নিয়ে যখন বাজারে যায়; সন্তানকে একটি নতুন কাপড় কিনে দিলে; সন্তানের চোখে আনন্দ অশ্রু দেখে; পিতৃ হৃদয় শীতল হয়।
ঈদের দিন সকালে কৃষাণী যখন খিঁচুড়ি ও গোশত রান্না করে; সেই সুঘ্রাণে মৌ মৌ করে ঘর; গার্মেন্টস কর্মী মা যখন সেমাই রান্না করে; তাকে ঘিরে বসে থাকে সন্তানেরা। গরীব মা তার মেয়ের চুলে নতুন লাল ফিতা বেঁধে দিলে; ছেলের নতুন জামায় আতর দিয়ে দিলে; অপার্থিব আনন্দ নেমে আসে ছোট্ট গৃহে। সুখের হুল্লোড়ে তা আনন্দগৃহ হয়ে ওঠে।
ঈদ্গাহের পাশে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে গরিব পিতা যখন সন্তানদের বেলুন-বাঁশি কিনে দেয়; ঈদের আনন্দ তখন ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে।
মধ্যবিত্তের ঈদ আনন্দে যুক্ত হয়; মহল্লায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ঈদ পুনর্মিলনী, ঈদ মেলা, ফুটবল খেলা আরো অনেক অনুসঙ্গ।
এই যে নব্য প্রগতিশীলেরা ইসলাম ধর্মে আনন্দ নেই বলে সুইপিং কমেন্ট করেন; তারা কী কখনো আরব বিশ্ব, ইরান-ইরাক-লেবানন-সিরিয়া-তুরস্কের ঈদ দেখেছেন!
বিবিসি-সিএনএন আর অর্ণব গোস্বামীর রিপাবলিক টিভির লেন্সে ইসলামি জগত জুড়ে সন্ত্রাসবাদ দেখলে তা হবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ইসলামোফোবিয়া।
মিশরে যে সংগীত-ভাস্কর্য-চিত্রকলা, ইরানে যে সংগীত-চিত্রকলা-চলচ্চিত্র, আরব বিশ্বে যে কবিতা-সংগীত, সিরিয়ায় যে সংগীত-নৃত্য, তুরস্কে যে সংগীত-নৃত্য-কবিতা-ভাস্কর্য, লেবাননে যে সংস্কৃতির রঙ এর বাহার; সেগুলো সম্পর্কে কোন ধারণা না রেখে; পাংশু মুখে হারমোনিয়াম নিয়ে সংস্কৃতি উদ্ধারের অহম তৈরি হয়েছে ঢাকা ও ঢাকা থেকে প্রবাসী হওয়া ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর; আমার বরং দুঃখ হয়; জানাশোনার ক্ষুদ্র জগতে তৈরি হওয়া এই গজদন্তের মিনারটির জন্য।
প্রতিটি বাংলা নববর্ষের আগে বাংলাদেশের একটি রক্ষণশীল গোষ্ঠী এই উতসবটিকে “হিন্দুয়ানী” বলে তকমা দিয়ে দেয়। অথচ কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিক হিসাব নিকাশ সুনির্দিষ্ট করতে; যাতে তারা ফসলহীন সময়টাতে দারিদ্র্যে নিপতিত না হয়; খাদ্য সঞ্চয় করে আগে থেকেই; দিল্লির মুঘল সম্রাট আকবর পয়লা বৈশাখের নববর্ষ উতসব সূচনা করেন। সে কারণে এই উতসব দক্ষিণ এশিয়া সব কৃষিপ্রধান সমাজেই হয়। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও ভারতীয় পাঞ্জাব অংশে এই উতসব হয়। সরকারগুলোর বৈরিতা থাকলেও; দুই পাঞ্জাবের মানুষের মিলনমেলা রচনায় একটি কূটনৈতিক সহযোগিতার মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে সংগীত, নৃত্য, মেলা, রঙের বাড়ই সব থাকে; নারী-পুরুষ একত্রে যোগ দেয় এই প্রাণের উতসবে। শিখ- হিন্দু-মুসলমানের কোন ভেদাভেদ থাকে না এই উতসবে।
