লুৎফুল কবির রনি
রাত ন’টার মত বাজে।
আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন। আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায় চকচক করছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। বিখ্যাত মানুষরা যে আমাকে একেবারেই টেলিফোন করেন না তাতো না। মেয়ে এত উত্তেজিত কেন?
‘বাবা তুমি কিন্তু আবার বলতে বলবে না যে তুমি বাসায় নেই।
তোমার বিশ্রী অভ্যাস আছে বাসায় থেকেও বলো বাসায় নেই।’
আমি বললাম, টেলিফোন কে করেছে মা?
আমার মেয়ে ফিসফিস করে বলল, জাহানারা ইমাম।
এই নাম ফিসফিস করে বলছ কেন? ফিসফিস করে বলার কি হল?
‘বাবা উনি যখন বললেন, তার নাম জাহানারা ইমাম তখন আমি এতই নার্ভাস হয়ে গেছি যে, তাকে আসস্লামালাইকুম বলতে ভুলে গেছি।’
‘বিরাট ভুল হয়েছে। যাই হোক দেখা যাক কি করা যায়।’
আমি টেলিফোন ধরলাম এবং বললাম, ‘আমার মেয়ে আপনাকে সালাম দিতে ভুলে গেছে এই জন্যে সে খুব লজ্জিত। আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন। সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।’
ওপাশ থেকে তার হাসির শব্দ শুনলাম। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি কিন্তু আপনাকে টেলিফোন করেছি কিছু কঠিন কথা বলার জন্যে।’
‘বলুন।’
‘আপনি রাগ করুন বা না করুন কথাগুলো আমাকে বলতেই হবে।’
‘আমি শংকিত হয়ে আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘আপনি স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় লেখেন কেন? আপনার মত আরো অনেকেই এই কাজটি করে । কিন্তু আপনি কেন করবেন?’
তিনি কথা বলছে নিচু গলায়, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কোন অস্পষ্টতা নেই। কোন আড়ষ্টতা নেই।’
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আক্রমণ এইদিক থেকে আসবে ভাবিনি। তবে পত্রিকায় লেখা দেয়ার ব্যাপারে আমার কিছু যুক্তি আছে। খুব যে দুর্বল যুক্তি তাও না। যুক্তিগুলো তাকে শোনালাম। মনে হল এতে তিনি আরও রেগে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনার মিসির আলী বিষয়ক রচনা আমি কিছু কিছু পড়েছি, আপনি যুক্তি ভালো দেবেন তা জানি। কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে যুক্তি শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কথা দিতে হবে ওদের পত্রিকায় লিখে ওদের হাত শক্তিশালী করবেন না। আপনি একজন শহীদ পিতার পুত্র। ‘তুই রাজাকার’ শ্লোগান আপনার কলম থেকে বের হয়েছে। বলুন আর লিখবেন না।’
আমি সহজে প্রভাবিত হই না। সে রাতে হলাম । বলতে বাধ্য হলাম, আপনাকে কথা দিচ্ছি আর লিখব না। এবার বলুন আপনার রাগ কি কমেছে? তিনি হেসে ফেললেন। বাচ্চা মেয়েদের এক ধরণের হাসি আছে – কুটকুট হাসি, বড়দের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে যে হাসি তারা হাসে সেই হাসি।
আমি বললাম, ‘আমি সবসময় লক্ষ্য করেছি আপনি আমাকে আপনি আপনি কবেন। নিজেকে খুব দূরের মানষ মনে হয়। দয়া করে আমাকে ‘তুমি’ করে বলবেন।’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা বলব। এখন থেকে বলব।’
তিনি কিন্তু আমাকে ‘তুমি’ কখনই বলেননি। যতবারই মনে করিয়ে দিয়েছি ততবারই বলেছেন, ‘হ্যাঁ এখন থেকে বলব।’ কিন্তু বলার সময় বলেছেন ‘আপনি’। হয়তো তিনি আমাকে কখনোই কাছের মানুষ মনে করেননি।
তার অনেক কাছের মানুষ ছিলো আমার মা। আমার ছোট ভাই জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের উল্লেখ তার লেখাতে পাই। ব্যাক্তিগত আলাপেও জাফর ইকবালের প্রসঙ্গে তাকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখি। শুধু আমার ব্যাপারেই এক ধরণের শীতলতা। হয়তো তার ধারণা হয়েছিল, যে মহান আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনি দিচ্ছেন আমি সেই আন্দোলন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। যে ১০১ জনকে নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আদি যাত্রা, আমি সেই ১০১ জনের একজন। অথচ পরে আমার আর কোন খোঁজ নেই। কাজেই আমার ভূমিকায় অস্পষ্টতাতো আছেই। তিনি আমার প্রতি শীতল ভাব পোষণ করতেই পারেন। সেটাই স্বাভাবিক।
আরেক দিনের কথা, তিনি টেলিফোন করেছেন। গলার স্বর অস্পষ্ট। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আপনার শরীর কি খারাপ করেছে?’
তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘শরীর আছে শরীরের মতই। আপনাকে একটা ব্যাপারে টেলিফোন করেছি।’
‘বলুন কি ব্যাপার।’
‘এই যে একটা আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি এতে অর্থ ব্যায় হচ্ছে। আমাকে চলতে হচ্ছে মানুষের চাঁদায়। আপনি প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা দেবেন।’
‘অবশ্যই দেব।’
‘আমি একজনকে পাঠাচ্ছি। এ মাসের চাঁদা দিয়ে দিন।’
‘জ্বি আচ্ছা, কত করে দেব?’
‘আপনি আপনার স্বামর্থ্য মত দেবেন। মাসে দু’হাজার করে দিতে পারবেন?’
‘পারব।’
একজন এসে চাঁদা নিয়ে গেলো। পরের দু’মাস কেউ চাঁদ নিতে এলো না। আমার মন একটু খারাপ হল। মনে হল হয়ত সিদ্ধান্ত হয়েছে আমার কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হবে না। তৃতীয় মাসে তিনি টেলিফোন করে বললেন, ‘কি ব্যাপার আপনি আপনার চাঁদার টাকা দিচ্ছেন না কেন?’
আমি বিনীতভাবে বললাম, ‘কেউ তো নিতে আসেনি।’
‘আমার এত লোকজন কোথায় যে পাঠাবো! আপনি নিজে এসে দিয়ে যেতে পারেন না? আপনিতো এলিফেন্ট রোডেই থাকন। দু’মিনিটের পথ।’
‘আমি আসছি। ভালো কথা আপনার সাথে রাগারাগি করার মত একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এসেই কিন্তু রাগারাগি করব।’
তিনি বিস্মিত হলে বললেন, ‘আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘এসে নেই তারপর বুঝবেন।’
‘না এখনই বলুন।’
‘আমার বড় মেয়ে নোভার ছিল মাথা ভর্তি চুল। আপনি হচ্ছেন তার আদর্শ। আপনার মাথার ছোট ছোট চুল তার খুব পছন্দ। সে আপনার মত হবার প্রথম ধাপ হিসেবে তার মাথার সব চুল কেটে ফেলেছে।’
‘সত্যি।’
‘বাসায় আসুন। বাসায় এসে দেখে যান।’
একেবারে কিশোরী গলায় তিনি অনেকক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মেয়েকে বললেন লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়। আমি যখন তার বয়সী ছিলাম তখন আমার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা চুল ছিল। ছবি আছে। আমি আপনার মেয়েকে দেখাব। চুল কেটে ছোট করতে হয়েছে ক্যান্সারের জন্য। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়ে যাচ্ছিলো। কি আর করব?’