বাংলাদেশের চিত্রকলার যে মোটিফগুলোকে হিন্দুয়ানী বলে ডিফেম করা হয়; ওরকম মোটিফ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশ-বালুচিস্তান-পাঞ্জাব-খাইবার পাখতুন খোয়াতে কেবল চিত্রকলা ও উতসব নয়; নারী পোশাকেও ব্যবহৃত হয়। হিন্দু-মুসলমান সংগীত চর্চার যে যৌথ ঐতিহ্য রচিত হয়েছে আবহমান কাল ধরে; তার চর্চা পাকিস্তানের সর্বত্র।
ভারতে রাজনৈতিক পরিসরে রসায়ন যাই হোক; শিল্প পরিসরে সংগীত-চিত্রকলা-কবিতায় হিন্দু-মুসলমানের ভালোবাসার যৌথ খামারটি আলোকসম্ভবা হয়ে থাকে। সেকালের কবি আমি খসরুর চর্চা ভারতে যতটা হয়; পাকিস্তানে ততটা নয়। লেখক খুশওয়ান্ত সিং চর্চা পাকিস্তানের ঘরে ঘরে যতটা হয়, ভারতে অতটা নেই। এ কালের কবি আল মাহমুদের কবিতা চর্চা ভারতের কলকাতায় যতটা হয়; বাংলাদেশের ঢাকায় ততোটা নেই। কাজেই ধর্ম কখনো বাধা নয় দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি চর্চায়।
ইসলামী দুনিয়াটিকে বাঁশের কেল্লার লেন্সে দেখলে; অত্যন্ত কম জেনে বা কিছু না জেনে; অযথা রাগারাগি করতে হয়।
পাকিস্তানে কুচক্রী সেনাদল, ভারতে কুচক্রী মোদি অথবা বাংলাদেশে বিজেপি সমর্থিত মধুচক্রী আওয়ামী লীগ ও জামায়াত সমর্থিত হাওয়াচক্রী বিএনপি কোনভাবেই মানুষের সংস্কৃতির সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করে না।
সাধারণ মানুষের ঈদ-পূজা উতসব, নববর্ষ উদযাপন; এ তাদের আবহমান কালের জীবন চর্যার অংশ। ঈদে অসংখ্য হিন্দু মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানায়, পূজায় অসংখ্য মুসলমান হিন্দুদের শুভেচ্ছা জানায়; আর বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটা হয় সর্বধর্ম মিলন উতসবের রঙ্গে রঙ্গিন।
জনমানুষের ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে তাই কট্টর প্রগতিশীল-কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও কট্টর ইসলামপন্থীদের এতো কুঁচকুঁচানি না করলেও চলবে। এইসব কুঁচকুঁচানি দিয়ে উতসবকে তেতো করা; আর কল্যাণ রাষ্ট্র, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের আন্দোলনগুলোকে ঢেকে রাখার ছলচাতুরি সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে।
মানুষকে সারাবছর গরিবির সঙ্গে লড়তে হয়; জীবন সংগ্রাম করতে হয়; তাই প্রাণ প্রবাহ ধরে রাখতে তাদের জীবনে উতসবের প্রয়োজন অপরিহার্য।
উন্নয়নের তাবাররক পেয়ে যাদের চর্বি হয়েছে; খাসজমি পেয়ে যাদের তেল হয়েছে; তারা বরং রোজ সকালে উঠে দৌড়াদৌড়ি করুন; হাই কোলেস্টেরল ও প্রেশার কমান। আমাদের আনন্দের দিনে ফেসবুকটাকে পাঞ্চিং ব্যাগ বানিয়ে তিক্ততা ছড়ানো বন্ধ করুন।
মাসকাওয়াথ আহসান, সম্পাদক, দ্য এডিটর থ্রি সিক্সটি ফাইভ, প্রধান সম্পাদক, ই-সাউথ এশিয়া।