তিনি একবার আমার বাসায় আসার ইচ্ছা পোষণ করলেন। আমার মেয়েদের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। তার গল্প করতে ইচ্ছা করছে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে আনালাম। গ্রহ যেমন সূর্যকে ঘিরে রাখে আমার মেয়েরাও তাকে সেই ভাবে ঘিরে গোল হয়ে বসে পড়ল। তিনি তাদের বললেন তার শৈশবের কথা। আমি আসরে যোগ দিতে চেয়েছিলাম। তিনি বললেন, আপনি আসবেন না। এই আসরে আপনার প্রবেশাধিকার নেই।
অন্যান্য ফ্ল্যাটে খবর চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা আসছে। তারাও গল্প শুনতে চায়।
আমার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে পড়ল, অতি সন্মানিত এই মানুষটিকে সে কি খাওয়াবে? তিনি তো কিছুই খেতে পারেন না।
তিনি আমার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন, শুধু মুখে যাবেন না। কিছু খাবেন। পাকা পেঁপে থাকলে ভালো হয়।
ঘরে পাকা পেঁপে নেই। আমি ছুটলাম পাকা পেঁপের সন্ধানে। লিফট থেকে নামতেই এক ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে বললেন, জানেন, আমাদের এই ফ্ল্যাটের কোন এক বাড়িতে জাহানারা ইমাম এসেছেন।
আনন্দে আমার মন দ্রবীভূত হল। এই মহীয়সী নারী কত অল্প সময়ে মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছেন।
তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে দেন আসাদুজ্জামান নূর।
বাসায় তখন ক্যাসেট প্লেয়ার বাজছে। আমার মেয়েরা জন ডেনভারের গান শুনছে ‘রকি মাউন্টেন হাই, কলারাডো।’ সঙ্গে সঙ্গে গান বন্ধ হয়ে গেলো। মেয়েরা তাদের নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। আমার মা আমার কাছে জানতে চাইলেন, আন্দোলন এখন কে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমি তাকে বললাম, দ্বিতীয় জাহানারা ইমাম আমাদের নেই। জাহানারা ইমাম দু’টা তিনটা করে জন্মায় না। একটাই জন্মায়। তবে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেই। অপেক্ষা করুন।
মা জায়নামাজে বসলেন।
আর আমি একা একা বসে রইলাম বারান্দায়। এক ধরনের শূণ্যতা বোধ আমার ভেতর জমা হতে থাকল। কেবলি মনে হতে লাগল একটা মস্ত ভুল হতে গেছে। কি পরিমান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা এই মানুষটির প্রতি আমার ছিল তা তাকে জানানো হয় নি। আমার একটাই স্বান্ত্বনা মৃত্যুর ওপাশের জগত থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি সবসময়ই তার পাশে ছিলাম। যে ক’দিন বেঁচে থাকবো তাই থাকব। বঙ্গ-জননীর পাশে তার সন্তানরা থাকবে না তা কি কখনো হয়?
বাংলার পবিত্র মাটিতে তার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না। স্বাধীনতাবিরোধীদের এই সংবাদে উল্লসিত হবার কিছু নেই। বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়-ঝাপ্টা যত প্রচন্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে। কি সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই দেশে।
-তিনি / হুমায়ূন আহমেদ
সবাই তাকে বলতো বাংলার সুচিত্রা সেন। ক্যান্সারের কারণে সেই চুল বিসর্জন দিতে হয় তাকে। কেটে ফেলতে হয় মুখের একপাশের মাড়ি। উনার চুল কাটার খবর পেয়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বড় কন্যা
‘নোভাও তার চুল কেটে ফেলে। ‘
হুমায়ূন আহমেদ তাকে একথা জানাতেই তিনি বলেন
– আপনার মেয়েকে বলুন ‘ লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়।
তার বয়সে আমার হাঁটুর সমান চুল ছিল। ‘ এই মহীয়সী নারী সব মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছিলেন।
জাহানারা ইমাম দুইবার জন্ম নেন না। একবারই তিনি এসেছিলেন আমাদের মাঝে ।
‘২০০০সালের দিকে তাকিয়ে আছি । অতদিন বাঁচব কি ? এখন আমি বাঁচতে চাই । বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জন্য আরো লিখে যেতে চাই । আমার বই পড়ে যেসব পাঠক আমার কাছে আসে , তাদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৫ এর মধ্যে । তারা আমার কাছ থেকে জগত জীবন সম্পর্কে কতো কিছু জানতে চায় , আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা আরো বেশি করে জানতে চায়, তাদের নিজস্ব সুখ দুঃখ মেশানো নানা সমস্যার সমাধানও জানতে চায় , তারা আমাকে ঘিরে রাখে । তাদের জন্যই আমি এই বৃদ্ধ বয়সে একাকী বাস করেও কখনো নিঃসঙ্গ বোধ করি না । তাদের আগ্রহে জ্বলজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আরো বাঁচার , আরো লিখে যাবার প্রেরণা পাই । ”
দশ বছর ঘাতক ব্যাধির সাথে যুদ্ধ করে এই কথাগুলো দিয়ে তিনি শেষ করেছেন ”ক্যান্সারের সাথে বসবাস ”বইটি । শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এভাবেই সকল তরুণের মাঝে খুঁজে পেতেন রুমীর মুখ ভালবাসায়,স্নেহে হয়ে উঠেছেন সকলের মা।
ক্লাস সিক্স শেষ করে আর লেখাপড়া করবেন না বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। কেউ যখন তাকে লেখাপড়া করাতে রাজি করতে পারছেন না তখন হঠাত করে নিজে থেকেই আবার লেখাপড়ায় আগ্রহ ফিরে পেলেন। কারণটি বিচিত্র, তিনি খবরের কাগজে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মুগ্ধতা যতটুকু না বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বিদ্যাবুদ্ধি আর পাণ্ডিত্যে তার থেকে বেশি তার হাতকাটা ব্লাউজ আর ববকাটা চুলে!
কৈশোরে তার বই পড়ার তীব্র আগ্রহ। স্কুল শেষ করেই রবীন্দ্র রচনাবলিতে ডুবে গেছেন, বিছানার নিচে লুকিয়ে বঙ্কিমের কপাল কুণ্ডলা পড়ছেন। ছোট বয়সে বড়দের ‘নভেল’ পড়ার কারণে নিগৃহীত হচ্ছেন তবু কোনোমতে নিজেকে থামাতে পারছেন না। বইয়ের জন্য তীব্র আকর্ষণের কাছে সব যুক্তি সব বাধা নিষেধ তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।
দেখি ছটফটে একটা কিশোরী সাইকেলে করে শহর চষে ফেলছে তার আনন্দ আমাদের স্পর্শ করে। আবার দেখতে পাই হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়ার অপরাধে তাকে শাড়ি পরিয়ে ঘরের ভিতর বন্দী করে ফেলা হয়েছে, সেই যাতনাটুকুও সমানভাবে আমাদের ব্যথিত করে।
কলেজে জাহানারা ইমাম সহপাঠী অঞ্জলির মাধ্যমেই কমিউনিজমের পাঠ নেন। অঞ্জলি তাকে এ সংক্রান্ত বইপত্র পড়তে দিতেন। কিন্তু বাবা যথেষ্ট উদার হলেও কমিউনিস্টদের পত্রিকা ‘জনযুদ্ধ’ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন। মেয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক এটা তিনি চাননি। স্বামী শরীফও চাননি। তাই জাহানারা ইমামকে রাজনীতির পথ ত্যাগ করতে হয়।
অন্যজীবন বইয়ের শেষ অংশে জাহানারা ইমাম তরুণী হয়ে উঠেছেন। তার জীবনে প্রায় একই সঙ্গে রাজনীতি আর প্রেম এসে দেখা দিয়েছে। আমরা আবিষ্কার করি প্রেমকে সম্মান দেখাতে গিয়ে তিনি রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়েছেন, সেজন্য তার ভেতরে অস্পষ্ট বেদনাবোধ। এই বইয়ে উল্লেখ নেই কিন্তু আমরা জানি শেষ জীবনে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য তার নেতৃত্বে সারা দেশে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আমরা জানি না তরুণ বয়সে রাজনীতিকে বিসর্জন দেওয়ার সেই অতৃপ্তিটুকু শেষ বয়সে পূর্ণ হয়েছিল কিনা! কিন্তু আমরা অন্তত এটুকু জানি তার এই ভূমিকাটির জন্য এই দেশের মানুষ তাকে বুকের ভেতরে ঠাঁই দিয়েছে।
অন্যজীবন বইটিতে এই অসাধারণ মানুষটিকে আমরা ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণী হিসেবে দেখতে পাই। মানুষটি নেই কিন্তু এই ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণীটি তো আমাদের চোখের সামনে আছেন।
জাহানারার স্বপ্ন ছিলো- বড় হয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন তাঁর সফল হয়নি। মটকা চাচা বাবাকে বলে কয়ে রাজিও করিয়ে ফেলেছিলেন। ডাকযোগে শান্তিনিকেতনে ভর্তির প্রসপেকটাসও এসে পড়েছিলো। কিন্তু ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর খবর পড়ে জাহানারার শান্তিনিকেতন যাবার স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটলো। বাড়িতে বাবার কাছেই তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু। শিক্ষা জীবনে তাঁর বাবা সব ধরনের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
” রুমি খুব সহজে পৃথিবীতে আসে নি । দীর্ঘ ১৪ ঘন্টা গর্ভধারিণীকে কষ্ট দিয়ে, নিজেও কষ্ট পেয়ে তবেই সে এই পৃথিবীর আলো দেখে। আমার ডাক্তার জানতেন, রুমীর বাবা ইন্জ্ঞিনিয়ার।
তিনি সদ্যজাত রুমীকে দুই পায়ে ধরে, মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, ‘এটা ১৯৫১ সাল । ২০ বছর পর ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইন্জ্ঞিনিয়ার হবে ।’
আমি বলেছিলাম, যদি হতে না চায় ?
ডাক্তার হেসে বলেছিলেন, ‘ ইঞ্জিনিয়ার না হতে চায় না হবে।তবে কিছু একটা তো হবে ।’
১৯৭১ সালে রুমী ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে নি। তবে কিছু একটা হয়েছিল ।
সে দেশের জন্য শহীদ হয়েছিল ।”
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এর “৭১ এর দিনগুলিতে এভাবেই রুমির পৃথিবীতে আসার সময়টা বলেন।
”তুইতো এখানে পড়বিনা। আই আই টিতে তোর ক্লাস শুরু হবে সেপ্টেম্বরে ,তোকে না হয় কয়েকমাস আগেই আমেরিকা পাঠিয়ে দেব “- শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
“আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকা পাঠিয়ে দাও,আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মত অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়ত বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইন্জিনিয়ার হবো, কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিন ও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবনা। তুমি কি তাই চাও আম্মা?” রুমী।
শহীদ জননী জোরে জোরে দুই চোখ বন্ধ করে বললেন- “না ,তা চাই নে। ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা, তুই যুদ্ধেই যা।”
সেই মা’কে ছেলে কিছুক্ষণের জন্য আড়ালে যেতে বলে।
মা বুঝতে পারেন তার ছেলে সিগারেট খেতে শিখেছে তাই আড়াল চায়। মা বলেন, “কতদিন পর তোকে দেখছি! আবার কখন, কতদিন পর দেখব জানিনা। আমার সামনেই সিগারেট খা।
ঢাকায় অপারেশন করতে বাসায় এসে মা’য়ের কাছে রুমীর আবদার ছিল একটা ভালও সিগারেটের বক্স, যেটাতে পানি ঢুকে সিগারেট ভিজে যায় না।
মা জাহানারা ইমাম ঢাকার সব মার্কেট ঘুরে অবশেষে এমন একটা সিগারেটের বক্স পেলেন যেটাতে সিগারেট রেখে তাঁর ছেলে পাক বাহিনীর ভয়ে জলের নিচে ডুব দিয়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু তাঁর সিগারেট ভিজবে না।
ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তিনি দেখছেন। কিন্তু দেখছেন দূর থেকে। যদিও এই গল্প একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত গল্প। জননীর তীব্র শোক ও বেদনার গল্প। নিজের গল্প দূর থেকে দেখতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা বড় শিল্পী। গভীর আবেগকে সংযত করবার জন্য প্রযোজন হয় একটি পাষাণ হৃদয়ের। সত্যিকার শিল্পীদের হৃদয় হয় পাথরের, নয়ত এত দুঃখকে তাঁরা কোথায় ধারণ করবেন? জাহানারা ইমাম হৃদয়কে পাথর করে লিখলেন তাঁর ডায়রি। কী অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই না তাঁর গল্প বলে গেছেন। সেই গল্প তাঁর একার থাকেনি। কোন এক অলৌকিক উপায়ে হয়ে গেছে আমাদের সবার গল্প। — হুমায়ূন আহমেদ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা ডায়রি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। ১৯৮৬ সালে ডায়রিটি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ০১ মার্চ থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত লেখা এই ডায়রিটিতে মুক্তিযুদ্ধে অবরুদ্ধ ঢাকার অবস্থা, পাকহানাদার ও রাজাকারদের গনহত্যা আর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতার কথা কথা উঠে এসেছে একেবারে বাস্তবতার জায়গা থেকে। সাথে যুদ্ধের মধ্যে বসবাস করা একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সত্য গল্প। যুদ্ধের মধ্যে তাদের জীবন যাপনের গল্প।
এক বাঙালি নারী, গৃহবধূ, লেখিকা এবং লড়াকু জননী জাহানারা ইমাম স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এক জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের মানুষের কাছে হয়ে ওঠেন প্রেরণা ও আস্থার ধ্রুবলোক।
ডাক্তাররা মৃত্যুর পূর্বাভাস দিয়ে দেয়ার পরও জাহানারা ইমাম এতটুকু বিচলিত হননি। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি অন্যদের সাহস দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে তাঁর স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর কাঁপা হাতে লেখা চিঠিতে দেশের মানুষের জন্য তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।’
নিজের সহযোদ্ধাদের তিনি প্রায়ই বলতেন, “আমি হলাম শুকনো ঘাসের মত। যখন বৃষ্টির সংস্পর্শে আসি, তখন আমি সবুজ হয়ে উঠি। তোমরা সকলে আমার কাছে বৃষ্টির মত। তোমাদের তেজোদ্দীপ্ত মনোভাব আমাকে জাগিয়ে তোলে।” কিন্তু তিনি কি জানতেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু, আত্মবিস্মৃত প্রজন্মের কাছে তিনি নিজেই ছিলেন জাতিস্মরের মত, যিনি শত বাধা ডিঙিয়েও সবাইকে গত জন্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে লড়াই চালিয়ে যেতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে যদি তাঁর অস্তিত্ব না থাকত, তবে এতদিনে হয়ত মৌলবাদের আবরণে ছেয়ে যেত গোটা জাতি। দেশটির নাম বাংলাদেশ থাকলেও, ভাবে-আদর্শে-নীতিতে এ দেশ হয়ে উঠত নব্য পাকিস্তান।
আমরা তাই নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারি। ভাগ্যিস তিনি জন্মেছিলেন, এসেছিলেন ধনধান্যে পুষ্পে ভরা এই বসুন্ধরায়। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন হয়তো এ পৃথিবী হতে দেহত্যাগ করেছেন, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ আজও ধারণ ও বহন করে চলেছে বাংলাদেশ। তাই তো আজও পথ হারায়নি বাংলাদেশ। যতদিন এ পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে, সেই অস্তিত্বের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবেন জাহানারা ইমামও। বাংলাদেশ ও জাহানারা ইমাম যে আলাদা কিছু নয়!
১৭ই ডিসেম্বর ফিরে এলো রুমীর সহযোদ্ধারা। কেবল ফিরল না রুমী। যে সত্য কে মেনে না নিতে রোজ নিজেকে সাহস যুগিয়েছেন জাহানারা, তা তাকে মানতেই হলো অবশেষে। শহীদ হয়েছেন রুমী আর জাহানারা হলেন শহীদ জননী। বিশ বছর পর সঞ্চিত দুঃখ, ক্ষোভ, বেদনায় তিনি জানতে চেয়েছিলেন-
“যাহারা তোমার বিষাইছে বাযু, নিভাইছে তব আলো
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,তুমি কি বেসেছ ভালো?”
২৬শে জুন আজ আম্মার চলে যাওয়ার দিন। এই প্রজন্ম তাঁর কাছে ঋণী। তিনি এই জাতিকে মৌলিক শিকড়ের সন্ধান দিয়েছিলেন। এই দেশ জেগে আছে তাঁর স্বপ্ন বুকে ধারণ করে। তারা জানি তিনি কী অদম্য সাহস নিয়ে ডাক দিয়েছিলেন। মা তিনি , জননী তিনি।। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য নিজের বাকি জীবন উৎসর্গ করেন।
আম্মা, রুমির মত এভাবেই তুমি বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে আমাদের নতুনভাবে আমাদের চিনিয়েছিলে
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকুক আপনার অনুপ্রেরনাদায়ী আত্মত্যাগী জীবনগাঁথা।
লুৎফুল কবির রনি, লেখক ও আর্ট ক্রিটিক